রোজেনার মনের কথা
হে তাবৎ দুনিয়ার নির্বান্ধব পান্থ মনের গোপন কথার অমূল্য হীরে নিরাপদে রাখবার যোগ্য আয়রন সেফের সন্ধান পাওনি যারা, খুঁজে পাওনি নরসুন্দরের মতো যুগান্তরের পরীক্ষিত কোন বিশ্বস্ত বান্ধবকে।
কিংবা এমন কোনো ব্যাংকার যারা দু’টাকার বলপেন ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রাখে না; খুইয়ে যাবার বখিল আশংকায়। মনের কষ্টিপাথরে কষ্টের খাঁটিত্ব পরখ করতে করতে আয়ুর পীড়নে পিষ্ট হয়ে যারা গুনেগুনে দিন পার করো একান্তে-জনান্তিকে।
উচাটন মনের পাটাতনে দৃঢ়পদে আরেকবার দাঁড়াও শোনো! কান পাত! শোণিতের স্পন্দনের মতো অখণ্ড মনযোগে শোন। আমি আজ তোমাদেরই কথা বলতে এসেছি, আজ আর কোনো পদদলিত প্রসন্ন প্রসূণের কথা বলব না।
কিংবা পরাজিত পারিজাতের বিলাপের ঝাঁপি খুলে অশ্রুধারাকে তুলনা করব না ঝর্ণাধারার সঙ্গে। আদি প্রেম ক্যামন করে শ্বাপদের নগ্ন ঈর্ষার শিকার হল মিলনের উষ্ণ প্রশ্রবণ ক্যামন করে বিরহের হিমাচলে বিলীন হল সে-সবের কিছুই বলব না আজ।
শূন্যে সৌধের বিনির্মাণ কল্পনা রঙে আল্পনা আঁকা সাতরঙা রামধনু বসন্তের কোকিলের কুহু পেখমতোলা পুচ্ছ নাচানো ময়ূরের কেকা নদী কিংবা নারী এসবের কিছুই বলব না আজ।
রূপ নারানের কূল, আলেয়ার হোলিখেলা জোনাকির কামার্ত আহ্বানের আলো, শ্যামের জাদুর বাঁশি জোৎস্না-সাগরের রূপালি ঢেউ পরগাছা আলোকলতা পদ্মার ইলিশের পেটে থাকা ডিমের সম্ভাবনা আলীর দুধারি জুলফিকার কিংবা কিং আর্থারের দৈবশক্তিধর এক্সকেলিবার বেহেস্তের হুর নরকের কীট এসবের কোন কিছুই আজ আমার উপজীব্য নয়।
নিদেন পক্ষে বলতে পারি রোজেনার মনের কথার শেষ পরিণতি আলতাপরা আলতো পায়ের সাবধানি পথচলা ঢাকাই শাড়িপরা বধূর লাজ রাজপুত্তর আর রাজকন্যার আবীর গুলাল পংখিরাজ ঘোড়া ময়ুরপংখি নায়ের আবর্তে আবদ্ধ
কোনোদিনও শেষ না হওয়া দাদির কষ্টকল্পিত গল্প চড়ুইভাতির কোলাহল নূপুরের নিক্কন উঠোন জোড়া পায়রা দলের বাকুম-বাক বৈশাখি মেলার হাওয়াই মিঠাই মুড়কি মুড়ি, রেশমি চুরির পসরা পুতুল নাচের মুদ্রা, বায়োস্কোপ, গাজির পট ডিঙ্গি নায়ের দোল, পাতার বাঁশির শিস।
আর আকাশে আকাশে রঙিন ঘুড়ির স্বপ্ন বিলানোর গল্প। আমি আরেকবার মনে করিয়ে দিতে এসেছি সেই বাণি চিরন্তনী- "মনের গোপন কথার বিশ্বস্ত অংশিজন একমাত্র কবি" জানি, তাও তর্কাতীত নয়।
রোজেনাও তার মনের গোপন কথা বলেছিল কেবলমাত্র একজন কবিকেই। আর তিনি-ই কিনা রাষ্ট্র করে বেড়ালেন সেই বার্তা। তারপরের কাহিনী আরো করুণ। সে কথার বীজ থেকে অংকুরিত হলো আরো দু’চারটে কল্পকথা যেন উদ্গত কচিপাতা।
এরপর যত দিন যায়, কথা আরো বাড়ে পাতায় পাতায় পল্লবিত যেন সুবিশাল বিটপী; তবে ফলবতি হল না আখেরে। কবির মন্তব্য হতে পারে নির্মোহ তবে সে পাথুরে প্রকাশ ছিল বড়ই নির্দয়!
‘ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা, সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে কবিতা বোঝে না।’
কী অবুঝের সমীকরণ? কলিজা ছিন্নভিন্ন করা এ ঘোর অপবাদ গনগনে ক্ষতের মতো বুকের পাঁজরে পুষে রাখে রোজেনা খণির গহন গুহায় যেমন মাটিচাপা পড়ে থাকে মণির মহিমা।
সেই থেকে রোজেনাকে পেয়ে বসে কবি-আতংকে। আকাশে বাতাসে রোজেনা ছড়িয়ে দেয় এই প্রচারণা; ‘কবিকে বলো না মনের গোপন কথা। কবিরা শূন্য থেকে লতিয়ে তুলতে পারে কবিতা-কল্পনা-লতা। চোখের কোণে বেদনার এক কণা অশ্রু দেখেই কবি হাবুডুবু খায় উত্তাল সাগরের ঊর্মিমালায়; একেই বোধ করি তেনারা নাম দিয়েছেন বিন্দুতে সিন্ধুর আকুলতা। তাই, কবিকে বলো না মনের গোপন কথা।
যা নেই তা নিয়ে, ইনিয়ে বিনিয়ে বানিয়ে বানিয়ে বলা; কবির শিল্পকলা। বুননে বুননে বিলাপের ব্যঞ্জনা জড়িয়ে; শ্যামল মাঠের মায়ার আবহে কবিরা বিছিয়ে দেয় বাহারি নকশি কাঁথা; তাই, কবিকে বলো না মনের গোপন কথা।’
এভাবেই দিন যায় দিন আসে পার হয় কত বসন্ত! জানি না কোন চৈত্রের শেষ প্রান্তে এসে রোজেনার মনের জনালায় কবিতারা উঁকি দেয়। যে মাঠে ফলে না উদরের দানা; মেলে না যকৃতের উপশম; কেবল বোনা যায় স্বপ্নের বীজ; সেই মাঠ হৃদয়ের নন্দ-কানন।
সেই নকশি কাঁথার মাঠেই রোজেনার এক্কা-দোক্কা খেলা চলে। ভাবান্তরের উষ্ণ আবেশে রোজেনা লালন করে চিরায়ত বোধঃ ‘ছিন্নমূল আশালতার প্রাণ সঞ্চার করে কবিতা বুকের চৌচির চাঁতালে মমতার জলসিঞ্চন করে কবিতা।
হাল ভাঙ্গা মাঝির কূল হয় কবিতা; ঢেউয়ের দোলায় দোল-খাওয়া ভেলা হয় কবিতা। কবিতার খড়কুঁটো জড়ো করে ঝড়-ভাঙ্গা নীড় বাঁধে ডানাভাঙ্গা পাখি বিরহের অশ্রুকণা গড়িয়ে গড়িয়ে পেয়ে যায় কাঙ্খার সীমানা।’
রোজেনার ঘুম ভাঙে, দুঃস্বপ্নের কাকতাড়ুয়াকে তাড়া করে লালঝুঁটি কাকাতুয়া। রোজেনার কন্ঠ চড়ে তারার স্বরে কবিতার মূর্ছনায় দিগন্তে ছড়িয়ে দেয় মর্মের দ্যোতনাঃ ‘কেবল কবিকেই বলা যায় মনের গোপন কথা, কবিরা করে না বিশ্বস্ততার অন্যথা।
দৃষ্টির সত্য নয় বস্তুর সত্য নয় ঘটনার সত্য নয় ইন্দ্রিয়ের সত্য নয়; কবির সত্য বোধে কবির সত্য ভাবে কবির সত্য প্রকাশে। এ সত্য সৃজনের এ সত্য শিল্পের কেবলই শৈল্পিক সত্যের।’