জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু

বিশ্ব মঞ্চে বাংলা ভাষার প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

তাপস হালদার
| আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:০৮ | প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৩২

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সাল। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জন্য এক মহেন্দ্রক্ষণ। জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রথম ভাষণ দেন। তার মাত্র আট দিন আগে ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ১৩৬ তম দেশ হিসেবে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখনকার সময়ে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্য হওয়া খুব সহজ বিষয় ছিল না। জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি চীনের প্রবল আপত্তি ছিল। কিন্তু মাত্র তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ট কুটনীতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুন্দর একটি ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। জাতিসংঘের স্বীকৃতির পাওয়া ছিল বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্রনীতির ফলে খুব অল্প সময়ে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সফল হয় বাংলাদেশ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে বাংলা ভাষাকে বিশ্ব সভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। সভার সভাপতি বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন। বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সাথে বলেন ‘মাননীয় সভাপতি আমি আমার মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই'। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ছয়টি, তার মধ্যে বাংলা ভাষা নেই। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে অধিবেশনের সভাপতি জাতির পিতাকে বাংলায় বক্তব্য দেয়ার অনুমতি দেন।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ মঞ্চে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরা ছিল বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন, সেদিন তিনি সেই স্বপ্নপূরণ করে ইতিহাস তৈরি করেন। বাংলা ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল গভীর মমত্ববোধ। তিনি হৃদয় ধারণ করতেন বাংলা ভাষাকে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ভাষা আন্দোলনে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল সেই মহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন তিনি বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন। এটি ছিল আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি লাভের প্রথম পদক্ষেপ।

সেদিনের ভাষণটি ছিল সমগ্র বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত, শোষিত মানুষের কথা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি সাহসী উচ্চারণ। ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট,বিশ্ব মোড়লদের শোষন বঞ্চনা,বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে অবস্থান,পারস্পারিক ঐক্যের কথা তুলে ধরেছিলেন।

তিনি ভাষণের শুরুতেই বলেছিলেন, ‘মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগিদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙ্গালি জাতির ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহুর্ত। বাঙ্গালি জাতির আজ স্বপ্নপূরণ হওয়ার দিন। জাতি হিসেবে আজ বাঙ্গালি গর্বিত।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরি নয়'। এই দৃঢ় উচ্চারণটি তিনি বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্প সময়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে বিশ্বের প্রতিটি দেশের কাছে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।

বিশ্ব মোড়লদের নিপীড়ন শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বহু অংশে এখনো অবিচার নিপীড়ন চলিতেছে। অবৈধ দখলকৃত ভূখণ্ড পুরোপুরি মুক্ত করার জন্য আমাদের আরব ভাইদের সংগ্রাম অব্যাহত রহিয়াছে এবং প্যালেস্টাইনি জনগণের বৈধ জাতীয় অধিকার এখনো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। উপনিবেশ বিলোপ প্রকৃয়ায় যদিও অগ্রগতি হইয়াছে কিন্তু এই প্রকৃয়া এখনো চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছায় নাই। বিশেষ করিয়া আফ্রিকার ক্ষেত্রে এই সত্যটি স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে।---বর্ণ বৈষম্যবাদ, যা হোক মানবতারবিরোধী বলিয়া বারবার আখ্যায়িত করা হইয়াছে, তাহা এখানে আমাদের বিবেককে দংশন করা অব্যাহত রাখিয়েছে’।

আজকে যে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো কথায় কথায় অস্ত্র প্রয়োগের হুমকি দেয় এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশই যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করতে সক্ষম, সে সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। বর্তমান অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করা সম্ভব হলে অর্থনৈতিক সংকট দূর করার পরিবেশই গড়ে উঠবে না-এ প্রতিযোগিতায় যে বিপুল সম্পদ অপচয় হচ্ছে,তা মানবজাতির সাধারণ কল্যাণে নিয়োগ করা সম্ভব হবে'।

কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষা যে একটি দেশের উন্নতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটাও তিনি ভাষণে বলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন মানুষকে কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষায় শক্তিশালী করে উন্নত, দক্ষ সমৃদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। সেদিনই তিনি এই বাস্তবতাটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা তাকাবো এমন এক পৃথিবীর দিকে, যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টি ক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য। আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম হবে’।

বঙ্গবন্ধু বক্তব্যের শেষ অংশে বলেন, মানুষের অজয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুন্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করতে চাই।

মানবের অসাধ্য সাধন ও দুরূহ বাধা অতিক্রমের অদম্য শক্তির প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থার কথা আবার ঘোষণা করতে চাই। আমাদের মতো দেশগুলো যাদের অভ্যুদয় সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে,এই আদর্শে বিশ্বাসই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। আমাদের কষ্ট স্বীকার করতে হতে পারে,কিন্তু আমাদের ধ্বংস নেই।এই জীবন যুদ্ধের মোকাবেলায় জনগণের প্রতিরোধ ক্ষমতা শেষ কথা। আত্মনির্ভরশীলতাই আমাদের লক্ষ্য। জনগণের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগেই আমাদের নির্ধারিত কর্মধারা। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যায় অংশীদারি আমাদের কাজকে সহজতর করতে পারে, জনগণের দুঃখ কষ্ট লাঘব করতে পারে। কিন্তু আমাদের মত উদীয়মান দেশগুলোর অবশ্যই নিজেদের কার্যক্ষমতার প্রতি আস্থা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হতে পারি, গড়ে তুলতে পারি উন্নততর ভবিষ্যৎ।

তিনি সবসময় মানুষের ভালোর কথা বলেছেন, সেটা যে শুধুমাত্র বাঙ্গালিদের নিয়ে ভেবেছেন তা নয়। তিনি সমগ্র মানবজাতির কথাই ভাবতেন। এ প্রসঙ্গে একবার একটি বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতিকে নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর শক্তির উৎস ভালোবাসা অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতিও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’। বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র বাঙালিদের নিয়েই ভাবতেন না। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী সংগ্রামী জনগণের অনুপ্রেরণার উৎস। বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ মঞ্চে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি যুগ যুগ ধরে অধিকার বঞ্চিত মানুষদের প্রেরণা জোগাবে।

বাংলা ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর জাতিসংঘের ‘ডেলিগেট বুলেটিন' বঙ্গবন্ধুকে ‘কিংবদন্তি র নায়ক মুজিব' বলে আখ্যায়িত করে। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এ যাবৎ আমরা কিংবদন্তি শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। এখন আমরা তাঁকে কাজের মধ্যে দেখতে পাব। বুলেটিনটিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে বিশ্ব নেতাদের মতামত তুলে ধরা হয়। ভাষণ শুনে জাতিসংঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বক্তৃতাটি ছিল সহজ, গঠনমূলক এবং অর্থবহ।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহান তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাস্তবিকই তিনি এক শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব'।

বিশ্ব সভায় বাংলাকে এর আগে কেউ এভাবে তুলে ধরেনি। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরই সুযোগ্যকন্যা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার দেশরত্ন শেখ হাসিনাও প্রতিবছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় বক্তব্য প্রদান করে চলছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তব্য দিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সফল কুটনীতির ফলে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেসকো ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। আজ প্রিয় বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশ পালন করছে।

বঙ্গবন্ধু একটি মাত্র ভাষণ বিশ্ব সভায় দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অথচ সেই ভাষণটিই বিশ্ব সভায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। যতদিন বিশ্বে শোষন, নিপীড়ন, বঞ্চনা থাকবে ততদিনই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বঞ্চিত মানুষের কাছে প্রেরণা হয়ে সাহস দিবে।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল:haldertapas80gmail.com

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :