কোভিডের সমান ছোঁয়াচে হয়ে উঠছে ধর্ষণ

শামীম আজাদ
 | প্রকাশিত : ১৫ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৩৭

দেশ থেকে সেই কবে উড়াল দিয়ে এসে পৌঁছেছিলাম এই বিলেতে! কি ছিল হাতে সেই ফ্রস্ট ভরা রাতে? আমার আঁচলে কি বেঁধে দিয়েছিল মা? আজ আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। সবই কেমন খণ্ড খণ্ড ছেঁড়া ছেঁড়া। কখনো মাঝরাতে সেই টুকরোগুলো হাতে নিয়ে মেলাতে চেষ্টা করি। ভাবি এখনো যে আমি আছি সেটাই তো এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা!

কোভিডে আক্রান্ত হয়ে এই একই পৃথিবী থেকেই গত কমাসেই এক হাজার নয়, এক লাখ নয়-নাই হয়ে গেছেন দশ লাখ মানুষ! সারা পৃথিবীতে দেশ আছে সাকুল্যে ১৯৪টি। কিন্তু ওই দশ লাখের মধ্যে দুই লাখই মারা গেছেন একটি দেশ থেকে। সে দেশের নাম আমেরিকা। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে নাম আছে তার। আছে নাম মেডিকেল সায়েন্সের আবিষ্কারের দেশ হিসেবে। সে নাম বিলেতেরও আছে।

কোভিড ভ্যাক্সিনের জন্য অক্সফোর্ডের মুখ চেয়ে বসে আছি আমিও। আমাদের প্রধানমন্ত্রী- টোরির দলনেতা বরিস জনসনেরও করোনা হয়েছিল। তিনি এখনো পুরো সুস্থ হননি। সবার যেমন হয় তিনিও ভালো কাবু হয়ে গেছেন। একেই বলে শিক্ষাদীক্ষা।

কোভিডের জন্য সব আচরণ মানছেন আর দেশবাসীর কাছে কাতর হয়ে অনুরোধ করছেন মানতে। গতকাল স্পেনে কোভিড নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর মুখখানা কেমন শুকিয়ে গেছে।

আমেরিকায় কোভিডে এত মৃত্যু এবং এত লোক আক্রান্ত হতে লাগলো যে এমনকি তাদের মাস্কবিরোধী পাগলা প্রেসিডেন্টকেও কোভিডের পোকা কামড় দিয়ে দিয়েছে। রোগাক্রান্ত মানুষ জ্যামিতিক হারে রোগ ছড়ায়। এর সুপ্তবীজ এক দেশের মানুষ আরেক দেশে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তারে ধরতে পারলে তবে তো বেড়ি দেয়া! তাই আশংকায় জর্জর হয়ে সবাই কমিয়ে দিয়েছে বাইরে যাওয়া, খাওয়া, দেখা। মানুষ বাধ্যতামূলক মাস্ক পরছে। কিন্তু আমেরিকার পাগলা প্রেসিডেন্টকে কে আটকায়। বরং তিনি ছাড়া গরুর মতো দুনিয়ার মানুষকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন আর এখানে-সেখানে বেরিয়ে নিয়ম না মেনে আনন্দের সঙ্গে রোগ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। হোয়াইট হাউসেই সংক্রমিত করেছেন অন্তত ২২ জনকে। তাকে তো আইনের আওতায় আনা উচিত। পাগলাকে থামানো যাচ্ছে না।

নভেম্বরের নির্বাচনে নিজের অবস্থান নিয়ে মহাচিন্তিত হয়ে পড়েছেন তিনি। আরে ভাই তুমি না হয় পৃথিবীর সেরা ওষুধ খেয়ে বেঁচে গেলে! আর যে দু’লাখ মানুষ এমনভাবে চলে গেল তাদের প্রতি একটু এক ফোঁটা শ্রদ্ধা তো রাখো, নাকি! ভোরবেলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবি এসব। আজ ভাবনার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। মন বেশ বিক্ষিপ্ত। দেখি তির তির করে ছিঁচকে কাঁদুনীর মতো আকাশ কাঁদছে। এ অটাম। একে হেমন্ত বলতে চাই না। অমন বৃষ্টি ভেজা, পাতা পড়া প্রায়ান্ধকার ভ্যানগগের আঁকা ওয়েস্টমিন্সটার সেতুর ছবির মতো ঋতুর নাম অনুবাদ করে তাকে হেমন্তের সম্মান আর যে দিক আমি দেবো না। তুমি বাবা অটাম। পাতা পচা অটাম। আমার সব চেয়ে খারাপ লাগা মাস।

