ভোক্তার সঙ্গে পণ্য প্রতারণা চলছেই

প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৫৭ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২০, ১০:৩১

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস

মহামারীর মধ্যেও পণ্য কিনে প্রতারণা থেমে নেই। গত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাত মাসে প্রতারিত ক্রেতারা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে প্রায় ছয় হাজার অভিযোগ করেছেন। পণ্যের মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, মূল্য তালিকার সঙ্গে বিক্রয় রশিদের গরমিল, মেয়াদত্তীর্ণ ওষুধ ও পণ্য, নকল পণ্য এবং ওজনে কারচুপিসহ আনা এসব অভিযোগের অধিকাংশই নিষ্পত্তি হয়েছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৭১৩টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৬২৫টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে দুই হাজার ৮৮টি অভিযোগ।

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যৌক্তিক মূল্যে বিক্রয় হচ্ছে কি-না তা মনিটরিং করে আসছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এছাড়া পণ্যের মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, মূল্য তালিকার সঙ্গে বিক্রয় রশিদের গরমিল, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ও পণ্য, নকল পণ্য এবং ওজনে কারচুপিসহ ভোক্তাস্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন অপরাধে সারাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়।

কোনও ভোক্তা পণ্য কিনে প্রতারিত হলে তিনি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানা হিসেবে আদায়কৃত টাকার ২৫ শতাংশ দেয়া হয় অভিযোগকারীকে। গত ১১ বছরে ভোক্তারা পেয়েছেন জরিমানার এক কোটি নয় লাখ ৯৩ হাজার ৯২৭ টাকা। আর সরকারি কোষাগারে ৬৩ কোটি ৪৮ লাখ ১৫ হাজার ৭২৩ টাকা জরিমানার টাকা জমা দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

এদিকে চলতি বছরের অর্থবছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার অভিযান পরিচালনা করেছে ৩ হাজার ৭৪৭টি। এসব অভিযানে নানা অনিয়মের জন্য দণ্ডিত হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৬টি প্রতিষ্ঠান। আর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে জরিমানা আদায় হয়েছে দুই কোটি ২৪ লাখ ২৮ হাজার ২০০ টাকা।

চলতি অর্থ বছরে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর ভোক্তাদের থেকে মোট দুই হাজার ১২৫ অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ এক হাজার ৩৪৯ অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১২৮টি। আদায়কৃত জরিমানার পরিমাণ নয় লাখ ৬৪ হাজার ৩০০ টাকা। নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ৭৭৬টি অভিযোগ।

ভোক্তাদের সরাসরি অভিযোগ আর বাজার অভিযানে দণ্ডিত প্রতিষ্ঠান থেকে সব মিলিয়ে চলতি অর্থ বছরে দুই কোটি ৩৩ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এর মধ্যে অভিযোগকারীদের দেয়া হয়েছে দুই লাখ ৪১ হাজার ৭৫ টাকা। ১১৮ জন ভোক্তা ২৫ শতাংশ হিসেবে জরিমানার এই অর্থ পান। এর বাইরে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়েছে দুই কোটি ৩১ লাখ ৫১ হাজার ৪২৫ টাকা।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার অভিযান করেছে ৩৫ হাজার ৩টি। বাজার অভিযানের মাধ্যমে ৮৫ হাজার ৪৪৭টি প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম পাওয়ায় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন হারে জরিমানা আদায় করা হয়। এর পরিমাণ ৬০ কোটি ১৪ লাখ ৪৬ হাজার ৯৪২ টাকা। আর ভোক্তাদের কাছ থেকে পাওয়া ৩৫ হাজার ৯৯টি অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া ৩২ হাজার ৪৫৮টি অভিযোগে দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৩৮টি। আদায়কৃত জরিমানার পরিমাণ চার কোটি ৪৬ লাখ ৩২ হাজার ২০৮ টাকা।

২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণীত হয়। ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল বাজার তদারকির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠ পর্যায়ে আইনটির বাস্তবায়ন শুরু করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যাত্রা শুরুর পর থেকে মোড়কের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের খুচরা বিক্রয় মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি লেখা না থাকা, পণ্য ও সেবা মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করা, নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্য দাবি করার কারণে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আসছে।

এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি জরিমানা করা হয়েছে অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন করা প্রতিষ্ঠানকে। এই ধরনের মোট ২৩ হাজার ৬৯৪ প্রতিষ্ঠানকে ২০ কোটি ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৬৯০ টাকা জরিমানা করা হয়। আর মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করায় ১৩ হাজার ৭২৫ প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৩৬ লাখ ২১ হাজার ৮৫০ টাকা এবং সেবার মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করায় ৩৯৪ প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৭৫০ টাকা জরিমানা গুণতে হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোক্তারা সচেতন হওয়ায় অভিযোগ বাড়ছে। প্রতারক ব্যবসায়ীকে যে জরিমানা করা হয়, তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তা পায় বলে অনেকে এক্ষেত্রে উৎসাহিত হয়ে অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে আরও উৎসাহিত হচ্ছে। কোনও ব্যবসায়ী ভোক্তাকে ঠকালে শুধু শাস্তিই পাবেন না, বরং ভোক্তাও অভিযোগ করে আর্থিকভাবে লাভবান হবেন, এমন আইনের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

ভোক্তাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখা ও প্রমাণিত হলে জরিমানা করাসহ বর্তমানে বাজার তদারকি চলছে জানিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা ঢাকা টাইমসকে বলেন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের সকল ব্যবসায়ীকে অবশ্যই চাল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের রসিদ এবং মূল্য তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে হবে।

বাবলু কুমার সাহা বলেন, ‘বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জামাদির মূল্য ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে নিয়মিত অভিযান চলছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল ও সহনীয় রাখতে ঢাকাসহ সারাদেশে অধিদপ্তরের তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকবে।’

 

যেভাবে অভিযোগ করা যায়

 

কোনও ভোক্তা বা অভিযোগকারী তার পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা ও মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল নম্বর (যদি থাকে) এবং পেশা উল্লেখ করে কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য সম্পর্কে কোনো পণ্যের উৎপাদনকারী, প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী বা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ই-মেইল, ফ্যাক্স বা অন্য কোনো উপায়ে লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।

দায়েরকৃত আমলযোগ্য তদন্তে প্রমাণিত ও জরিমানা আরোপ করা হলে আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগকারীকে প্রদান করা হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ০১৭৭৭৭৫৪৬৬৮ নম্বরে যোগাযোগ করা যায়।

পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা হলে ৩৭ ধারায় এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করা হলে ৩৮ ধারায় এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। এ ছাড়া আরও অনেক ধারা রয়েছে।

ভোক্তা হিসেবে কারও কোনও অভিযোগ থাকলে অভিযোগ তদন্ত করে প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে আছে জরিমানা বা কারাদণ্ডের বিধান। এক বছর থেকে তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি রাখা আছে বিধানে। এর বিকল্প হিসেবে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যায়। দণ্ডিত ব্যক্তি আবার একই অপরাধ করলে সর্বোচ্চ পরিমাণের দ্বিগুণ দণ্ডের বিধান আছে।

ঢাকাটাইমস/১অক্টোবর/জেআর