এই নদী এই পানি

প্রকাশ | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২০:৪৩ | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২১:০৮

শেখ আনোয়ার

নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে কিংবা উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর ভারি বর্ষণে দেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেকসময় নতুন করে প্লাবিত হয় চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দি হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। নদী সম্পর্কে বাংলাদেশে এমন খবর অতি সনাতন। কারণ ফি বছর ঘুরে ফিরে আসে একই খবর। বর্ষা মৌসুমে নদ-নদীর পানি বাড়ে, যা এমনিতে দেখা যায়। যেহেতু নদীকে ঘিরেই বাংলাদেশের প্রতিটা শহর, বন্দর, গঞ্জ, বাজার প্রভৃতি গড়ে উঠেছে।

বলা হয়, হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশ। শত শত বছর ধরে বহমান আর যুগের পানির ভান্ডার। তাই প্রশ্ন থেকে যায়। নদীর পানি বাড়ে কেনো? সত্যিই তো! নদীর পানি নিয়ে সবকিছু জানা কি শেষ? মোটেই তা নয়। নদী ও নদীর পানি নিয়ে রয়েছে গবেষকদের রয়েছে চমকপ্রদ অসংখ্য তথ্য। অবাক করা অনেক প্রশ্ন। যেগুলো হয়তো আগে এভাবে কখনো কারও মনেই হয়নি।

নদী এঁকে বেঁকে যায়। ঢেউয়ের আকারে এঁকে বেঁকে যাবার একটা গড়পড়তা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য রয়েছেÑ যতটুকু দূরত্বে দু’দিকের একটা বাঁক সম্পূর্ণ হয় ততদূর। অদ্ভূত ব্যাপার হলো নদীর প্রশস্ততার সঙ্গে এই তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যরে একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। এটা হয়ে থাকে প্রশস্ততার ১১ গুণ। এমন কেনো হয়? তা গাণিতিকভাবেই দেখানো সম্ভব। নদীর পানি নিস্তরঙ্গ সমতল। কিন্তু হঠাৎ বাতাস দেখা দিলো। ওমনি পানিতে ঢেউ ফুঁসে উঠলো। এমন হলো কেনো? এটাও গণিতের ব্যাপার।

নদীর ভাঙ্গন ধ্বংসের কাজ। প্রমত্তা নদী ভাঙ্গে-গড়ে। তলার মাটিও কর্ষণ করে নিয়ে যায়। এজন্য কি নদীর পানি দায়ী? মোটেও তা নয়। অন্তত সরাসরি তো নয়ই। কারণ, পানি যার গায়ের সংলগ্ন হয় সেখানেই একটা অতি পাতলা সুরক্ষা-পর্দার আবরণ দিয়ে যায়। পানির আঘাত তাই ভাঙ্গনের কাজ করতে পারে না। তবে পানির সঙ্গে যদি পাথর, নুড়ি, বালি বা এরকম অন্য বাহিত বস্তু থাকে। যেগুলো হাতুড়ির মতো আঘাত করতে পারে। সেগুলোই পাড় ভাঙ্গে। ক্ষয় করে তল। নদী উজান থেকে ভাটির দিকে বয়।

কিন্তু পানি কি শুধু ভাটিতেই যায়? উজানে যায় না? ঘনিষ্টভাবে পানির গতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় নদী আসলে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে যাওয়া পানির ঘূর্ণি-গতি। আসলে দু’টো ঘূর্ণি-প্রবাহ থাকে অধিকাংশ নদীর। পানির যে কোন অংশকে ঘূর্ণির বাঁকে অধিকাংশ সময় ভাটি থেকে উজানের দিকেই অগ্রসর হতে দেখা যায়। নদীর গতি পথের দিকে নয়। আর এ কারণেই নদীতে কিছু ভাসিয়ে দিলে তাকে সব সময় দু’টো ঘুর্ণি-প্রবাহের মাঝ বরাবর মাঝ-দরিয়ায় একটা সরু চ্যানেলে ভাসতে দেখা যায় ।

নদীর পাড় ভাঙ্গে। মানে নদী তার গতিপথ বদলাতে থাকে। আর নদীর তল? ওটাও কি সুনির্দিষ্ট? তলায় গিয়ে নদীর প্রবাহ কি শেষ হয়ে যায়? মোটেই তা নয়। নদী তলের নীচেও রয়েছে আরো নদী। যেখানে ভূগর্ভে বয়ে যায় নদী। ধীর গতির হলেও এও এক নদী। প্রায়শই আসল নদীর চেয়ে বড় হয় ভূগর্ভের এই নদী। তলদেশে তারও থাকে নানা শাখা প্রশাখা। এসব নদীতেও থাকে গোপন বহু আঁকাবাঁকা নদীর চ্যানেল। সুপেয় পানির জগতে ভূগর্ভের পানির ভূমিকা বিশাল। ভূগর্ভের যে পানির আধার সেটা ভূপৃষ্ঠের যে কোনও আধারের চেয়ে, মানব সৃষ্ট বিশাল হ্রদের চেয়েও অনেক বড়। কোন কোন জায়গায় এ পানির বয়স অনেক অনেক বেশি। তাই এ পানির দূষিত হবার আশংকা থেকে যায় বেশি।

নদীর পানিও দূষিত হয়। তবে নদী নিজেই নিজের পানিকে নিত্য ধুয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ভূগর্ভের বিশাল আধারগুলোর কোনও কোনওটাতে পানি জমে আছে বহু হাজার বছর ধরে। যার কোনও পরিবর্তন ঘটছে না। সাহারা মরুভূমির নীচের জলাধারের পানি ৩৫ হাজার বছর ধরে একটুও নড়েনি। মজার ব্যাপার হলো- যে কোনও জলাধারের পানি, তা সে ভূগর্ভেই হোক আর বাইরেই হোক, ৪৫ বছরের বেশি পুরানো হলে তা সহজেই বুঝা যাবে। কারণ সেক্ষেত্রে তাতে ট্রিশিয়াম পরমাণু থাকবেনা। ট্রিশিয়াম শুধু মিশেছে যেসব পানিতে যা ৪৫ বছরের মধ্যে আবহাওয়ার সংস্পর্শে এসেছে এবং বায়ুমন্ডলে বিস্ফোরিত বিভিন্ন পারমাণবিক অস্ত্রপরীক্ষার দূষণের শিকার হয়েছে। ৩৫ হাজার বছর পর সাহারার নীচের পানি কিন্তু এবার সত্যি নড়তে শুরু করেছে। লিবিয়ার প্রয়াত নেতা কর্নেল গাদ্দাফী এটা তুলে এনে বিখ্যাত মনুষ্যসৃষ্ট মরুনদীর সূত্রপাত করেন।

গণিত কখনো কখনো নদী-বিজ্ঞানীকে বিভ্রান্ত করে। যেমন ম্যালিং ফরমূলার কথা ধরা যাক। শতবর্ষ পুরনো এই ফরমূলায় দেখানো হয়েছে নদী পারের লতাগুল্ম আর নদী তলের শৈবালের কারণে যে রুক্ষতা সৃষ্টি হয় তার ফলে নদী প্রবাহের গতি কিভাবে কমে যায় এবং বন্যার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এই ফরমুলার শিকার হয়ে নদী-প্রকৌশলীদের হাতে যুগে যুগে বহু সুন্দর ঝোপঝাড় ধ্বংস হয়েছে। কিন্ত অবশেষে ফরমুলাটা ধোপে টেকেনি।

নদীর পার, আর নদীর তলের ঝোপ-ঝাড় এখন প্রশংশিত জিনিস। আগের দিনে এসবের নাম ছিলো জলা-জংলা। এখন জলাভূমি, জল মহাল। ইংরেজি ভাষার শব্দ প্রয়োগের এই বির্বতন আরো অর্থবহ। আগে ছিল ‘বগ’। এর সংজ্ঞাÑ যেখানে গাছপালা ঝোপঝাড়ের জংলায় নদীর সুশৃঙ্খল গতিপথ বদ্ধ হয়ে যায়। এখন সেটা হয়েছে ‘ওয়েট ল্যান্ড’। বড়ই আধুনিক জিনিস। কারণ ওয়েট ল্যান্ড হলো জৈবিকভাবে উর্বর, জীব-বৈচিত্র্যের প্রসূতি। তবে নামকরণের মাহাত্ম্য এখানেই শেষ নয়। ‘বগ্’ থেকে ‘ফেন’, ‘ফেন’ থেকে ‘মার্ম’, তার থেকে ‘মায়ার’। এদের পার্থক্যগুলো সূক্ষ্ম। সব সময় বুঝে উঠা যায় না। তবে প্রথমটার থেকে পরেরটা কিছুটা উত্তম। মানুষ-সৃষ্ট বাঁধগুলো নিন্দিত জিনিস। কারণ বাঁধের উপরে আর নীচে এরা নদীর পরিবেশে সুসমতা নষ্ট করে। যে বিপুল পরিমাণ জলজ উদ্ভিদকে এরা আটকে দেয়। পচিয়ে ফেলে। তা নানা রকম জীবাণুর জন্ম দেয়। এসবের কোন কোন জীবাণু মাটির পারদকে বিষাক্ত মিথাইল পারদে পরিণত করে। মাছের মধ্যে এবং মাছের ভোক্তা মানুষের মধ্যে, বিষময়তা সৃষ্টি করে। শুধু কি তাই? বাঁধের প্রচন্ড চাপ নিয়ে স্পিলওয়ে দিয়ে যখন পানি ছাড়া হয় তখন তার তোড়ে পানিতে এত বাতাস মেশে যে কাছাকাছি সঞ্চারমান মাছের শরীরে বাতাসের বড় হেরফেরে অসংখ্য মাছ এমনিতে মরতে থাকে।

সব তথ্য অবশ্য বাঁধের বিপক্ষে নয়। স্বপক্ষেও কিছু রয়েছে। পৃথিবীর সব বাঁধ যে পরিমাণ পানিকে আটকে রেখেছে তা একত্র করলে ১০ হাজার কিউবিক কিলোমিটার হবে। এ পানি শুধু বাঁধের জন্যই সাগরে গিয়ে পড়তে পারছেনা। যদি সাগরে যেতে পারতো তাহলে কি হতো? সাগরের জল-তল তখনই আরো কয়েক’শ সেন্টিমিটার ফেঁপে উঠতো। একে তো গ্রিন হাউজ এফেক্টে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বাঁধ অন্তত এইটুকু তো বাঁচিয়েছে? তবে দিন শেষে বাঁধের ক্ষতির পাল্লাটাই ভারী। শুধু পরিবেশের ব্যাপার নয়।

পুরো পৃথিবীর আদলটা নিয়েই টান দিয়েছে বাঁধে আটকে পড়া পানি। বাঁধে আটকানো কৃত্রিম জলাধারগুলোর বিপুল পানি পৃথিবীর ত্বককে চাপ দিয়ে তার গঠন বদলে দিচ্ছে। ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণ ঘটাচ্ছে। শুধু কি তাই? এটা পৃথিবীর ঘর্ষণের গতি পর্যন্ত পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এর কারণ কি? কারণ আটকানো পানি সর্বত্র সমানভাবে নেই। নিরক্ষীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা সাগর। মধ্য অক্ষাংশেই রয়েছে বাঁধে আটকানো সব পানি। অর্থাৎ যে পানির অধিকাংশ থাকার কথা ছিলো নিরক্ষীয় অঞ্চলে। তা এখন যেনো গুটিয়ে এনে রাখা হয়েছে মধ্য অক্ষাংশ অঞ্চলে। এই অক্ষাংশগুলো যেহেতু পৃথিবীর অক্ষ রেখার অপেক্ষাকৃত কাছে, এর ফলে অক্ষের উপর পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি বেড়ে যাচ্ছে। যেমন করে স্কেটিংরত ঘূর্ণায়মান অলিম্পিক ষ্টার তার হাতটা গুটিয়ে শরীরের কাছে নিয়ে এলে তার ঘূর্ণন গতি বৃদ্ধি পায় ঠিক তেমন।

গবেষকরা হিসেব কষে দেখেছেন, এর ফলে দিনের দৈর্ঘ্য এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ হ্রাস পেয়েছে। যদিও চিন্তিত হবার মতো কিছু নয়। গবেষকদের আশংকা তবুও রয়েই যায়। কারণ বলা তো যায় না, এর থেকে অন্য কোন নতুন উপসর্গ যে দেখা দেবে না, তার গ্যারান্টি কি? তাছাড়া পৃথিবীর মাঝখানের চেয়ে উত্তরের দিকে পানি যে বেশি জমা রয়েছে, তার ফলে পৃথিবীর অক্ষটাই একটু বেঁকে গেছে। উত্তর আর দক্ষিণ মেরু এর জন্য ৬০ সেন্টিমিটারে সরে গেছে। নদীর পানিতে বাঁধ দেয়ার ফলে এসব সূক্ষ্ম অথচ বিশ্বব্যাপী প্রভাবের কথা আমরা কখনো কি ভেবে দেখেছি?

লেখক: বিজ্ঞান লেখক, এমফিল গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়