৮.৪৬ মিনিটের হত্যাকাণ্ড প্রভাব ফেলতে পারে মার্কিন নির্বাচনে

দুর্লভ বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ১২ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৩৬

বিশ্বের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ইতিমধ্যে তার ডামাডোলও শুরু হয়েছে। বিশেষ করে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট এই দুই শিবিরের প্রার্থীরা বসে নেই। করোনা নামক ভাইরাসের হিংস্র থাবার মাঝেও তারা বিভিন্নভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে রিপাবলিকান প্রার্থী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সুযোগ পেলেই প্রচার চালান।

গত ২৫ মে মিনিয়াপোলিশ নগরীতে ঘটে নিষ্ঠুরতম একটি ঘটনা। মাত্র ২০ জাল ডলার আছে এই অপরাধে জর্জ ফ্লয়েড নামক এক কৃষ্ণাঙ্গকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা করে। গুলি করে নয়, জর্জ ফ্লয়েডকে উপুড় করে ফেলে হাঁটু দিয়ে তার ঘাড় চেপে ধরে দম বন্ধ করে হত্যা করা হয়। জর্জ ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে দম বন্ধ করে হত্যা করতে সময় লাগে আট মিনিট ৪৬ সেকেন্ড, যা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

এভাবে হত্যায় তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। সে বারবার তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য আকুতি করছিল। কিন্তু তার করুণ আকুতিতে পাষণ্ড শেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার মন গলেনি। নিষ্ঠুরভাবে হত্যার এই দৃশ্যটি এক পথচারী দেখে ফেলে এবং মোবাইলে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয় পরে যা ভাইরাল হয়। যে কারণে বিশ্ববাসী নিষ্ঠুরতম এ হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যটি দেখতে পায়।

মানবাধিকারের সোল এজেন্ট হিসেবে দাবিদার আমেরিকায় পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু সেসব হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববাসী এমন প্রতিবাদ প্রত্যক্ষ করেনি। হয়তো মোবাইলে ভিডিওর কল্যাণে নিষ্ঠুরতার দৃশ্যটি দেখতে পাওয়ায় শুধু আমেরিকায় নয় বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। আমেরিকার প্রতিটি শহরে হাজার হাজার নারী পুরুষ নেমে আসে। ঘাতকব্যাধী করোনাভাইরাসের ভয়কে উপেক্ষা করে প্রতিটি শহরেই শত শত শেতাঙ্গ নারী পুরুষও বর্বরতম এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শামিল হন।

জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে শুধু মার্কিন মুলুকেই নয় ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স ইতালিসহ প্রতিটি ইউরোপিয়ান দেশেও প্রতিবাদ হয়েছে। করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করেছে ওইসব দেশে যা কি না গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মানবাধিকারে রক্ষাকবজের দাবিদার আমেরিকায় কালো তথা আফ্রিকানদের আগমন হয় দাস প্রথার মাধ্যমে। দাসদের মধ্যে তাদেরই সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। আমেরিকার ধনীদের মধ্যে কেউ কেউ আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার কালো দাস কিনে বিভিন্নজনের কাছে সরবরাহ করত। শুধু আমেরিকাতেই নয় ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও একইভাবে আফ্রিকান দাসদের সরবরাহ করা হতো।

কালের বিবর্তনে সেই নিষ্ঠুর দাসপ্রথা অনেক আগেই উঠে গেছে। কিন্তু দাস হিসেবে যেসব কালো আফ্রিকান আমেরিকা-ইউরোপে আসে তারা আর স্বদেশে ফিরেনি। সেই আফ্রিকান দাসদের উত্তরসূরিরাই আমেরিকা-ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী নামে পরিচিতি পায় বলে ইতিহাস সাক্ষী দেয়। আমেরিকায় এই কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা ১৩% যা কি না বর্তমান পরিসংখ্যান থেকেই পাওয়া।

শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার প্রতিবাদে সব ধরনের মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের দিনও 'BLACK LIVES MATTER' অর্থাৎ 'কালদেরও রক্তের মূল্য আছে' এই ব্যানার নিয়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে যার মধ্যে শত শত শেতাঙ্গও ছিল।

আমেরিকার বিভিন্ন শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার সাদা-কাল আমেরিকানদের যে বিক্ষোভ তা কি শুধু জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদ, নাকি উদ্ধত্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জামানায় আমেরিকার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে অস্থিরতা বিরাজমান তারই বহি প্রকাশ? সে কথাই বা কে জানে!

সাদারাই শ্রেষ্ঠ, সবকিছুর উপরে থাকবে তারা এ উগ্র জাতীয় আওয়াজ তুলেই ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন। আসল কাজ না করে তিনি শুধু মুখের কথা দিয়ে চিড়া ভেজানোর চেষ্টা চালান। সব ক্ষেত্রেই হেলাফেলা মনোভাব! বিশ্বের আতঙ্ক করোনাভাইরাস মোকাবেলাতেও বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর প্রেসিডেন্ট ব্যর্থ হয়েছেন। একক দেশ হিসেবে এই ভাইরাসটিতে এ পর্যন্ত আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। এজন্য দেশটির সচেতন জনগণ প্রেসিডেন্টের ওপর ক্রমে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন।

উগ্র জাতি বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলে ক্ষমতায় এসেও সেই সাদাদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণেও ক্রমশ ব্যর্থ হচ্ছে যা গণমাধ্যমের কল্যাণেই জানা যাচ্ছে। তাই অনেকে মনে করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমেরিকানরা সুযোগ খুঁজছিল। জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম হত্যাকাণ্ডটি তাদের সেই সুযোগ এনে দেয়। তাই এই হত্যার প্রতিবাদে প্রতিটি শহরেই শ্বেতাঙ্গরাও রাস্তায় নেমে আসেন। মার্কিনিদের এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ জাত বিদ্বেষ কোথাও কখনো সুখকর হয়নি তা ইতিহাসই বলে দেয়।

নাৎসিদের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। জার্মানরাই পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠ জাতি, আর অন্য সবাই নিকৃষ্ট। সেই নাৎসিদেরও কী পরিণতি হয় সেটাও ইতিহাসে বর্ণিত আছে। এই জাত বিদ্বেষ যে কতটা ভয়ংকর তা আমরা ১৯৭১ সালে এ বাংলাদেশেও দেখেছি। মুসলিম-অমুসলিমদের নিয়ে যে নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিল পাকিস্তানিরা তা ইতিহাসে লেখা রয়েছে। অনেক আগেই পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহ একুশ শতকে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ জ্ঞান বিজ্ঞানে তথা সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছেছে। এ যুগেও শুধু গায়ের রঙের কারণে মানুষে মানুষে বৈষম্য! তাও আবার মানবাধিকারে সোল এজেন্ট হিসেবে দাবিদার সেই মার্কিন যুক্তরাষ্টে, কী বেমানানই না শোনাচ্ছে। তারপরও তা বাস্তব। যদি তাই না হতো তাহলে জর্জ ফ্লয়েডকে ওভাবে হত্যা করা হতো না। উগ্র জাতিবিদ্বেষের ঘটনাবলী ইতিহাসে যেহেতু কখনো সুখকর বার্তা বহন করেনি, সেহেতু জর্জ ফ্লয়েডের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাষণ্ডটিও যে তা করবে না সে কথাই বলা বাহুল্য। তাই নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডটি মার্কিন মুল্লুকের আগামী নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে বলে অনেকেই এখনই বলাবলি করছেন।

লেখক: শিক্ষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :