মানবদেহের জন্য দুধ পান ও দুধের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০২০, ১৬:১৭

ড. মো. আওলাদ হোসেন

‘মাংস খেলে মাংস বাড়ে

ডিমে বাড়ে বল,

দুধ খেলে বুদ্ধি বাড়ে

শাকে বাড়ে মল্।’

দুধ প্রকৃতির একটি শ্রেষ্ঠ পানীয়। মেধা ও স্বাস্থ্য গঠনে দুধের ভূমিকা অত্যাবশকীয়। শুধু ভিটামিন সি এর কিছুটা ঘাটতি ছাড়া দুধে খাদ্যের সকল উপাদান সুষয় অবস্থায় বিরাজ করায় এটিকে আদর্শ খাদ্য হিসাবে সারা বিশ্বে বিবেচনা করা হয়। শিশু, তরুণ-তরুণী, বয়স্ক, নারী-পুরুষ সকলের জন্যই এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পানীয়। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপনের জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২৫০মিলি দুধ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

শিশুদের জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নাই। বয়সের সাথে সাথে বেড়ে উঠা শিশুর পরিপূরক খাদ্য হিসেবে ও যেখানে মাতৃদুগ্ধের অভাব রয়েছে সেখানে এবং সেই সাথে পূর্ণাঙ্গ মানবজীবনের চাহিদায় গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগলসহ ও অন্যান্য প্রাণীর দুগ্ধ প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করে। দুধে রয়েছে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপাদান ল্যাকটোজ যা শিশুর মস্তিষ্ক বর্ধনে সহায়তা করে। দুধ ছাড়া অন্য কোনো খাদ্যে ল্যাকটোজ নাই। জন্মের পর ছয়/সাত বছরের মধ্যেই মানব শিশুর মস্তিষ্কের প্রায় ৯০% বর্ধন শেষ হয়ে যায়। তাই এই বর্ধনকালে দুধের প্রয়োজনীয়তা বেশি। তাছাড়া দুধে রয়েছে উন্নতমানের আমিষ যার মধ্যে সকল প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড বিদ্যমান থাকায় যেকোনো আমিষের তুলনায় এটিকে শ্রেষ্ঠ আমিষ বলা হয়। দুধের চর্বিতে ৪০% অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড এবং প্রচুর পরিমাণে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড বিদ্যমান থাকায় এটি গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগলসহ ও অন্যান্য প্রাণীর চর্বির তুলনায় নিরাপদ। তাছাড়া দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, মেগনেশিয়ামসহ অন্যান্য খনিজ পদার্থ। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি অস্থিগঠনে সহায়ক। রাত্রে ঘুমের আগে এক গ্লাস দুধ পান করলে ভাল ঘুম হয় এবং হাইপারটেনশন কমাতে সাহায্য করে। দুধে রয়েছে বিভিন্ন রকমের ভিটামিন যা আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাছাড়া দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের বায়োএকটিভ উপাদান ও কনজুগেটিড লিনোলেনিক এসিড যা শরীরে ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।

দুধের খাদ্যগুণ, পুষ্টিগুণ ও ভেষজগুণ বর্ণনাতীত। দেড় হাজার বছর আগে বিজ্ঞান যখন অন্ধকারে তখন নবীজি (সা.) দুধ সম্পর্কে বলেন, দুধ হার্টের জন্য ভালো। দুধ পানে মেরুদণ্ড সবল হয়, মস্তিষ্ক সুগঠিত হয় এবং দৃষ্টিশক্তি ও স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ডাটা অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৬৬ লাখ মানুষের (১ জুলাই ২০১৯ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী) জন্য প্রতিবছর চাহিদাকৃত তরল দুধের পরিমাণ ১৫২.০২ লক্ষ মেট্রিক টন। দেশের চাহিদা মেটাতে গত ১০ বছরে তরল দুধ উৎপাদন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করে বাৎসরিক উৎপাদন ২৩.৭০ মেট্রিক টন থেকে মোট ১০৬.৮ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করা হয়েছে, যাহা চাহিদার তুলনায় এখনো কম। দুধ উৎপাদনে দেশকে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে এখনই কিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি প্রয়োজন। যদিও অনেক আগে থেকেই আমাদের প্রতিবেশী দেশসমূহ যেমন ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ-পূ্র্ব এশিয়ার দেশগুলি হাই-টেক ডেইরি খামার স্থাপন করে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পুষ্টিকর খাদ্য বিশেষ করে প্রাণীজ আমিষ (প্রোটিন) যেমন- দুধ, মাংস , ডিম গ্রহণের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একই কারণে প্রতিবছরেই দুধের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দুধের ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ সরকার তরল দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও চাহিদাপূরণ হয়নি। দেশে বর্তমানে দুধের ঘাটতি বছরে ৪৫.২২ লাখ মেট্রিক টন এবং অতীতে দুধের এই ঘাটতি আরও প্রকোট ছিল। এই ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে গুঁড়া দুধ ও ক্রিম আমদানি করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে ২,৬২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১,৩৮,০০০ মেট্রিক টন গুঁড়া দুধ আমদানি করা হয়েছে। যাতে একদিকে যেমন দেশের ডেইরি শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিবছর অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমদানি করা এসব দুধের মাণ নিয়ে জনমনে সংশয় আছে। তাই, কৃ্ষি নির্ভর আমাদের এই দেশে প্রোটিনের চাহিদা মিটাতে অধিক পরিমাণে দুধ ও মাংস উৎপাদন সময়ের দাবি।

২০১৯ সালের ২২ জুন, বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, ‘বিদেশ থেকে যে সব দুধ আমদানি করা হচ্ছে সেগুলো ভ্যাজিটেবল ফ্যাট মিশ্রিত। এসব দুধ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।’নেতারা আরও বলেন, ‘জাতীয় বাজেটে গুঁড়া দুধের আমদানি শুল্কের যে মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা কোনো অবস্থাতেই পর্যাপ্ত নয়। এটা দেশের স্থানীয় খামারিদের জন্য কোনো উপকারেই আসবে না, বরং দেশের দুগ্ধ শিল্পের জন্য এটি হুমকিস্বরূপ।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে দৈনিক ২৯,২৬০,০০০ লিটার (২৯,২৬০ মেট্রিক টন) তরল দুধ উৎপাদিত হয়। তন্মধ্যে ১৪,৬৩,০০০লিটার (৫%) প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করা হয়। ২৩,৭০০,০০০ লিটার (৮১%) তরল দুধ সাধারন মিষ্টির দোকানে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ৪০,৯৭,০০০ লিটার (১৪%) বাড়ি বাড়ি গ্রাহকরা ক্রয় করে ব্যবহার করে থাকে। অর্থ্যাৎ মোট উৎপাদিত তরল দুধের চারপঞ্চমাংশেরও বেশি পরিমাণ মিষ্টির দোকানে বিক্রয় হয়। ফলে বেশিরভাগ দুগ্ধ খামারিদের ব্যবসা, বিনিয়োগ, বিপণন মিষ্টির দোকানদারদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক পরিবেশ বা সামাজিক অস্থিরতার কারণে বা যেকোনো কারণে মিষ্টির দোকানদাররা দুধ ক্রয় না করলে খামারিরা বিপাকে পড়ে যায়।

২০১৫ সালে টানা অবরোধ-হরতালে পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার দুগ্ধ খামারিরা চরম বিপাকে পড়েছিলেন। ক্রয়কেন্দ্রগুলো নিয়মিত দুধ না কেনায় ৫০ টাকা দরের প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করতে হয়েছিল ১২ থেকে ১৫ টাকায়। ভাঙ্গুড়া উপজেলার বিক্ষুব্ধ খামারিরা প্রায় দুই হাজার লিটার দুধ সড়কে ঢেলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক ও সীসার উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসটিআই’র অনুমোদনপ্রাপ্ত ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিপণনে পাঁচ সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা জারি করায় চারটি প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে দুধ নেয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলায় রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ করেছেন দুগ্ধ খামারিরা।

এমনি বাস্তবতায় বর্তমানে দেশের দুধের চাহিদা মিটানোর জন্য গাভী পালন একটি লাভজনক ব্যবসা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে দুগ্ধশিল্প অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এখনো দেশের বিরাট জনসংখ্যা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। সাধারণত কৃষকেরাই দুগ্ধশিল্পের সঙ্গে জড়িত। দুগ্ধ খামার ব্যবসা বাংলাদেশের কৃষি ব্যবসাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশে দুগ্ধ খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশে লাখ লাখ বেকার যুবক সাবলম্বী হয়ে উঠছে। দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমাদের দেশে স্বাধীনতাপূর্ব কাল থেকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গাভীর জাত উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যহত আছে, তথাপি উন্নত জাতের গাভী দ্বারা খামার স্থাপনের পরিকল্পনা করলে এক সাথে দুই-একশত গাভী দেশের কোনো এক বা একাধিক অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা যায় না।

বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত এবং ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ এবং মধ্যপ্রাচ্য , মিসর, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশের অনুসরণে উন্নত প্রযুক্তির সমন্বিত হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেইরি ফার্ম স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা ও তা’ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আগ্রহী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ জন্য দেশি-বিদেশি কারিগরি পরামর্শ নিয়ে যথাযথ উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে অধিক উৎপাদনশীল জাতের পিউর ব্রিড গাভী লালন পালন করা জরুরি।

বাংলাদেশে দুধ উৎপাদন বৃ্দ্ধিতে উন্নত জাতের অধিক উৎপাদনশীল জাতের গবাদি পশু পালনের বিকল্প নাই । তাই, বাংলাদেশের আব-হাওয়ায় উন্নত জাতের পিঊর ব্রিড গবাদিপ্রাণি লালন পালনের অন্তরায়সমূহ দূর করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য দেশীয় খামারিদের উৎপাদিত দুধ বিপণনের নিশ্চয়তা ও আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রান্তিকভাবে প্রতিষ্ঠিত দুগ্ধ খামারিদের নিকট থেকে দুধ সংগ্রহ করে, প্রক্রিয়াজাত করে বিপণন করা প্রয়োজন। দেশের চাহিদা মোতাবেক খাঁটি তরল দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করে অতিরিক্ত তরল দুধ থেকে গুঁড়া দুধ উৎপাদনে শিল্পোদোক্তাদের উৎসাহিত করা উচিত। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, গ্রাহক নির্ভেজাল গুঁড়াদুধের নিশ্চয়তা পাবে, কর্মসংস্থান হবে এবং দেশীয় দুগ্ধশিল্প আরও সম্প্রসারিত হবে।

গুড়া দুধ আমদানি বন্ধ করে স্থানীয় খামারিদের সরকারি সাহায্য ও প্রণোদনার মাধ্যমে দুগ্ধ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা জরুরি। যদি গুঁড়াদুধ আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং দেশীয় খামারিদের প্রণোদনা ও সরকারি সাহায্য প্রদান না করা হয়, তাহলে দেশের দুগ্ধখামার শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা যদি দুগ্ধশিল্পের উন্নয়ন করতে পারি তাহলে এ খাতে আরও কর্মসংস্থান হবে, একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।

লেখক: ভেটেরিনিরিয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক কর্মী