গলব্লাডারে পাথর হলে সুস্থ থাকবেন যেভাবে

প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০২০, ১২:২০

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

মানুষের শরীরে গলব্লাডার হলো পিত্তথলি বা পিত্তকোষ। পরিপাকতন্ত্রের একটি নাশপাতি আকৃতির ফাঁপা অঙ্গ। যা লিভারের ডান দিকে থাকে। পিত্তথলি থেকে নিঃসৃত পিত্তরস খাবার হজমে সাহায্য করে। রক্তে কোলেস্টেরল বাড়লে বা বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে পিত্তরস ক্ষরণে বাধা পরে। তখন সেই পিত্তরস পিত্তথলিতে জমে পাথর তৈরি করে।

পুরুষদের তুলনায় মহিলারাই গলব্লাডারের সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন। সাধারণত পেটের ওপরের অংশে ডান দিকে তীব্র ব্যথা হওয়া, জ্বর বা মাংস ও তেল জাতীয় কিছু খেলে ব্যথা বাড়ে, সঙ্গে বমি হয় ঘন ঘন। সাধারণত সঠিক সময়ে না খাওয়া, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে নেই, মেনোপজের পর হরমোন রিপ্লেসমেন্টে অভ্যস্ত বা এক সময়ে প্রচুর গর্ভনিরোধক বড়ি খেয়েছেন, এমন নারীদের গলব্লাডার পাথরের আশঙ্কা বেড়ে যায় অনেকটা। জীবনের নানা পর্যায়ে, এমনকি গর্ভাবস্থাতেও হরমোনের যে ওঠাপড়া হয় সে কারণেও নারীদের গলব্লাডারে পাথর জমার প্রবণতা বাড়ে।

মেয়েদের তুলনায় কম আক্রান্ত হলেও পুরুষরাও এই অসুখের বাইরে নয়। অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, হরমোনাল অসুখ, কোলেস্টেরলের বাড়াবাড়ি পুরুষদের ক্ষেত্রেও গলব্লাডারে পাথর তৈরি করতে পারে। দু’টি খাবারের মাঝে অনেকক্ষণ বিরতি থাকলেও এই সমস্যা বাড়ে।

মহিলাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ওজন অথবা মেদ ঝরাতে ক্র্যাশ ডায়েট, ঘন ঘন উপোস, অসময়ে খাওয়া এই রোগকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনে। মেনোপজের পর হরমোন রিপ্লেসমেন্টের কারণেও এই রোগ হয়। প্রচুর পরিমাণে গর্ভনিরোধক বড়ি খেলে মহিলাদের ক্ষেত্রে পিত্তথলিতে পাথর জমার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় হরমোনের ওঠানামাও এই রোগকে উস্কে দেয়। আবার ধরুন কোনও মহিলার বয়স যদি ৬০ বছরের কাছাকাছি হয় এবং তিনি ডায়াবিটিক হন বা কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ ঘন ঘন খেয়ে থাকেন, তা হলেও পিত্তথলিতে পাথর জমার আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা নিয়মিত পরিমাপ করে গলব্লাডারে পাথর সম্পর্কে আগাম আভাস পাওয়া যেতে পারে।  রক্তে ক্যালসিয়াম বৃদ্ধিও গলব্লাডারের অন্যতম কারণ বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

গলব্লাডারে পাথর জমলে অপারেশন ছাড়া গতি নেই। তবে খাদ্যাভ্যাসে বদল আনলে এই রোগ ঠেকানো সম্ভব। অপারেশনের পরেও দ্রুত শরীর সারিয়ে তোলা যায়। তার জন্য পরিমিত খাবার, জীবনযাপনে কিছুটা সংযম, বিয়েবাড়ি বা পার্টিতে মেপে খাওয়া, অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা—এই সব মেনে চললে রোগের ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

 

যেসব বিষয় মেনে চলবেন

 

লো ক্যালোরির সুষম খাবার খান। দরকার হলে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। খাবারে যেন বৈচিত্র্য থাকে। রোজ এক ধরনের খাবার না খেয়ে সব রকম খাবার মিলিয়ে মিশিয়ে খান।

অপারেশনের পর কিছুদিন তরল খাবারেই ভরসা রাখুন। হজম করতে পারলে দিনে লো–ফ্যাট দুধ বা দুধের তৈরি খাবার খান৷ ২৫০ মিলি দুধ বা এই পরিমাণ দুধে বানানো ছানা, ৫০ গ্রাম চিজ, ১৭৫ মিলিলিটার ইয়োগার্ট বা টক দই৷  তবে ক্রিম দেওয়া কিছু না খাওয়াই ভাল।

ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার রাখুন খাদ্যতালিকায়। যেমন, শাকসবজি, ফল, হোল-গ্রেন তথা ব্রাউন রাইস, আটা–জোয়ার–বাজরা ইত্যাদির রুটি, ব্রাউন ব্রেড, খোসাওলা ডাল ইত্যাদি।

হজম করতে পারলে দিনে ২–৩ সার্ভিং লো ফ্যাট দুধ বা দুধে তৈরি খাবার খান।

এক সার্ভিং–এর মানে হল ২৫০ মিলি দুধ বা এই পরিমাণ দুধে বানানো ছানা, ৫০ গ্রাম চিজ, ১৭৫ মিলি ইয়োগার্ট বা টক দই। ইয়োগার্টে ২ শতাংশের কম ফ্যাট থাকতে হবে। লোয়ার ফ্যাট চিজে দুধের প্রোটিন যেন ২০ শতাংশের কম থাকে। ক্রিম না খাওয়াই ভাল।

দিনে ২–৩ সার্ভিং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খান।

এক সার্ভিং: ৭৫ গ্রাম মাছ–মাংস বা চিকেন, দুটো ডিম, ৩/৪ কাপ বিনস–শুকনো মটরশুঁটি বা মুসুর ডাল, ১৫০ গ্রাম বা ৩/৪ কাপ টোফু, ২ টেবিল চামচ পিনাট বাটার, সিকি কাপ বাদাম।

মাংস বা চিকেনের যে অংশে চর্বি কম থাকে সেই অংশ খান। চিকেনের গায়ের উপরের পাতলা চামড়া ছাড়িয়ে নেবেন অবশ্যই। মাঝেমধ্যে নিরামিষ প্রোটিনও খাবেন। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার রাখুন পাতে।

রোজ কিছু না কিছু উপকারি ফ্যাট খান। বাদাম, মাছের তেল, অ্যাভোক্যাডো, অলিভ অয়েল তো খাবেনই, ঘি–মাখন বা অন্য তেলও পুরোপুরি বাদ দেওয়ার দরকার নেই। কারণ ফ্যাট না খেলে গল-পাথর হয় না- এমন নয়। উপকারি ফ্যাট না খেলে বরং নানা রকম সমস্যা হতে পারে। তবে তা যেন মাত্রা না ছাড়ায়। দিনে ২–৩ টেবিল চামচ বা ৩০–৪৫ মিলি–র বেশি তেল খাবেন না। সিকি চামচ ঘি–মাখন খাবেন সপ্তাহে দু’–তিন বার। সপ্তাহে ৩–৪ বার ২৫ গ্রামের মতো লবণহীন সেঁকা বাদাম খাবেন।

চিনির কোনো উপকার নেই, বরং অপকার আছে বিস্তর। কাজেই সব রকম মিষ্টি স্বাদের খাবার খাওয়া বন্ধ করুন। ব্যতিক্রম ফল। তবে ফলের রস চলবে না একেবারেই। প্রতি দিন দু’টো ফল খান চিবিয়ে।

ক্যাফেইনসমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় কম করে খান। দিনে বার তিনেক ২৫০ মিলি কফি খেতে পারেন। গর্ভাবস্থায় তা নেমে আসবে দু’কাপে। চকোলেট বা নরম পানীয়র ব্যাপারেও সতর্ক থাকুন। চা একটু বেশি খাওয়া যায়। তবে তাও যেন মাত্রা না ছাড়ায়।

ওজন যাতে না বাড়ে সে দিকে খেয়াল রাখুন। বেড়ে গেলে রাতারাতি কমানোর চেষ্টা না করে স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে সময় নিয়ে কমান।

লো ক্যালোরির সুষম খাবার খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন যাতে ওবেসিটি, ডায়াবেটিস ও হাই কোলেস্টেরলের প্রকোপ কম থাকে।

মধ্যবয়সের মানসিক চাপ ও তার হাত ধরে ভুলভাল খাওয়া ও ওজন বৃদ্ধির সমস্যা এড়াতে দরকার রিল্যাক্সেশন থেরাপি। নিয়মিত ব্যায়াম, যোগা, মেডিটেশন ও কোনও ভাল লাগার কাজের চর্চা সে কাজে সাহায্য করতে পারে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করে হলেও মানসিক চাপ এড়ানোর চেষ্টা করবেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ ভালো ঘুম দরকার।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে গর্ভনিরোধক বড়ি খাবেন না। ঋতুবন্ধের পর নিতান্ত প্রয়োজন না হলে হরমোন থেরাপি করানোর দরকার নেই।

ভাজা, তেলমশলাদার খাবার একেবারেই নয়। গলব্লাডারের অপারেশনের পরেও ব্যথা কিছুদিন থাকে। সামান্য তেল পেটে গেলেও বমি বা পেট খারাপের সম্ভাবনা থাকে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে চাইলে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চর্বি যুক্ত মাংস, আইস-ক্রিম, যে কোনও ক্রিম জাতীয় খাবার, পিৎজা, সস, চকোলেট এবং যাবতীয় বার্গার, বেকন, সালামি থেকে শত হাত দূরে থাকুন।

(ঢাকাটাইমস/ ১৭ অক্টোবর/আরজেড)