এক বিচিত্র সামাজিক অবস্থায় বাস করছি আমরা

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২০, ১২:৪৮

লীনা পারভীন

আজকে আমি আমার নিরাপত্তার জন্য শংকিত। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র আজকে আমার মতো কোটি নারীর নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সদ্য জন্ম নেয়া কন্যা শিশু থেকে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ নারীটিও। না। একদম অবাস্তব কথা বলছি না। নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নেই। না ঘরে, না উপাসনালয়ে, না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। পিতা কর্তৃক কন্যা ধর্ষণ, ধর্মযাজকের হাতে নারী উপাসনাকারী ধর্ষণ, বিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ চলছে। গোটা দেশে চলছে ধর্ষণের উৎসব।

একজন নারীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে আনন্দ-উল্লাসের সাথে সেই নারীর যৌনাঙ্গে হাত ঢুকানো, লাঠি ঢুকানোর মতো নিষ্ঠুর নির্যাতনও চলছে। সেই আনন্দের ক্ষণকে স্মরণীয় করতে ক্ষমতাবান পুরুষরা আবার ভিডিও করে রাখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার লোভে সেসব ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে।

একজন নির্যাতিত নারীর চিৎকারের শব্দ পৌঁছায়নি এলাকাবাসী থেকে পুলিশ কারও কানেই। এ এক বিচিত্র সামাজিক অবস্থায় বাস করছি আমরা। নারীকে মনে করা হচ্ছে অতি সস্তা এক দ্রব্য।

দেশে কিছু আইন আছে। একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় আছে, কিছু দায়িত্ববান ব্যক্তি আছেন। আমরা আসলেই জানি না তারা কেন আছেন বা কী তাদের ভূমিকা। কোথায় তারা ব্যস্ত আছেন, কী তাদের প্রায়োরিটি। থানায় থানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ কী? এলাকায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সেই খবর কেন তাদের কাছে পৌঁছায় না? পুলিশের সোর্সগুলো কি সব অচল?

৩২ দিনের মধ্যে তাহলে কেউই জানতে পারেনি এই ঘটনা? নাকি জেনেও চুপ ছিল? যদি না জেনে থাকে তাহলে কেন জানতে ব্যর্থ হলো স্থানীয় পুলিশ? কেন অপরাধীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হলো না? সংবাদে জানা যায়, ঘটনার পরই নির্যাতিত নারী একলাশপুর ইউনিয়নের কর্তাব্যক্তিদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। ঘটনা কারা ঘটিয়েছে সেটিও জানেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। হাস্যকর হলেও সত্য যে তিনিও এই ঘটনাকে বর্বর বলেছেন এবং বিচার চেয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন করতেই হয় যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিসেবে তিনি কী ভূমিকা পালন করেছিলেন ঘটনা জানার পর? কেন তিনি আইনী ব্যবস্থা নেননি?

এমন হাজারো প্রশ্ন করা যায় কিন্তু জানি করেও লাভ আসবে না। যতগুলো ঘটনায় অপরাধীরা ধরা পড়েছে তার বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হওয়ার পর। অর্থাৎ মানুষ না জানলে সেটি আর অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে না। কিন্তু কেন? বাংলাদেশ একটি সভ্য রাষ্ট্র। এর সংবিধান আছে, আইন আছে, প্রশাসন আছে। আছে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা। কারণ এ দেশটির মালিক জনগণ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সবকিছু মালিক এই জনগণ যার অর্ধেক হচ্ছে নারী। অথচ এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অবহেলা করেই এগিয়ে চলতে চাইছে বাংলাদেশের আইন ও প্রশাসন।

অপরাধের মাত্রা আজ এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে সেটিকে আবার ভিডিও করে ছেড়ে দেয়ার মতো সাহস দেখাচ্ছে অপরাধীরা।

এই ঘটনাকে কতটা যৌক্তিক মনে করছেন আমাদের কর্তারা? আমি তো মনে করি এটি সমস্ত প্রশাসনের প্রতি এক প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জ। অপরাধীরা দেখিয়ে দিতে চাইছে, দেখো, আজ আমরা কতটা সাহসী। তোমাদের কাউকেই আমরা ভয় পাই না। আমাদের রাজ্যে আমরাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করি। তোমাদের কারও কিছু করার ক্ষমতা নেই। এলাকায় এলাকায় গ্যাং, বাহিনী গড়ে তুলে গোটা দেশকে তারা সন্ত্রাসের রাজ্য বানিয়ে ফেলতে চাইছে।

এমন ঘটনায় যদি দেশ জেগে না উঠে তাহলে বুঝতে হবে এ রাষ্ট্র, এ প্রশাসন এদেশের নারীদেরকে অপাঙক্তেয় ভাবছে। নারীর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে চাইছে তারা। আমার সাংবিধানিক অধিকারকে যারা অস্বীকার করে আমিও তাদেরকে অস্বীকার করতে চাই। জবাবদিহিতাকে নিশ্চিত না করতে পারলে কোনো প্রশাসনই ঠিকমতো কাজ করবে না। আজ একলাশপুরের আমার সেই বোনটি উলঙ্গ নয় কেবল, উলঙ্গ হয়েছি আমি-আপনি সকলে, গোটা বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে বাঁচাবে কে?

লেখক: কলামিস্ট

ঢাকাটাইমস/৬অক্টোবর/এসকেএস