প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের চোখে বাবরি মসজিদ ধ্বংস

আন্তজার্তিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:০০
অযোধ্যায় ঢোকার মুখে লালকৃষ্ণ আদবাণীর রামরথ- ফাইল ফটো

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় অবস্থিত পাঁচশ বছরের পুরোনো বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। ২৭ বছর পর আজ এই ঘটনার মামলার রায় দিয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই এর বিশেষ আদালত। রায়ে আদালত জানিয়েছে, মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা পূর্বপরিকল্পতি ছিল না। এই হঠাৎ করেই ঘটেছিল। এই ঘটনায় আসামীদের কোনো দোষ না পাওয়ায় বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত।

২৭ বছর আগে ঘটা এই ঘটনার সময় অযোধ্যা ও লখনউয়ে হাজির ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক সঞ্জয় সিকদার। আনন্দবাজারে তিনি সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন। তার লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

কিছু একটা যে ঘটতে চলেছে, স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল আগের দিনই। ৫ ডিসেম্বর ১৯৯২ লখনউয়ের ঝাণ্ডেওয়ালা ময়দানে। গোটা ময়দানে করসেবক আর রামভক্তরা যেন ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি। টগবগিয়ে ফুটছেন। সেই ফোটানোর কাজটা শুরু হয়েছিল বারাণসী থেকে দ্বিতীয় দফার রামরথ যাত্রায়।

প্রথম দফার রথযাত্রায় লালকৃষ্ণ আদবাণীর সঙ্গী ছিলাম বিহারের ধানবাদ (এখন ঝাড়খণ্ড রাজ্যে) থেকে সমস্তিপুর পর্যন্ত। সেই সমস্তিপুর! ১৯৯০ সালের ২৩ অক্টোবর বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব যেখানে রামরথের গতিরোধ করে দিয়েছিলেন। গ্রেফতার করেছিলেন আদবাণীকে। সেবারের রথযাত্রায় উৎসাহ ছিল প্রবল। স্বতঃস্ফূর্ত কোলাহলও। তবে তেমন সংগঠিত চেহারা ছিল না। দ্বিতীয় দফার রথযাত্রায় কিন্তু শুরু থেকেই অনেক বেশি সংগঠিত চেহারা চোখে পড়েছিল। করসেবক ও রামভক্তদের ধীরে ধীরে ধীরে তাতিয়ে তোলার কাজটাও চলছিল সুকৌশলে। আদবাণী অবশ্য গোড়া থেকেই ঋষিসুলভ আচরণ করছিলেন। গোটা পথে ছোট-বড় সভায় একই সুরে এবং মোটামুটি একই বয়ানে বক্তৃতা করছিলেন তিনি।

রথ যত এগিয়েছে, ততই তেতে উঠেছেন করসেবক আর রামভক্তেরা। যে রামভক্তেরা আজমগড়ে বন্ধ চিনিকলের শ্রমিকদের মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। পুলিশের চোখের সামনেই! পুলিশ কোনো বাধাই দেয়নি! শ্রমিকদের ‘অপরাধ’— তারা পোস্টার নিয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। যে পোস্টারে লেখা— ‘পহলে মিল খোলো, ফির মন্দির বনাও’। পরদিন সকালে ওই ঘটনা সম্পর্কে যখন আদবাণীকে প্রশ্ন করি, তিনি খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গেই বলেন, ‘কই শুনিনি তো!’

আসলে আদবাণী তার শান্ত ভাবমূর্তি বজায় রেখেছিলেন। রামভক্তদের চাঙ্গা করার কাজ করছিলেন অন্য নেতারা। রামভক্তদের মিছিলের মধ্যে মিশে ছিলেন অনেক সংগঠক। সেই দলে নাকি ছিলেন বাছাই-করা স্বয়ংসেবক আর প্রচারকেরা। রামরথ যখন লখনউ পৌঁছল, রামভক্তদের নিনাদে আকাশ-বাতাস কাঁপছে। গোটা লখনউ শহরে অদ্ভুত এক স্তব্ধতা। মানুষের মনে কী হয়-কী হয় ভাব। সর্বত্র এক আলোচনা— ৬ ডিসেম্বর কী হবে।

‘কী হবে’ তা খানিক স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৫ তারিখে হিন্দি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছবিতে— করসেবকেরা অযোধ্যায় গাঁইতি-শাবল জড়ো করছেন।

আর ঝাণ্ডেওয়ালা ময়দানে? বাংলায় যাকে বলে ‘রাবড়ি পাক’। তলায় আগুন আর হাঁড়ির উপর হাওয়া দেওয়া। অনেক নেতাই তপ্ত বক্তৃতা করলেন। গোটা ময়দান উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। আর পাখার বাতাস দিলেন আদবাণী। যথারীতি শান্ত ভঙ্গিতে। যা ‘রাবড়ি পাকে’ একান্ত প্রয়োজনীয়।

৬ ডিসেম্বর সকালে অযোধ্যায় সাজ-সাজ রব। পুলিশে পুলিশে ছয়লাব। প্রশাসন ঘোষণা করল, করসেবকদের বাবরি মসজিদের কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হবে না। যথারীতি মসজিদ ঘিরে রেখেছিল অসংখ্য পুলিশ। হিন্দি বলয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় জানা ছিল, উত্তরপ্রদেশের পুলিশ ও ‘প্রভিন্সিয়াল আর্মড কনস্টেবুলারি’ (সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী) এর মধ্যে জাতপাত ও সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ যথেষ্ট। ফলে প্রশাসনের গোপন বরাভয়ে পুলিশ একটা লোকদেখানো ভূমিকাই পালন করেছিল। অচিরেই হাজার হাজার করসেবক বাবরি মসজিদে চড়ে বসলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল ষোড়শ শতকের প্রাচীন মসজিদ।

সেদিন দু’টি প্রশ্ন মনে জেগেছিল। প্রথমত, এত বড় একটা কাঠামো কয়েক ঘণ্টায় মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল অথচ তেমন কোনো আহত হওয়ার ঘটনা ঘটল না কেন? সংগঠিত পরিকল্পনা এবং নিপুণ দক্ষতা ছাড়া এটা কি সম্ভব? দ্বিতীয়ত, সত্যিই কি আদবাণী কিছুই জানতেন না? না কি তার বিষণ্ণতা ছিল সামগ্রিক পরিকল্পনারই অঙ্গ? উত্তর খুঁজে পাইনি। এখনও পাইনি।

৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকেই লখনউ শহরে ফিরতে শুরু করেছিলেন করসেবকদের অনেকে। বিশেষ করে নারী করসেবকেরা। অনেকেই উল্লাসে ফেটে পড়েছেন। আবার অনেকের চোখেমুখ সন্ত্রস্ত। যেন বুঝে উঠতে পারছেন না কাজটা ঠিক হল কি না। শহরে অনেক জায়গাতেই চলছিল লাড্ডু বিতরণ। সংখ্যালঘু এলাকাগুলো ভয়ে জড়োসড়ো। রাতে শুরু হয়েছিল গোলমাল। আমার গাড়ির চালক ছিলেন মুসলিম। তিনি সে রাতে বাড়ি ফিরতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাকে আমার সঙ্গেই রেখে দিয়েছিলাম।

পরদিন সাতসকালে পৌঁছেছিলাম উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহের সরকারি বাসভবনে। ততক্ষণে অবশ্য তিনি ‘প্রাক্তন’ হয়ে গিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশসহ চার বিজেপি শাসিত রাজ্যে জারি হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসন। গেরুয়া পাঞ্জাবি ও ধুতি পরিহিত কল্যাণ স্বাগত জানালেন হাসিমুখে। তার নির্দেশে টেবিলে রাখা হল লাড্ডুর থালি। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় হোঁচট খাচ্ছিলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মাঝেমধ্যেই একটা চিরকুট বার করে দেখছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, কোন প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন আগে থেকে ঠিক করে লিখে রেখেছেন। তবে তার একটা কথা আজও মনে আছে— ‘গ্যাস ভরতে গ্যয়া....গ্যাস ভরতে গ্যয়া। ওহ্ তো একদিন ফাটনা হি থা’।

কল্যাণ বলেননি, ‘গ্যাস’টা ভরেছিল কারা। সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও মেলেনি।

ঢাকা টাইমস/৩০সেপ্টেম্বর/একে

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

দুই নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যার পর বালিচাপা দিলো ইসরায়েলি সেনারা 

গাজায় যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে আইসিসির প্রতি আহ্বান

কলকাতা বিমানবন্দরে চলল গুলি, নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যু

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়ে হুমকি পেলেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ

মস্কোতে কনসার্টে হামলা: এখনো প্রায় ১০০ জন নিখোঁজ 

বাবা কোটিপতি, ২০ বছর ধরে জানতই না ছেলে!

গাজা যুদ্ধের ১৭৩তম দিন, প্রাণহানি বেড়ে সাড়ে ৩২ হাজার

মস্কোতে সন্ত্রাসী হামলা: ফের মৃত্যুদণ্ড চালুর আহ্বান রুশ আইনপ্রণেতাদের

দশ বছরে ৬৪ হাজার অভিবাসীর মৃত্যু, বেশিরভাগই সাগরে ডুবে: জাতিসংঘ

৩০ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে মিয়ানমার সীমান্তে বেড়া দেবে ভারত

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :