টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও নারীর ক্ষমতায়নে বৃক্ষরোপণ

প্রকাশ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৫৮

সউদ আহমেদ খান

২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে ১৭টি বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা পরিকল্পিত হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ এজেন্ডার লক্ষ্যমাত্রা ৫ ও লক্ষ্যমাত্রা ১৩ তে যথাক্রমে লিঙ্গ সমতা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। নারীর প্রতি সংকীর্ণ মানসিকতা, ক্রমাগত পরিবেশ দূষণ ও সচেতনতার অভাবে দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রসঙ্গত, লিঙ্গ সমতায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৫০তম এবং জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত।

জাতিসংঘের পরিবেশ ও  উন্নয়নবিষয়ক কমিশন  (ইউএনসিইডি) পরিবেশ সুরক্ষার মাধ্যমে উদার ও মুক্ত বাণিজ্য অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। টেকসই গ্রামীণ উন্নয়নের লক্ষ্যে ইউএনসিইডি ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্যসমূহ যথাক্রমে:

১. জনগণের সম্পৃক্ততা এবং গণপ্রতিষ্ঠান বিশেষত নারীসংঘ, যুবক, আদিবাসী, স্থানীয় জনগণ, প্রান্তিক কৃষকদের টেকসই কৃষি ও উন্নয়নে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

 ২. প্রান্তিক জনগণ, কৃষক, নারী,  ভূমিহীন ও আদিবাসীদের পানি, ভূমি ও বনজ সম্পদ এবং কারিগরি অর্থায়ন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সমবন্টন নিশ্চিতকরণে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

৩. প্রান্তিক জনগণের সংগঠনগুলোর পরিষেবা বৃদ্ধি, অন্যের হস্তক্ষেপ রোধ ও জনগণকে দৃঢ়কল্প হিসেবে গড়ে তোলা এবং তদারকি করা।

নারীর ক্ষমতায়নে ইকোফেমিনিসম এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯৫৮ সালে ক্যামেরুনের নারীদের নিয়ে সংগঠিত মাটি, পানি সুরক্ষা এবং বনাঞ্চলের নারী শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলন সর্বপ্রথম স্বীকৃত নারী দ্বারা সংগঠিত পরিবেশ আন্দোলন। কেনিয়ার বৃক্ষমাতাখ্যাত নারী পরিবেশ আন্দোলনকর্মী নোবেল জয়ী ওয়াঙ্গারী মাথাই তার গ্রীন বেল্ট মুভমেন্ট সংগঠনের দ্বারা প্রায় আড়াই কোটি বৃক্ষরোপণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ৭০-এর দশকে ভারতের উত্তরাখন্ডে নারী পরিবেশবাদী সুন্দরলাল বহুগুণা গাছ কাটা বন্ধে ও বন রক্ষার জন্য গাছকে জড়িয়ে ধরে এক পরিবেশ আন্দোলন শুরু করেন যা চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিত। নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানে গাছপালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ইথিওপিয়ায় নারীরা ৯৬ ভাগ অর্থ উপার্জন করেন রাবার ক্ষেতে কাজ করে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর বেশিরভাগ নারীর ৩-৪ মাসের মাসিক আয় কৃষি ফার্মে কাজ করে। বুরকিনা ফাসোর গংহো নামক পাহাড় গ্রামে এক ভিন্ন সামাজিক কাঠামো পরিলক্ষিত হয়। যেখানে পুরুষেরা গ্রামের ভূমি এবং সামাজিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে এবং নারীরা গ্রামের খাদ্য উৎস ও শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করেন। ভারতের নাগাল্যান্ড ও বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল এবং বিভিন্ন মাতৃতান্ত্রিক আদিবাসী গোষ্ঠীতে নারীদের কৃষি কাজে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। পাহাড়ে জুম চাষ নামক কৃষি বনায়নের মাধ্যমে এরা নিজেদের খাদ্য জোগাড় করে। বন থেকে খাবার, ফলমূল, মাশরুম, রাবার,  বনজ প্রাণী ও তাদের ডিম, দুধ এবং কৃষিজ পণ্য সংগ্রহ করে এসব নারী। আর পুরুষেরা শিকার ধরা ও মৎস্য শিকার করে তখন নারীরা বনের গাছপালা, ফলমূল ওষুধ সংগ্রহ করতে পারে। যেসব নারী বন থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে তাদের পরিবারের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য নির্বাচন ও স্বাস্থ্য ভালো রাখার সকল কিছুই জানা থাকে। সুতরাং বনায়ন শুধু নারীর ক্ষমতায়নই করে না, একটা গোষ্ঠীর শ্রমের জোগানও তারা দেয়।

কিন্তু নারীর এই ক্ষমতায়নে প্রধান বাধা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সংকীর্ণ মানসিকতা। অবশ্য বনের প্রতিকূল পরিবেশ নারীর জন্য প্রধান বাধা। ২০০৬ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ৩ বিলিয়ন মানুষ জ্বালানি কাঠের ওপর নির্ভর করে, যার সিকিভাগই নারীরা সংগ্রহ করেন। সান্ডারল্যান্ডের এক গবেষণা অনুযায়ী, অঞ্চলভেদে লিঙ্গবৈষম্য সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। একমাত্র আফ্রিকার দেশগুলোতেই নারীরা বনজ সম্পদ আহরণে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

লাতিন আমেরিকায় পুরুষদের অপ্রক্রিয়াজাত বনজ পণ্য সংগ্রহে অংশগ্রহণ বেশি। এশিয়ায় নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশগ্রহণ করে। পুরুষেরা মূলত বাণিজ্যিকভাবে চারা লাগানো, চাষাবাদ ও বেচাকেনা করে। আর নারীরা মূলত এসব দেখাশোনা এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ও শিশুদের খাদ্যের পুষ্টিমান দেখভাল করে। আমাদের দেশে নারীদের কৃষিতে অংশগ্রহণ কম এবং এটা ভালো চোখে দেখা হয় না। এজন্য নারীদের বাড়ির আঙ্গিনায় শাক-সবজি চাষ করতে দেখা গেলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদে তাদের অংশগ্রহণ কম। এমনকি চাষাবাদ পদ্ধতি  সম্পর্কে তাদের ধারণা কম।

এজন্য দরকার নারীদের সচেতন করা, তাদের উন্নত চাষাবাদ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, উন্নত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় বাজার সৃষ্টি ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সচেতন করা। অনেক দেশেই নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে কমিউনিটিভিত্তিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একটি দেশের উন্নয়ন শুধুমাত্র নারী বা পুরুষের দ্বারা সম্ভব না, দরকার নারী- পুরুষের সমান অংশগ্রহণ। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নারীর অংশগ্রহণ এবং নারীর ক্ষমতায়ন এখন সময়ের দাবি। বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক, সরকারি-বেসরকারি সবাইকে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে ।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকাটাইমস/২৬সেপ্টেম্বর/এসকেএস