কবিতা
ভালোবাসা
তখন আলমিত্রা (প্রফেটকে) বললেন, আমাদেরকে ভালোবাসা সম্পর্কে বলুন।
তিনি (দ্য প্রফেট) মাথা তুলে উপস্থিত লোকদের দিকে তাকালেন। তাদের উপর নেমে আসে নিস্তব্ধতা। দরাজ কণ্ঠে তিনি বললেন:
ভালোবাসা তোমাকে ইশারা করামাত্র সে পথ দুরূহ কিংবা বন্ধুর হলেও তুমি তার সহযাত্রি হবে।
এবং তার ডানায় তোমাকে জড়াতে চাইলে পালকের আড়ালে লুকনো খড়্গের ঘায়ে ঘায়েল হলেও
তুমি তার আলিঙ্গনে সমর্পিত হবে।
সে যেই কথা বলবে, সেই ভাষ্যে যদি তোমার স্বপ্ন উত্তরের হিমেল ঝঞ্ঝার তাণ্ডবে
ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া উদ্যানের মতোও হয়ে যায়, তবুও তা বিশ্বাস করবে।
কারণ প্রেম যেমন তোমাকে রাজমুকুটে ভূষিত করে তেমনি ক্রুশবিদ্ধও করে।
সে একদিকে তোমার বিকাশ, অন্যদিকে তোমার বিনাশ।
সে যেমন করে তোমার শীর্ষ-শিখরে উঠে
সূর্যতাপে কুঁচকে যাওয়া নাজুক শাখা-প্রশাখার গায়ে মমতার পরশ বুলিয়ে দেয়,
তেমন করে শিকড়ে নেমে এর মূলকে মাটির বাঁধন থেকে এক ঝটকায় আলগা করে ফেলে।
শস্যের আঁটির মতো জড়ো করে সে তোমাকে তার কাছে টেনে আনে।
মাড়াই করে সে খসিয়ে ফেলে তোমার সকল আবরণ।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে তোমাকে করে খোসামুক্ত।
পেষণে-মর্দনে তোমার মাঝে আনে শুভ্রতা।
পিষতে থাকে যতক্ষণ-না তুমি বিনম্র হও।
আর তারপর সে তোমাকে সমর্পণ করে তার পবিত্র আগুনে
যেখানে তুমি পরিণত হও বিধাতার পবিত্র ভোজসভার পবিত্র আস্বাদনে।
ভালোবাসা তোমাকে নিয়ে এতোসব কাণ্ড করে
যাতে তুমি তোমার হৃদয়ের রহস্যের খোঁজ পেয়ে যাও
এবং সেই জ্ঞানে তুমি মহাকালের হৃৎ-জগতেরএকটা খুদে অংশ বনে যাও।
তবে তুমি ভীত হয়ে যদি তোমার ভালোবাসায় কেবলমাত্র শান্তি এবং সন্তুষ্টি খুঁজে ফেরো,
তাহলে তোমার উন্মুক্ততাকে আবৃত করে ভালোবাসার মাড়াই অঙ্গন ছেড়ে
এমন এক ঋতু-বৈচিত্র্যহীন ভুবনে তোমার পলিয়ে যাওয়াই শ্রেয়
যেখানে হয়তো তুমি হাসবে, তবে প্রাণ খুলে হাসবে না;
হয়তো তুমি কাঁদবে, তবে প্রাণ ভরে কাঁদবে না।
ভালোবাসা নিজেকে ছাড়া আর কিছুই বিলিয়ে দেয় না
এবং নিজের কাছ থেকে ছাড়া আর কোন খান থেকে কিচ্ছুটি নেয় না।
ভালোবাসার যেমন নিজের বলে কিছু নেই তেমনি সেও কারো না;
কারণ, ভালোবাসার জন্য কেবলমাত্র ভালোবাসাই যথেষ্ট।
তুমি যখন ভালোবাসো তখন এমনটা বলো না, ‘ঈশ্বর আমার হৃদয়ে আসীন,’
বরং বলো, ‘আমি আছি ঈশ্বরের হৃদয় জুড়ে’।
এমনটা ভেবোনা-যে তুমি ভালোবাসার গতিপথ নির্দেশ করতে পারো
কারণ তোমাকে তার যোগ্য ভাবলে ভালোবাসা নিজেই হয় তোমার পথ প্রদর্শক।
তোমাকে পূর্ণ করা ছাড়া ভালোবাসার আর কোনো কাঙ্ক্ষা নেই।
কিন্তু তুমি যদি ভালোবাসো আর ভালোবাসায় যদি কামনা হয়ে ওঠে অবধারিত,
তবে তাই হোকঃ
সেই কামনার রস গলে নির্ঝরিণীর ফল্গুধারায়
রাতের কলতানে মূর্ছনা ছড়িয়ে কূলো কূলো বয়ে যেতে,
ভালোবাসার অতি কোমলতার কারণে বেদনা-বিধুর হতে,
ভালোবাসা সম্বন্ধে তোমার আপন উপলব্ধির কারণে আঘাত পেতে;
এবং স্বেচ্ছায় ও সানন্দে রক্তাক্ত হতে,
প্রত্যূষে ডানামেলা হৃদয়ে জেগে ওঠা আর প্রেমময় আরেকটা দিনের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে;
মধ্যাহ্ন-বিরামে বিশ্রাম এবং প্রেমোচ্ছ্বাসে নিমগ্নতায় আচ্ছন্ন হতে;
সন্ধ্যায় কৃতজ্ঞচিত্তে ঘরে ফিরতে;
এবং তারপর প্রিতমের জন্য অন্তরে আরজ আর উচ্চারণে বন্দনা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।
-
[কাহলিল জিবরান (১৮৮৩-১৯৩১- পূর্বনাম জুবরান খলিল জুবরান), লেবানিজ-আমেরিকান কবি, চিত্রশিল্পী, লেখক, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ। ইংরেজিভাষী বিশ্বে তিনি মূলত: তার ১৯২৩ সালে প্রকাশিত ২৬টি অতিন্দ্রীয়বাদী গদ্য-কবিতার সংকলন বই 'দ্য প্রফেট' র কারণে সুপরিচিত। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও চীনা কবি লাওজির পর জিবরান তৃতীয় বহুল বিক্রিত বইয়ের কবি।
'দ্য প্রফেট' এ যাবৎ মোট ১০০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। 'দ্য প্রোফেট' বইটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র আল-মুস্তফা, যিনি বিদেশি আরফালিস শহরে ১২ বছর ধরে বসবাস করেছেন এবং শেষতক একটি জাহাজ তাকে তার দেশে নিয়ে যেতে এসেছে। বিদায়লগ্নে তিনি একদল মানুষের উদ্দেশ্যে তাদের অনুরোধে জীবন এবং মানুষ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
বইটি ভালোবাসা, বিয়ে, সন্তান, দান, আহার্য, কাজ, আনন্দ ও দুঃখ, আবাস, পরিধেয়, ক্রয়-বিক্রয়, অপরাধ ও শাস্তি, আইন, স্বাধীনতা, কারণ এবং আবেগ, ব্যথা, আত্মদর্শন, শিক্ষাদান, বন্ধুত্ব, কথা, সময়, ভালো-মন্দ, প্রার্থনা, আনন্দ, সৌন্দর্য, ধর্ম, এবং মৃত্যু অনুচ্ছেদে বিভক্ত।
প্রত্যেক অনুচ্ছেদে আছে কাব্যিক ঢঙে জীবনের নানা দিকের দার্শনিক উপস্থাপন। আলামিত্রা নামক জনৈক নারীর ভালোবাসা বিষয়ক প্রশ্নের মাধ্যমেই মূলত: কাব্যের সূচনা। একে একে মা, কবি, কৃষক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবি, পান্থশালার মালিকসহ নগরের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে। প্রতিক্ষেত্রেই আল-মুস্তফার সস্নেহ উত্তর গভীর হৃদয়গ্রাহী যা জীবরানের নিজস্ব জীবন দর্শন। বইতে রয়েছে জিবরানের নিজের আঁকা ১২টি চিত্রকর্ম। অনূদিত কবিতাটি তার 'The Prophet' কাব্যের LOVE শিরোনামের কবিতার অনুবাদ।-- ড.নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া ]