বিলেতে পড়তে এসেছিলাম অটামেই। সেপ্টেম্বর ’৮৯ সালে। সে তিরিশ বছর আগের কথা। ভোরে উঠে বেথনাল্গ্রীনের ক্লেয়ারডেল হাউস থেকে পায়ে হেঁটে স্কুলের পথে যখন যাত্রা করতাম তখন অপরিচিত এক ধরনের শীত এসে ঘিরে ধরতো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতাম সে তখনো অবিবাহিত। গায়ে পড়েনি কোনো আলোর আঁচ। সারা দিন শেষে সে প্রায় অন্ধকারেই আবার ডর্মে ফিরতাম। তখন পথে পায়ে ঠেকতো ফুলের পাপড়ির রঙে রাঙানো ভিজে ঝরা পাতা। ভ্যালেন্স রোড যেতে পেরুতে হতো উইভার্স ফিল্ড পার্ক। হয়তো কোনো এককালে এখানে থাকতো সিল্ক বোনার হিউগানটস কারিগর। স্কুল আর থাকার জায়গার দূরত্ব পর্যন্ত হাঁটার অভ্যাস ছিল না তখন। এটা এরকম যে বাংলাদেশ হলে সে সময় সাত টাকা রিকশা ভাড়া দিতাম। স্কুলে পৌঁছেই হিটারের উষ্ণতায় গা ভরে যেত।

৩০ বছরে কত কিছু বদলে গেছে সব! শীতও কমে গেছে। হাতে লেখার বদলে এখন শুধুই কম্পিউটারের কাঁপন। শুধু বুকে বসা বাংলাদেশের এক বিন্দু নড়ন চড়ন নাই। কিন্তু বদলে গেছে বাংলাদেশও। মানবিকতা চাপা পড়েছে সহিংসতা আর রাজনীতির পচনশীল প্রক্রিয়ায়। ভালোবাসা নয়, ভেদাভেদের রাজনীতিই স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। এটা আর ব্যতিক্রম নয়। তবে দেশের সবচেয়ে অবমূল্যায়ন ঘটেছে নৈতিকতায়। ধর্ষণের হার এত বেড়েছে যে মাঝে মাঝে মনে হয় এক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে আমাদের পুরুষেরা। আজ এই কোভিডকালের মধ্যেই দলে দলে মানুষ এর প্রতিকার চাইতে জড়ো হয়েছে শাহবাগ।

কিন্তু এতে কোনো প্রভাব কি পড়বে ধর্ষকদের রক্ষকদের ওপর? ধর্মের নামে পোশাকের ওপর পোশাক চড়িয়ে একটি মেয়েশিশু বা কন্যাকে কাপড়ের বোন্দা বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, থামছে না ধর্ষণ। নারী নিউজ পোর্টালে, ই-নিউজ পেপারে দিনের পর দিন ধর্ষণের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও তার সমাধান চলছে। কিন্তু তা পড়ছে কি ধর্ষক? শহরে শহরে, থানায় থানায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে মানববন্ধন হলে কি তার মেসেজ পেয়ে লজ্জিত হয়ে থেমে যাবে নবীন ধর্ষণ? নাকি শ্রেণি দ্বন্দ্বের বড় বড় কথা বলে সমাজ বদলের তাত্ত্বিক আলোচনা রুখে দেবে এই ধর্ষণ প্রবণতা ?

এর সবকটির উত্তর হলো ‘না’। তবে এর অসম্ভব দরকার আছে। এমনভাবে চিৎকার করতে হবেই। কিন্তু এতেও ওই পাপিষ্ঠরা কোভিডের মতোই থামবে না। যতক্ষণ না ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হচ্ছে। এ ভ্যাক্সিন নারীর রুখে ওঠা, সাহসী হওয়া, সঙ্গে ছোটখাটো অস্ত্র রাখা, দলে দলে বাইরে কাজ করা, মাঠে ময়দানে তাদের সংখ্যা বাড়ানো, ক্রমশ গুহায় না ঢোকা। তাতে আক্রান্ত হলে দলে বলে ধরে আচ্ছা করে ঠেঙ্গানো দেয়া যাবে নারী অবমাননাকারীদের। পালটা মার খেলে তবেই ভড়কে যাবে দুষ্ট কীট। একথা সত্য– নারীরা মনোবলে পুরুষের চেয়ে বলীয়ান।

হয়তো একজন, মাত্র একজন পাপিষ্ঠকে বিশেষ আইনের আওতায় এনে গণমাধ্যম, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ, বাজার, গ্রামেগঞ্জে ব্যাপক প্রচার করার পর প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে দেখতে পারেন সরকার। তখন ধর্ষণ বন্ধ হলেও হতে পারে। লেখক: কবি (লন্ডন থেকে)

ঢাকাটাইমস/১৫অক্টোবর/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :