অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে ৬০ কোটি টাকার সরকারি যন্ত্রপাতি

জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া, সুনামগঞ্জ
| আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৩৭ | প্রকাশিত : ১২ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৫৯

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা সীমান্তে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন টেকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের কাজ প্রায় দুই যুগ ধরে বন্ধ আছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকায় নষ্ট হচ্ছে ওই প্রকল্পের প্রায় ৬০ কোটি টাকার এসব যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রাংশের বেশিরভাগই এখন অকেজো হয়ে গেছে।

উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের মেঘালয় সীমান্ত এলাকা ঘেষে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের অবস্থান। বন্ধ হওয়ার পর ইতোমধ্যে চুরি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকার বৈদ্যুতিক তার, রেললাইনসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এছাড়া কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় স্থানীয় প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট প্রকল্প এলাকার জমি ও এ প্রকল্পের নির্মিত আটটি ভবন দখল করে নিয়েছেন।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দেশের সিমেন্টের চাহিদা পূরণ করতে ১৯৪০ সালে সুরমা নদীর তীরে ছাতকে প্রতিষ্ঠা করা হয় আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরি (বর্তমানে যা ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি)। তখন ভারত থেকে চুনাপাথর আমদানি করা হতো। নিজস্ব ব্যবস্থায় চুনাপাথর উত্তোলনের জন্য ১৯৬১ সালে ভূ-তত্ত্ব জরিপ চালিয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের ভাঙ্গারঘাট ও সীমান্তবর্তী টেকেরঘাটে পাঁচটি কূপ খনিতে প্রায় ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৫৬ হাজার ৫৩৪ মেট্রিক টন চুনাপাথর মজুদ থাকার বিষয় নিশ্চিত হয়। ১৯৬৫ থেকে ’৬৬ সাল পর্যন্ত টেকেরঘাট খনিজ প্রকল্পের ৩২৭ একর জায়গার মধ্যে চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে ৭০ দশমিক ৬৯ একর এবং ৯২ দশমিক ২৫ একর এলাকায় দুটি কোয়ারিতে প্রথম চুনাপাথর উত্তোলন কাজ শুরু করে লাভের মুখ দেখে। এরপর একাধারে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মাত্র ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮৩ মেট্রিক টন চুনাপাথর উত্তোলন করা হয়।

তবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিক সংগঠনের কিছু স্বার্থান্বেষী লোকজনের কারণে প্রকল্পটি হঠাৎ করে লোকসানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। পরে বিসিআইসির প্রতিষ্ঠান ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির অধীনে স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৯৯৬ সালের দিকে খনিজ প্রকল্পটিকে বন্ধ করে দিলে প্রায় ৪০০ শ্রমিক-কর্মচারীকে বিসিআইসির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বদলি করা হয়। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ২ অক্টোবর ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ৩১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করা হলে প্রকল্পটির কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এখানে ৬০ কোটির বেশি টাকার যন্ত্রপাতি ছিল।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অরক্ষিত অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের তিনটি ক্রেন, তিন কিলোমিটার ন্যারোগ্যাজ রেল লাইন, ২০ লাখ টাকার স্লিপার, পাঁচ কোটি টাকার মূল্যের দুটি জেনারেটর, দুই কোটি টাকা মূল্যের লোকাল ট্রলি ইঞ্জিন ও পাঁচটি টিপিং টাব, বেকু হেলি, লোডার, ওয়ার্কশপ, ওয়েব্রিজসহ চুনাপাথর উত্তোলনের কাঁচামাল ও মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এসব দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০০৭ সালের পর একজন কর্মকর্তা, একজন এপিসি, একজন পিসি ও ১৮ জন আনসার সদস্য পদায়ন করা হয়। এরপরও খনিজ প্রকল্পে এ পর্যন্ত ২০টির বেশি চুরির ঘটনা ঘটে। বর্তমানে একবারেই অরক্ষিত অবস্থায় থাকায় চুরি বৃদ্ধি পেয়েছে এমন অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

অভিযোগ উঠেছে, চুরির ঘটনায় প্রকল্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কিছু ব্যক্তির যোগসাজশ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুর রহমান, আমিনুলসহ আরও কয়েকজন জানান, বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের বর্তমান সরকারি কোয়ার্টার স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে ভাড়া দিয়েছেন। দখল হয়েছে প্রকল্প এলাকার বেশিরভাগ সরকারি জমি। দিন দিন এই দখলের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ নেই।

উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খসরুল আলম বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময় উপযোগী পদক্ষেপ নিলে রাষ্ট্রায়ত্ত চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের পড়ে থাকা সরকারি মূল্যবান সম্পদগুলো আগত পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়বে। এছাড়া এগুলো সংরক্ষণে তরুণ প্রজন্ম অনেক কিছুই জানতে পারবে।’

তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সুনামগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহসভাপতি আবুল খায়ের বলেন, ‘চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প এলাকায় চুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল্যবান যন্ত্রাংশ রাতের আঁধারে বিক্রি করছে একটি সিন্ডিকেট। খোলা স্থানে পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ। অথচ, সরকারি এসব সম্পদ রক্ষা করে এখানে আগত পর্যটকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করলে এই এলাকায় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে সরকারি সম্পদের সৌন্দর্য বাড়বে।’

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এখানে এক জনসমাবেশে বলেছিলেন, এখানে সরকারিভাবে শিল্প কারখানা তৈরি করে বেকার ও কর্মহীনদের জন্য কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন। তার কথা অনুযায়ী এখানকার হাজার হাজার বেকার ও কর্মহীনদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে সরকারি সম্পদ রক্ষা হবে।’

এ বিষয়ে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল বারি বলেন, ‘টেকেরঘাটে চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পে কি পরিমাণ মালামাল আছে তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। এসব মালামাল দেখাশোনা করার জন্য আনসার সদস্য আছেন। আমি নিজে দেখে এসেছি বাইরে রাখার মালামালগুলো বাইরে রাখা হয়েছে। অন্যগুলো নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরেই আছে। এ প্রকল্পে আপাতত কোনো কিছু করার পরিকল্পনা নেই। তবে এখানে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি করার আলোচনা চলছে। প্রকল্পের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবেন।’

(ঢাকাটাইমস/১২অক্টোবর/পিএল)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :