পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস গাছ

প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:০২

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

সুন্দর পৃথিবীকে পরিবেশবান্ধব বাসযোগ্য রাখতে গাছের কোনো বিকল্প নেই। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের মোট ভূ-ভাগের প্রায় ২৫ ভাগ বনভূমি দরকার। গাছ মানুষের বন্ধু ও পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপকরণ। কিন্তু সব গাছ মানুষের জন্য উপকারী কিংবা পরিবেশবান্ধব নয়। মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে এমনই পরিবেশের জন্য একটি ক্ষতিকর গাছ ইউক্যালিপটাস। আমাদের জলবায়ুর জন্য ইউক্যালিপটাস গাছ মোটেই উপযোগী নয় উপরন্তু মাটি থেকে অতিমাত্রায় পানি শোষণ করে মারাত্মকভাবে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটায়।

ইউক্যালিপটাস মূলত একটি কাঠের গাছ যা প্রকৃতিগতভাবে অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে ডাকা হয় ইউক্যালিপটাস ওবলিকোয়া হিসেবে। যদিও ইউক্যালিপটাস গাছ আবহাওয়াগত অভিযোজন ক্ষমতার কারণে প্রায় সব মহাদেশেই দেখতে পাওয়া যায়। সারা বিশ্বে ইউক্যালিপটাসের প্রায় ৭০০ প্রজাতি আছে তবে পাপুয়া নিউ গিনি ও ইন্দোনেশিয়া, ভারত পর্যন্ত এর প্রাকৃতিকভাবে বিস্তার রয়েছে। আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের ৫০টারও বেশি দেশ তাদের দেশের বাণিজ্য ও শোভাবর্ধনের জন্য ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ করেছে।

আসবাবপত্র প্রস্তুতকারীরা ইউক্যালিপটাসের গাঢ় লাল ও গাঢ় হলুদাভ-বাদামি রংয়ের কাঠগুলোকে খুবই মূল্যবান মনে করে। সম্প্রতি, অস্ট্রেলিয়া থেকে ৪৫ লাখ টন ইউক্যালিপটাস কাঠের ফালি রপ্তানি করা হয়েছে, যার থেকে বছরে প্রায় ২৫ কোটি মার্কিন ডলার আয় হয়। ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে কিনো, তেল ও ট্যানিন পাওয়া যায়। ইউক্যালিপটাস গাছের তেলের অনেক ব্যবহার রয়েছে, বিশেষত অ্যান্টিসেপটিক ও পরিষ্কারক হিসেবে, মশা নিধনেও এই তেলের ভূমিকা রয়েছে। কাঠ হিসেবে এর রয়েছে ব্যবহার, বেশ সুদর্শন এর পাতা, মসৃণ কাণ্ড। এদের ফুল সৌন্দর্য বৃদ্ধি ছাড়াও বেশ স্বাদিষ্ট মধু প্রস্তুতে কাজে লাগে। বেশ কিছু ইউক্যালিপ্টাস এর প্রজাতিতে গাম নিঃসরণের কারণে এদেরকে গাম ট্রি হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইউক্যালিপটাস গাছে অধিক পরিমাণে তেল থাকায় এটা বেশ দাহ্য এবং এর আবাসভূমি অস্ট্রেলিয়াতে একে অগ্নি সৃষ্টিকারী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তাই আবাসিক এলাকায় বা ঘরবাড়ির কাছে এটাকে কম লাগানো হয়। তবে বড় বড় সড়কের ধারে সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো থাকে আর বসন্তে এর চমক লাগানো ফুল দেখে প্রায় চেনাই যায় না যে সারাবছর অনাড়ম্বর থাকা এই বৃক্ষটিকে।

ইউক্যালিপটাস গাছ আশপাশের প্রায় ১০ ফুট এলাকার ও ভূগর্ভের প্রায় ৫০ ফুট নিচের পানি শোষণ করে আকাশে উঠিয়ে দেয়। এই গাছ রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই পানি শোষণ করে বাতাসে ছাড়ে। এর ফলে মাটিতে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এই গাছের কাঠের গুণাগুণ তেমন ভালো নয়। এ গাছ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই গাছের আশপাশে অন্য প্রজাতির গাছ জন্মাতে পারে না। এ গাছ মাটিকে শুষ্ক করে ফলে মাটির ঊর্বরতা কমে যায়। আর ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে ফেললে মাটির ঊর্বরতা ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। ইউক্যালিপটাস গাছ বর্জন করা উচিত।

ইউক্যালিপটাস গাছের ফুল ও ফল ঝরে পড়লে সেখান থেকেও পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয় বলে কিছু কিছু পর্যবেক্ষণে উঠে এসছে। যেসব এলাকায় ইউক্যালিপটাস গাছ বেশি সেসব এলাকার মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বেশি বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ গাছের ফুল এবং এর পাপড়িগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে নাকি মানুষের শ্বাসনালীতে গিয়ে ঢুকে এবং দীর্ঘদিন এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে নাকি শ্বাসকষ্ট এবং হার্টের অসুখও হতে দেখা গেছে।

দ্রুতবর্ধনশীলতা এবং অভিযোজন ক্ষমতার কারণে এটি অনেক দেশেই কাঠের গাছ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যদিও উল্লেখ্য যে, এই ইউক্যালিপটাসের কোনো প্রজাতিই তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। এটা উষ্ণমণ্ডলীয় এবং উষ্ণ উভয় প্রকারের জলবায়ুর প্রদেশে বেঁচে থাকতে সক্ষম। ভারত, বাংলাদেশে ইউক্যালিপটাস গাছকে নীলগিরি বা নীলগিরি গাছ নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশেও বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। সারাদেশেই এখন ইউক্যালিপটাস গাছটি রোপণ করা হচ্ছে। তা অনেকদূর এগিয়েও গেছে। তবে মাটির গুণাগুণের কারণে এটি বর্তমানে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বেশি রোপণ করতে দেখা যাচ্ছে। রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া এসব অঞ্চলে ব্যাপক আকারে এ গাছ লাগানো হচ্ছে। বাংলাদেশের জলবায়ু, মাটি ও কৃষি জমিতো বটেই দ্রুত বর্ধনশীল এই গাছটি পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। সাধারণ মানুষের উপর একসময় ইউক্যালিপটাস চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছাড়াই।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, ইউক্যালিপটাসের পাতায় এক ধরনের অ্যান্টিসেপটিক থাকায় এর নিচে ছোট গাছ বাড়তে পারে না, মারা যায় পোকা-মাকড়। বাংলাদেশে যেখানে একসঙ্গে সব ধরনের ছোট-বড় গাছ, ফসল এবং জলাশয় রয়েছে সেই পরিবেশে ইউক্যালিপটাস গাছ মোটেই উপযোগী নয়। উদ্ভিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ইউক্যালিপটাস গাছকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কাজেই এ গাছের বিস্তার রোধ করা প্রয়োজন। নতুনভাবে যাতে আর এ গাছ সৃজন বা রোপণ না হয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। লাগানো গাছগুলোকে প্রতিস্থাপন করে দেশিজাতের পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা দরকার। সেজন্য ইউক্যালিপটাস গাছের চারা উৎপাদনের নার্সারি বন্ধ করতে হবে।

ফসল ও জীব-বৈচিত্র্য বিনষ্টের পাশাপশি ইউক্যালিপটাস গাছ পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ না করার জন্য জনসচেতনতার তাগিদ দিচ্ছেন পরিবেশবিদরা। তাছাড়া নার্সারিতে যাতে এ গাছের চারা উৎপাদন না করে তারও ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি ইউক্যালিপটাস গাছের উৎপাদন বন্ধ করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল খুবই পরিচিত আর এগুলো ইউক্যালিপটাস বনের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং বাংলাদেশে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

(ঢাকাটাইমস/২৭সেপ্টেম্বর/আরজেড/জেবি)