ডিআইজি হাবিবের অনন্য উদ্যোগে বদলে গেছে থানার সেবা
প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২০, ১৭:১১ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২০, ২৩:০৮
গ্রামীণ ব্যাংক কেরানীগঞ্জ বাস্তা শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার জাহিদুল ইসলাম। চলতি মাসের ২৫ তারিখে ব্যাগসহ অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র হারিয়ে ফেলেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
থানার কর্মকর্তাদের ব্যবহার ও সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহিদুল বলেন, ‘ব্যাগ হারিয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। কেরানীগঞ্জ থানায় গিয়ে বলি, আমি জিডি করতে চাই। একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব আন্তরিকভাবে আমার কথা শোনেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে জিডি লিখে দেন। এমনকি ওই সময় সেখানে লোক না থাকার কারণে আমাকে নাস্তা খাওয়াতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। বিষয়টি আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে।’
এমন ইতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা এখন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের আওতাধীন প্রত্যেক থানা এলাকার মানুষের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে। যারা সেবার জন্য থানা-পুলিশের দারস্থ হয়েছিলেন। কাঙ্ক্ষিত সেবা পেয়েছেন।
সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হোক বা মামলা, টাকা না দিলে কাজ হয় না। তদন্ত কর্মকর্তাকে ঘুষ না দিলে এগোয় না তদন্ত। উপরন্তু অযাচিত নানা প্রশ্নবানে হতে হয় জেরবার। পুলিশ সম্পর্কে ভুক্তভোগীদের চিরাচরিত এমন মন্তব্য আমূল বদলে গেছে ঢাকা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায়। পুলিশি সেবাকে জনবান্ধব, হয়রানি ও দুর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান `বেস্ট প্র্যাকটিস’ নামে এ উদ্যোগ সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করছেন। যার সুফল পাচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশী মানুষ।
এর ইতিবাচক দিক বিবেচনায় সারাদেশে এই `বেস্ট প্র্যাকটিস’ মডেল অনুসরণের তাগিদ এসেছে। ইতোমধ্যে ডিএমপিসহ সব মেট্রোপলিটন পুলিশ, বিভাগীয় পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশকে এই সেবা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
১৮৬১ সালে পুলিশ আইনে প্রতিষ্ঠিত এই বাহিনীতে এ ধরনের উদ্যোগ এটাই প্রথম বলে জানা যায়। এই মডেল সেবার সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুজ্জামান। তিনি সবিস্তারে জানালেন এই উদ্যোগের বিষয়টি।
আসাদুজ্জামান জানান, ব্যতিক্রমধর্মী এ সেবা বাস্তবায়নের শুরুতে ঢাকা বিভাগের ৪৩ জন সার্কেল এসপিকে নিয়ে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। এরপর শুরু হয় নতুন এই সেবা বাস্তবায়নের কাজ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা রেঞ্জের থানাগুলোতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নথিভুক্ত হওয়া সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার কার্যক্রম শুরুর আগেই অর্থাৎ সকাল ৯টার মধ্যে সার্কেল অফিসে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। বর্তমানে দুটি থানা মিলিয়ে একটি সার্কেল অফিস। সকাল ৯টার মধ্যে অবশ্যই সার্কেল অফিসে নথি পৌঁছাতে হয়। প্রত্যেক সার্কেল অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বাধ্যবাধকতা রয়েছে প্রতিটি সাধারণ ডায়েরি, মামলার কপি তাকে পড়তে হবে। তিনি খতিয়ে দেখবেন কোন জিডি বা মামলা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপযুক্ত।
এরপর গুরুত্বপূর্ণ জিডি ও মামলার কপি অভিযোগকারীর মোবাইল নম্বরসহ নির্দিষ্ট ছক পূরণ করে বেলা ১১টার মধ্যে তিনি বিভাগীয় প্রধানের (ডিআইজি) অফিসে পাঠিয়ে দেন। ডিআইজি অফিস থেকে শুরু হয় তদারকি। ডিআইজি অফিসের তদারকি সেল সাধারণ ডায়েরি বা মামলার বাদীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে থানার সেবার মান সম্পর্কে জানতে চান।
এসময় আরো জানতে চাওয়া হয়, সাধারণ ডায়েরি বা মামলা করতে কোনো টাকা নেয়া হয়েছে কিনা? সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হয়েছে? দীর্ঘ সময় ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে কিনা? মামলা বা জিডির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তদন্ত করতে এসেছিলেন কিনা? তদন্ত করতে এসে কোনো ধরনের খরচের টাকা নিয়েছেন কিনা? মামলার প্রয়োজনে কোনও ধরনের কাগজ বের করা বা তৈরি করার জন্য টাকা চেয়েছেন কিনা? তিনি যে কারণে জিডি করেছেন সেই সেবাটি তিনি পেয়েছেন কিনা?
এমন বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। সাধারণ ডায়েরি বা মামলার বাদির কাছ থেকে যদি কোনও একটি প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ আসে এবং অভিযোগ গুরুতর হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে রেঞ্জ অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারকে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এই কঠোর পর্যবেক্ষণ ও তদাকির ফলে মামলার বাদি বা জিডি করতে আসা ব্যক্তির কাছ থেকে কোনও টাকা-পয়সা সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা নিতে পারেন না। সেবাও দেওয়া হয় দ্রুত। ভালো ব্যবহার পান ভুক্তভোগীরা। এ উদ্যোগের ফলে ঢাকা রেঞ্জের মধ্যে মামলা বা জিডির ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন প্রায় ৯৫ ভাগ কমে গেছে।
অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে থানার পুলিশ সদস্যরা কেমন ব্যবহার করছেন এখন আমরা সেই বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনো সেবাগ্রহীতা থানায় এলে তাকে সালাম দিয়ে তার সমস্যা জানতে চাইতে হবে। তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে হবে।’
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘জিডি বা মামলা দায়ের হওয়ার পর একবার তদরকি করা হয়। এরপর ১৫ দিন বা এক মাস পরে ওই মামলার অগ্রগতির বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হয়। তখনও যদি কোনও ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ ডায়েরি, মামলা, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার বা রিমান্ডপ্রাপ্ত আসামির কাছ থেকে নির্যাতনের নামে অর্থ আদায় হয় কিনা। ডিবি পুলিশের হাতে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার, মোবাইল কোর্টসহ যেকোনও গ্রেপ্তারের বিষয়ে নির্ধারিত ছক মেনে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যা পুলিশ সুপার কার্যালয় ও রেঞ্জ অফিসের মাধ্যমে তদারকি করা হয়।
অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, ‘আরও একটি গুরুতর অভিযোগ আছে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সেবা পেতে টাকা দিতে হয়। আমরা এটা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছি। একজন আবেদনকারী যখন পাসপোর্টের আবেদন বা পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদন করবেন তখন এটি পুলিশের আওতায় আসার পরে একটি সার্ভারে এন্ট্রি দেয়া হয়। এরপর সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সেবাগ্রহীতার কাছে এসএমএস চলে যাবে। সেবাপ্রত্যাশীর কাছে যে এসএমএস যাবে সেখানে তদন্তকারী কর্মকর্তার নাম ও মোবাইল নম্বর দেয়া হবে। আর তদন্তকারী কর্মকর্তা যে এসএমএস পাবেন সেখানে সেবাগ্রহীতার ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর থাকবে।’
এক্ষেত্রেও সেবাগ্রহীতার কাছে জানতে চাওয়া হবে সেবাটি পেতে তার কোনও টাকা খরচ করতে হয়েছে কিনা? অথবা টাকা না দেওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে ভুল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে কিনা? জরুরি পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য তিন দিন ও সাধারণ পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য সাত দিন সময় দেওয়া হয়ে থাকে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে সেবাপ্রত্যাশী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে এসএমএস দেওয়া হয়। সেবাপ্রত্যাশীর ভেরিফিকেশন শেষ হলে এসএমএস দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয় কখন কোথা থেকে তিনি পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট গ্রহণ করবেন।
ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, বর্তমান সময়ের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যায় মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে। গ্রাহকের মোবাইল থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এটি নিয়েও কাজ করছে ঢাকা রেঞ্জ পুলিশ।
অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুজ্জামান জানান, ঢাকার প্রত্যেক সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অথবা সহকারী পুলিশ সুপারদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জের প্রতিটি থানার ওসিকে তার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের নাম, পরিচয় ও যোগাযোগের ঠিকানা রাখতে হবে। পাশাপাশি তাদের সবাইকে নিয়ে মাসে একবার আলোচনা সভা করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ব্যাংকের ম্যানেজারদের সঙ্গে আলোচনা সভা করতে হবে। প্রতিদিন রাতে টহল গাড়িকে এলাকার ভেতরের ব্যাংকের বুথের নিরাপত্তা ও বুথের দায়িত্বে থাকা প্রহরীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ উদ্যোগের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মুজিববর্ষে আমাদের অঙ্গিকার হচ্ছে, পুলিশ হবে জনতার। তারই অংশ হিসেবে আমরা কাজ করছি। জনবান্ধব পুলিশিং শুরু করেছি। পুলিশ জনগণের বন্ধু, আমরা এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করছি। থানায় সেবা নিতে এসে মানুষ যে ভোগান্তিতে পড়ে, আমরা তা বন্ধ করতে চাই। মানুষ ইতোমধ্যে এর সুফল পাচ্ছে।’
ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এই সেবাটি মডেল হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি মহোদয় দেশের সব থানাকে এই সেবা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমানে ঢাকা বিভাগের সব থানায় এই সেবা কার্যক্রম চলছে। সেবাপ্রত্যাশী মানুষ এখন পুলিশের কাছে আসতে ভয় পায় না। এটাই আমাদের অর্জন। মানুষ পুলিশকে ভয় পাবে না; বরং বন্ধু ভাববে। যে কোনো সমস্যায় পুলিশের সঙ্গে অবলীলায় যোগাযোগ করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
(ঢাকাটাইমস/০১ অক্টোবর/কেআর/এইচএফ)