ম্যানগ্রোভ বন রক্ষা করা কেন জরুরি

সউদ আহমেদ খান
| আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:০৫ | প্রকাশিত : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৫৫

ম্যানগ্রোভ বলতে সমুদ্র উপকূলে জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত বিস্তীর্ণ জলাভূমিকে বোঝায়। ম্যানগ্রোভ বন জোয়ার-ভাটায় বিধৌত লবণাক্ত সমতলভূমি। পৃথিবীর ১১৮টি দেশে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে ম্যানগ্রোভ বন আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গজুড়ে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মোহনায় গড়ে ওঠা সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন।

বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালী জেলার ৬ লাখ ১,৭০০ হেক্টরজুড়ে সুন্দরবন অবস্থিত , যা দেশের ৪.১৩% । সুন্দরবনের শতকরা ৬২ ভাগই বাংলাদেশের সীমান্তে।

সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশের ফুসফুস। সুন্দরবনে সুন্দরী, গেওয়া, ঝামটি, গরান, কেওড়াসহ ২৪৫ শ্রেণির ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। পৃথিবীর ৫০ প্রজাতির ৩৫ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছই বাংলাদেশে পাওয়া যায়।

সুন্দরবনে প্রায় ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের জ্বালানির শতকরা ৪৫ ভাগের জোগানদাতা সুন্দরবন। বাংলাদেশের বন আয়ের শতকরা ৪১ ভাগ সুন্দরবন থেকে আসে ।

ম্যানগ্রোভ বনের প্রধান বৈশিষ্ট্য এরা লবণ, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা সহনশীল। এরা লবণাক্ত পরিবেশে কম অক্সিজেনেই বেঁচে থাকতে পারে। নাসার স্যাটেলাইট ডাটার তথ্যমতে, ম্যানগ্রোভ বনকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কার্বন পরিশোধক। এরা বায়ুমণ্ডল থেকে দীর্ঘমেয়াদে কার্বন ডাই অক্সাইড সরিয়ে ফেলতে পারে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, পৃথিবীর ১৭% কার্বন নিঃসরণের ক্ষতি কমিয়ে দিতে সাহায্য করছে ম্যানগ্রোভ বন। ম্যানগ্রোভ দেহকোষ গহ্বরে লবণ সংগ্রহ করে রাখে। সাদা এবং ধূসর ম্যানগ্রোভের দুইটি আলাদা গ্রন্থি থাকে যেগুলো লবণ পরিশোধন করে। সমুদ্রের উচ্চ ঢেউ যখন লবণাক্ত পানি বয়ে আনে তখন ম্যানগ্রোভ বন এই পানি আসা প্রতিহত করে এবং যতটুকু পানি থেকে যায় শ্বাসমূল তা পরিশোধন করে।

শ্বাসমূল সাধারণত ৩০ সে.মি থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয় । এছাড়াও ম্যানগ্রোভ বন জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষা করে।

এতসব উপকারের পরও আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রক্ষায় আমরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করছি না। এক তথ্যমতে, সারা পৃথিবীতে ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৫ এই ২৫ বছরে ম্যানগ্রোভ বন ১৮৮,০০০ বর্গ কি.মি. থেকে ১৫২,০০০ বর্গ কি.মি. হয়েছে। বাংলাদেশে গত ২৫ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১০,৯৮০ হেক্টর। ভাঙনের কারণে প্রতি বছর ৬ কি.মি. বনের আয়তন কমছে। গত ৩৭ বছরে ১৪৪ কি.মি. আয়তন কমেছে। ২০০৭ সালের সিডরে সুন্দরবনের প্রায় ৪০% ক্ষতি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৫৯ সালে সুন্দরবনে প্রতি হেক্টরে সুন্দরী গাছের সংখ্যা ছিল ২১১টি। ২০২০ সালে এই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮০টিতে। এছাড়াও সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রাণীও অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে।

সুন্দরবনের আশপাশের স্থাপনা, কারখানা ও বনের মধ্য দিয়ে ডিজেল পেট্রোলচালিত নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ সুন্দরবনের অস্তিত্ব ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে ।

বাংলাদেশে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল কমে যাওয়ার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে বাড়ছে লবণাক্ততার হার। যার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের চার কোটি লোক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে দৈনিক ৫ গ্রাম লবণ খেতে বলে, বাংলাদেশের উপকূলের মানুষ সেখানে ২০ গুণ বেশি লবণ খায়। পানির লবণাক্ততা মাটির জৈব পদার্থ, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, ফসফরাসের পরিমাণ কমিয়ে কপার, জিঙ্কের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে মাটির উর্বরতা কমছে, গাছের বৃদ্ধি কমছে এবং ফসল উৎপাদনও কমছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় মাত্র ৩০ ভাগ জমি চাষযোগ্য, ৫৩ ভাগ পতিত এবং ১৭ ভাগ জায়গায় মাছচাষ হয় ।

এস.আর.ডি.আই. এর মতে, খুলনার ২১৩,০০০ হেক্টর জমির মধ্যে ১৯০,০০০ হেক্টর লবণাক্ত, যা মোট জমির ৮৯ শতাংশ। রিভার স্যানিনিটি & ক্লাইমেট চেঞ্চ এভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৫০ সালে বাংলাদেশের ১৯ জেলার ১৪৮ থানার মধ্যে ১০টি থানার নদী মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত হয়ে যাবে ।

এসডিজি-৬ এর অন্যতম লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই গ্রহণযোগ্য কৃষি ব্যবস্থাপনা ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা । কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারিনি। ইরিত্রিয়ার মৎস্য মন্ত্রণালয় সেখানকার ম্যানগ্রোভ বন রক্ষায় নতুন করে ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানোর সুপারিশ করেছে।

সেনেগালের পরিবেশবিদ ও সাবেক পরিবেশমন্ত্রী হায়দার আলী ১০ বছরে প্রায় ১৫ কোটি ম্যানগ্রোভ বনায়ন করেছেন। সম্প্রতি প্রলয় সৃষ্টিকারী ঘূর্ণিঝড় আম্ফান হওয়ার পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় সুন্দরবনে ৫ কোটি ম্যানগ্রোভ বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। সুন্দরবন রক্ষার বাস্তবতা বুঝে, আসন্ন পরিবেশ বিপর্যয় থেকে বাঁচতে আমাদেরও সুন্দরবন রক্ষায় ম্যানগ্রোভ বনায়ন ছাড়া উপায় নেই ।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :