প্রস্তাবিত ধলেশ্বরী উপজেলা এবং কিছু ভাবনা

রেজাউল করিম
| আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২০, ১৭:১১ | প্রকাশিত : ১৫ অক্টোবর ২০২০, ১২:১৬

‘লাউহাটী উপজেলা চাই’- কয়েক মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন একটি পোস্ট দেখেছিলাম। যত দূর মনে পড়ে, পোস্টটি করেছিলেন তালেব নামে একজন অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী। দাবিটা দেখে প্রথমে অনেকটা অবাক হয়েছিলাম। একজন ছাত্রের এককভাবে উপজেলা পরিষদ চাওয়ার বিষয়টি বেমানান মনে হচ্ছিল। তিন-চার বছর আগে তালেবের সঙ্গে পরিচয় এমন আরেকটি অদ্ভুত দাবির মাধ্যমে। তার জমির ওপর পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি পড়ায় লাইন বন্ধের দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অর্ধশত বিভাগে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন তালেব। যদিও সরকারি উন্নয়নমূলক কাজ হওয়াতে লাইন টানা তখন বন্ধ হয়নি। যথারীতি বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়েছিল। সেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর হাতে দেখা ‘লাউহাটী উপজেলা চাই’ এখন ‘ধলেশ্বরী উপজেলা চাই নামে’ আলোচনায় এসেছে। তখন কেউ এতটা গুরুত্ব দেয়নি। বর্তমানে কিছু বিশেষ ব্যক্তি প্রস্তাবিত ধলেশ্বরী উপজেলা বাস্তবায়নে তদবির চালাচ্ছেন এমন গুঞ্জনে আগ্রহীরা উল্লাসিত। এ দাবিটা এখন অনেকেরই।

বিপরীত পক্ষও আছে। প্রস্তাবিত ধলেশ্বরী উপজেলাতে যেতে অনাগ্রহীরা আন্দোলন শুরু করেছে। পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন দেখে মনে হয় এটা তালেবের আন্দোলন না। এর পেছনে অবশ্যই বিশেষ কেউ চেষ্টা-তদবির করছেন। গত ১২ অক্টোবর সোমবার দুপুরে অনাগ্রহী ইউনিয়নগুলোর জনসাধারণ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে প্রস্তাবিত ধলেশ্বরী উপজেলা বাস্তবায়নে শক্তিশালী পদক্ষেপ থাকায় আন্দোলনকারীরাও জোরালো ভূমিকা পালন করছে। মূলত দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটী, ফাজিলহাটী, নাগরপুর উপজেলার মুগনা, পাকুটিয়া এবং মির্জাপুর উপজেলার আনাইতাড়া ও বানাইল- এই ছয় ইউনিয়ন নিয়ে প্রস্তাবিত ধলেশ্বরী উপজেলা ভাবা হচ্ছে।

দেলদুয়ার, নাগরপুর ও মির্জাপুর উপজেলার যেসব ইউনিয়নকে ধলেশ্বরী উপজেলাতে অন্তর্ভুক্তের হিসাব ধরা হয়েছে, তারা অনেকেই নিজ নিজ উপজেলা ছাড়তে নারাজ। এর আগেও মির্জাপুর ও দেলদুয়ারে পৃথকভাবে অনাগ্র প্রকাশ করে মানববন্ধন করে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনের অবস্থা দেখে এখন অনেকটাই নিশ্চিত তালেব সেদিন না বুঝে ‘লাউহাটী উপজেলা চাই’ পোস্টটি করেননি।

সভ্য মানুষ অবশ্যই চায় জাতি আরও সভ্য হোক। অনুন্নত অঞ্চল চায় এলাকা আরও উন্নত হোক। তদ্রƒপ নতুন উপজেলা হবে, তাতে সবাই খুশি হওয়ার কথা। আলোচনার বিষয় উপজেলা হলে কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হবে। প্রস্তাবিত লাউহাটী উপজেলা কেনই বা হঠাৎ ধলেশ্বরী উপজেলা হচ্ছে। নতুন এই উপজেলা লাউহাটী নাকি নতুন কোনো স্থানে হবে, এ নিয়ে আলোচনা কম হচ্ছে না। কেউ কেউ বলছেন, লাউহাটীর পরিবর্তে নাগরপুর-দেলদুয়ার উপজেলার সংযোগস্থল কনোরাতে ধলেশ্বরী উপজেলা হতে পারে।

মির্জাপুর, নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলা থেকে দুটো করে ইউনিয়ন কেটে নিয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে কথিত ধলেশ্বরী উপজেলার। এ-সংক্রান্ত সরকারি কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে জানা গেছে, প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে জোর তদবির করছে একটি মহল। যে ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে নতুন উপজেলার কথা চলছে, সেসব ইউনিয়নের কিছু মানুষ উৎসাহ দেখালেও অধিকাংশ মানুষ এমন প্রস্তাববের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছেন।

তারা বর্তমানে যে উপজেলার অংশ হিসেবে আছেন, থাকতে চান সেভাবেই। নতুন কোনো উপজেলার বাসিন্দা হওয়ার ঘোর বিরোধী তারা। এ নিয়ে ইতোমধ্যে সেসব ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা। স্থানীয়ভাবে অনুষ্ঠিত এসব প্রতিবাদ সভায় অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ। দল-মতনির্বিশেষে বক্তব্য দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। এমন একটি সর্বদলীয় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় বানাইল ইউনিয়নের স্থানীয় ভাবখন্ড প্রাইমারি স্কুল মাঠে।

মির্জাপুর উপজেলার বানাইল ও আনাইতারা ইউনিয়নের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সমবেত হন এই সমাবেশে। মির্জাপুর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইউনিয়ন দুটি কথিত ধলেশ্বরী উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন সমাবেশকারীরা।

দেলদুয়ার উপজেলার ফাজিলহাটী ইউনিয়নবাসী ১ অক্টোবর ফাজিলহাটীতে পৃথকভাবে মানববন্ধন করেন। কথিত ধলেশ্বরী উপজেলা করার উদ্যোগ জনমনে অসন্তুষ্টির পাশাপাশি সৃষ্টি করেছে ব্যাপক বিতর্কের। প্রশ্ন উঠেছে, নতুন উপজেলার যৌক্তিকতা নিয়ে। টাঙ্গাইলে কেন আরও একটি নতুন উপজেলা?

১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ থেকে আলাদা করে মহকুমা টাঙ্গাইলকে পরিণত করা হয় জেলায়। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসমৃদ্ধ জেলা টাঙ্গাইল। কালিহাতী, মির্জাপুর, নাগরপুর, মধুপুর, গোপালপুর, টাঙ্গাইল, ঘাটাইল ও বাশাইল থানা নিয়ে গঠিত হয় এই জেলা। পরবর্তী সময়ে ভূয়াপুর, সখিপুর, ধনবাড়ী ও দেলদুয়ার সংযুক্ত হয় এই তালিকায়। ৪০ লাখ মানুষের এই জেলার থানাগুলো পরে উপজেলায় উন্নীত করা হলে সারা দেশের মধ্যে প্রথমে আদর্শ উপজেলা হিসেবে বেছে নেয়া হয় মির্জাপুরকে। উন্নয়নের দিক থেকে টাঙ্গাইল অনেক পিছিয়ে ছিল। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু, রেললাইন ও অতি সম্প্রতি ঢাকা-টাঙ্গাইল হাইওয়ে চার লেনে রূপান্তরিত হওয়ায় এলাকাটিতে জীবন-জীবিকা অনেকটাই সহজতর হচ্ছে। তবে গোটা জেলার জন্য এসব উন্নয়ন মোটেও যথেষ্ট নয়। দক্ষিণ টাঙ্গাইল খ্যাত মির্জাপুর ও নাগরপুরের বড় একটি এলাকা এখনো রয়ে গেছে অনুন্নত-অবহেলিত। রাজধানী ঢাকা শহরের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত মির্জাপুর। এই উপজেলার বানাইল ও আনাইতাড়া ইউনিয়নবাসী কেন মির্জাপুর ছেড়ে কল্পিত ধলেশ্বরীর চরে নিজেদের সম্পৃক্ত করবে? নাগরপুর ও দেলদুয়ারের ৪টি ইউনিয়নবাসীর প্রশ্নও এক এবং অভিন্ন।

ময়মনসিংহকে বিভাগে উন্নীত করা হলে টাঙ্গাইল জেলাকে তাতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব আসে। টাঙ্গাইল জেলাবাসী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারা থেকে যান ঢাকা বিভাগের অধীনে। স্বাভাবিকভাবে এসব ইউনিয়নবাসীও থাকতে চান নিজ নিজ উপজেলায়। অকারণে মানুষের এ আকাক্সক্ষার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

দেলদুয়ার একসময় টাঙ্গাইল-৫ আসন টাঙ্গাইল সদরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তখন টাঙ্গাইলের তুলনায় দেলদুয়ার ছিল অবহেলিত। এরপর দেলদুয়ার যুক্ত হলো টাঙ্গাইল-৬ নাগরপুর আসনের সঙ্গে। এখনো দেলদুয়ার অবহেলিত। সংসদ সদস্য হচ্ছে নাগরপুর থেকে। উন্নয়নের ছোঁয়া কমই লাগছে দেলদুয়ারে। দেলদুয়ার উপজেলাটি এখনো পৌরসভা হতে পারেনি। এমনিতেই পিছিয়ে। অবহেলিত এই উপজেলাকে ভেঙে আরেকটি উপজেলা তৈরি করলে দেলদুয়ার আরও অবহেলিত হবে কি না এ নিয়েও শঙ্কায় এ অঞ্চলের মানুষ। এছাড়া দেলদুয়ার ছেড়ে নতুন উপজেলাতে কেন যাবে এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আলোচনা উঠেছে কিছু বিশেষ ব্যক্তি ধলেশ্বরী উপজেলা বাস্তবায়নে ভাবছেন। সুতরাং ধলেশ্বরী উপজেলাটা বাস্তবায়ন হওয়াটা অনেকটা সম্ভাবনার পথে।

এছাড়া নতুন একটি উপজেলা। শিকড় থেকে শিখর পর্যন্ত নতুন করে সাজাতে হবে। অবকাঠামো থেকে শুরু করে জনবল পর্যন্ত নতুন করে বাড়াতে হবে। সরকার প্রস্তাবিত ধলেশ্বরী উপজেলা কোন ধরনের যুক্তিতে বাস্তবায়ন করবে এটা নিয়েও ভাবনার বিষয় কম না। নতুন একটি উপজেলা হলে এটা কোন সংসদীয় আসনে যুক্ত হবে সেটাও ভাবনার বিষয়।

নতুন উপজেলা না করেও এলাকার উন্নয়ন করা সম্ভব। ধলেশ্বরী নদীর ওপর সেতু না থাকায় দক্ষিণ টাঙ্গাইল জেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। সেতুটি নির্মিত হওয়ায় জেলার দক্ষিণ অংশের জনসাধারণের যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়েছে সহজ। তেমনি উন্নয়ন বা এলাকাবাসীর ভাগ্যোন্নয়নের সদিচ্ছা থাকলে তাদের জন্য অনেক কিছু করা যেতে পারে। বিশেষ করে যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পকারখানা ও কৃষি উন্নয়নে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনলে জনস্বার্থে কাজ করা হবে। দেলদুয়ার থেকে পাকটিয়া হয়ে ঢাকার সাথে, মির্জাপুরের পাকুল্লা থেকে সাটুরিয়া হয়ে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার উন্নয়ন করা যেতে পারে। টাঙ্গাইল সদর থেকে নাগরপুর সড়কের প্রস্থতা বাড়ানো যেতে পারে। চিকিৎসাসেবার মান বাড়াতে প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে। দক্ষিণ টাঙ্গাইলে তেমন কোনো শিল্পকারখানা নেই। এ অঞ্চলের বেকারত্ব দূরীকরণে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা যেতে পারে। লৌহজং ও ধলেশ্বরী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এ এলাকা প্রতিবছর বন্যাকবলিত হয়। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন পুনঃখনন। তরুণদের লাইনচ্যুতি ফেরাতে উপজেলা পর্যায়ে সম্ভব হলে ইউনিয়নভিত্তিক পাঠাগার তৈরি অথবা বন্ধ থাকা পাঠাগারগুলো পুনরায় চালু করা যেতে পারে। মাদক থেকে সরাতে উপজেলা অথবা সম্ভব হলে ইউনিয়ন পর্যায়ে খেলার মাঠ তৈরি, সংস্কার বা খেলাধুলা সামগ্রী বাড়ানো যেতে পারে। বেকার যুবকদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে কারিগরি প্রতিষ্ঠান বাড়ানো এমনকি কর্মমুখী শিক্ষার বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা বাড়ানো যেতে পারে। কৃষির প্রতি আগ্রহ বাড়াতে কৃষি সহযোগিতা বাড়ানো, বিশেষ করে লেবু চাষিদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে লেবুকে এ অঞ্চলের অর্থকরী ফসলে রূপ দেওয়া যেতে পারে। সর্বোপরি দেশ-বিদেশে পরিচিত টাঙ্গাইল শাড়ি বিলুপ্তির পথে। তাঁতপল্লীর দুর্দিন। তাঁতিদের পাশে দাঁড়িয়ে এ পেশার খ্যাতি ধরে রাখা যেতে পারে।

অতএব উপজেলা বাড়িয়ে সরকারের আর্থিক অপচয় না বাড়িয়ে এসব খাতের উন্নয়ন করলে এ অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতপক্ষে উপকৃত হবে।

এছাড়া দেলদুয়ার সদরসংলগ্ন ফাজিলহাটী ইউনিয়ন সহজেই পুলিশি সেবা পাচ্ছে। থানা হলে এরা এর বেশি সুবিধা পাবে বলে মনে হয় না। নাগরপুর উপজেলার মুগনা, পাকুটিয়া ধলেশ্বরীর পূর্বে হওয়ায় এগুলো দেলদুয়ারের সাথে সম্পৃক্ত করে দেলদুয়ারকে পূর্ণাঙ্গ সংসদীয় আসন করা যেতে পারে। পাথরাইল ইউনিয়ন যদি কালক্রমে টাঙ্গাইল পৌরসভার সাথে যুক্ত হয় এবং দক্ষিণের লাউহাটী-ফাজিলহাটী এই দুই ইউনিয়ন যদি প্রস্তাবিত ধলেশ্বরী উপজেলাতে চলে যায়, সেক্ষেত্রে দেলদুয়ার ভৌগোলিকভাবে ছোট হয়ে যাবে। মির্জাপুর ও নাগরপুরও তদ্রƒপ। এছাড়া নতুন উপজেলা না বাড়িয়ে বরং মির্জাপুর, নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলার দুর্গম এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ ফাঁড়ি করা যেতে পারে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনা করে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার্থে শেষ রায় দিবেন।

লেখক: সংবাদকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :