‘কবিগান’: বাংলা সংস্কৃতির মার্গীয় মেধাস্বত্বের রত্নালংকার

প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০২০, ১৮:২৫ | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০, ১৮:৩৩

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার

বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির আকাশে কবিগান, পুঁথিপাঠ, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, পাঁচালি, ময়মনসিংহ গীতিকা, ভাওয়াইয়া, নবান্নের গান, হাছন-লালন, পদাবলি, শাস্ত্রপাঠ, প্রত্যেকটি বিষয় এক-একটি দুর্লভ উজ্জ্বল দ্যুতিসম্পন্ন নক্ষত্রের মতো। এসব নিজস্বতা বাঙালি জাতিকে বিশ্বের যেকোনো জাতিসত্তা থেকে পৃথক করেছে, যা শুধুমাত্র আমাদের। বিশ্বের অন্য কেউ, অন্য কোনো জাতির মধ্যে এসব জ্ঞান-গরিমা, বিদ্যা-বুদ্ধি চলন-বলন, সুর, ছন্দ, মাত্রা খুব একটা আছে বলে আমার জানা নেই। যার মূল্যায়নে বিশ্বের যেকোনো জাতির চেয়ে বিদ্যাযাত্রায় আমাদের এ চলনগুলো ছিল অত্যন্ত উচ্চমার্গীয়। আটষট্টি হাজার গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, আচার ও বিনোদনের নিত্যসঙ্গী ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতির এ মহামূল্যবান বিষয়বস্তুগুলো।
এমনকি বাঙালির ক্রীড়াসংস্কৃতিতেও ছি-কুতকুত, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, চোর-পুলিশ, বউচি, ইচিং-বিচিং, ডাংগুলি ইত্যাদি অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন খেলাধুলা নিতান্তই আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা হিসেবে সাধারণ মানুষের আনন্দ বিনোদনের দারুণ উপভোগ্য ছিল। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এ জাতীয় খেলাধুলা বাঙালি জাতি, রাষ্ট্র ও মানুষের নিজস্ব সৃজনশীলতার পরিচায়ক।

বিশ্বমানচিত্রে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এ বদ্বীপ রাষ্ট্রের অবস্থানগত সুবিধা এবং নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় পরিবেশগত কারণে দুর্যোগ, খরা, বৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় নানাবিধ বিশ্বাস এবং  প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ ধরনের লোকজ সংস্কৃতি এবং খেলাধুলার উদ্ভব হয়েছে। সেই সাথে ঋতুবৈচিত্র্যের বিবেচনায় এতগুলো ঋতুর স্বাদ, সুবিধা-অসুবিধা ভোগ করে এসব ক্ষেত্রে বিশেষ পারঙ্গমতা এবং সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর হিসেবে এমন সব ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যের সাহিত্য-সংস্কৃতি রচিত হয়েছে, যা নিতান্তই আমাদের নিজস্ব সম্পদ। বিশ্বের যারা যেভাবেই ভাবুক না কেন, এসব মূল্যবান সম্পদ অনন্য সংস্কৃতি ঋদ্ধ লোকজ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে কতটা উন্নত, ব্যতিক্রমী ও গবেষণাধর্মী তা আমরা খুব একটা অনুধাবন করতে না পারলেও, বিশ্বভাবনার পণ্ডিতদের কাছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, হাছন রাজাকে রাজদরবার টানতে পারেনি ততটা, যতটা লোকজ সংস্কৃতি তাকে টেনেছে। বরপুত্র লালন সাঁইজিকে নিয়ে এখনো গবেষণা চলছেই।  কী এমন স্বাদ, গন্ধ, রূপ, রস, যৌবনে ভরা এই বিষয়গুলো, যা খুব সহজেই বাঙালি জাতিকে বিশ্বের অন্য দেশ থেকে পৃথক করতে পেরেছে? তারই জবাব পেতে এত কিছু থেকে আমি একটি মাত্র বিষয়ের অবতারণা করতে চাই এ লেখাটিতে। তা হলো বাংলার সাহিত্য আকাশের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের স্বকীয় কবিগান।

দুই শ চুয়ান্ন বছরের ইতিহাস পাওয়া যায় বাংলাদেশের ভোলা জেলার একটি কবিগান উৎসব আয়োজনকে ঘিরে। সুপ্রাচীন এই বিশেষায়িত ধারা বেশ কিছু লোকজ সংগীতের সংমিশ্রণে জন্ম নিয়েছে, যার মূল উপজীব্য ছিল গ্রামবাংলার বাউল ধর্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিক জীবনতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, প্রকৃতিবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক মৌল ধারণার সমন্বিত এক অসামান্য জ্ঞান, যা গুরুবিদ্যার পরম্পরা রূপে বহুল চর্চিত ছিল। সামান্যতে এ বিদ্যার অস্তিত্ব পাওয়া সম্ভব নয়। সাধারণত স্বশিক্ষিত স্বভাব কবিদের মধ্যে এ ধারাটি বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। চর্চা ও গ্রহণযোগ্যতার বিচারে এটি তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গভূমির প্রায় সর্বত্র সমান ধারায় দীর্ঘকাল ধরে পরিবেশিত হয়েছিল। দুই বাংলাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিয়ালের পরিচিতি রয়েছে। কবিয়াল বিজয় সরকার চার হাজার আসরে পরিবেশন করেছেন দুই বাংলা মিলে।

ড. সুশীল কুমার দের মতে, সপ্তদশ শতাব্দীতেও কবিগানের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। গবেষণায় জানা গেছে, এই চর্চার প্রকৃত বিকাশকাল ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়।
‘বাংলার কবিগান’ গ্রন্থে সাহিত্য গবেষক সজনীকান্ত দাশ বলেন, অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত বহু রকমের সাংগীতিক ধারার মিলনেই কবিগানের জন্ম। ধারাগুলো হলো- তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, ঢপকীর্তন, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদি।

সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কবিয়াল হিসেবে ইতিহাসবিদরা গোঁজলা গুঁইয়ের নাম খুঁজে পান। সম্ভবত ১৭০৪ সালে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তার জন্ম হয়। তার শিষ্য লালু নন্দলাল, কেষ্টামুচি, রঘুনাথ দাস ও রামজির হাত ধরেই অষ্টাদশ শতাব্দী ও পরবর্তীতে বিখ্যাত কবিয়ালদের উদ্ভব হয়। উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত কবিয়ালরা ছিলেন- হরু ঠাকুর, নিত্যানন্দ বৈরাগী, রামবসু, ভোলা ময়রা, ভবানী বণিক, এন্টনী ফিরিঙ্গী, বলহরি দে, শম্ভুনাথ মণ্ডল, যজ্ঞেশ্বরী দেবী, তারক সরকার, রমেশ চন্দ্র শীল প্রমুখ। এমনকি বিখ্যাত মুকুন্দ দাসও প্রকৃতপক্ষে একজন কবিয়াল ছিলেন।

১৮৫৪ সালে কবি ঈশ্বরগুপ্ত সর্বপ্রথম কবিগান সংগ্রহ করে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় প্রকাশ করা শুরু করেন। লোকসংগীতের সর্বোচ্চ প্রতিভার এই বিশেষ ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে মুখে মুখে পদ রচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে বাদ্যযন্ত্র সহকারে তা পরিবেশন করতেন। তথ্যমতে- ডাক, মালসি, সখীসংবাদ, কবি, টপ্পা, ধুয়া, প্যার ও পাঁচালি এই আট ভাগে বিভক্ত হয়ে কবিগান পরিবেশিত হতো।

যে অধুনা সাহিত্যের উদাহরণ দিয়ে আমরা বর্তমান বাঙালিরা বিশ্বের কাছে নিজেদের সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশে উদগ্রীব, একটু ভেবে দেখবেন কি- এই কবিয়াল সম্প্রদায়ের মানুষগুলো প্রকৃতপক্ষে কি সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন সে সময়ে, যার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনও আমরা সঠিকভাবে অনুধাবন করিনি!

কল্পনা করুন- কোনো সম্ভ্রান্ত জমিদারের আয়োজনে দুজন কবিয়াল মুখোমুখি হয়েছেন অগণিত মানুষের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে তারা পরস্পর কোনো বিষয় নিয়ে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই যেকোনো বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিক গীত রচনা করে তাল, লয়, সুরের সঠিক সংমিশ্রণে ওই সুনির্দিষ্ট প্রশ্নটির মোক্ষম উত্তর না দিতে পারলেই পরাজয়! এবং বিষয়বস্তুও সচরাচর সহজ ছিল না। অথচ, বাংলার মাঠ-ঘাট থেকে উঠে আসা এই তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মানুষগুলো দীর্ঘ সময় ধরে অবলীলায় এই অসাধ্য সাধন করে গেছেন! কত ধরনের বিষয়ের ওপর সম্যক জ্ঞান থাকলে এবং প্রতিভার কোন স্তরে অবস্থান করলে একজন মানুষ এভাবে তার মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন?  আশ্চর্যের বিষয় হলো, এমন মানুষের সংখ্যাও নিতান্তই কম ছিল না সেই সময়।
দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি, ইতিহাস, দেহতত্ত্ব, বিবিধ শাস্ত্র, ভাষার বিভিন্নতা, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি বহুল বিষয়বস্তুর সার্বিক তথ্য সম্পর্কে বিশদভাবে অবগত না থাকলে একজন সফল কবিয়াল হতে পারত না কেউ। এই সাধনা যেকোনো সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ক্ষমতার অনেক ঊর্ধ্বে, তা বলাই বাহুল্য।

আমার আলোচনা ও গবেষণায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো, একজন বাঙালি কবিয়াল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব স্বল্প শিক্ষিত অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। কিন্তু, তারা অনেক বেশি সুশিক্ষিত তাদের স্বশিক্ষার মহিমায়। খুব গভীরভাবে আমাকে এ বিষয়টি ভাবিয়েছে যে, কত শতমুখী বিদ্যা তাদের রপ্ত করতে হয়েছে! আর তার চেয়েও বেশি অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি কত বেশি সক্রিয় ও উন্নত মেধার পরিচায়ক তারা, যখন কি না তাদের দেখি প্রতিপক্ষের একটি প্রশ্ন গ্রহণ করার সাথে সাথে সেটি বুঝতে সক্ষম হওয়া, অতঃপর শত বিদ্যার শতমুখী জ্ঞানের যে শাখা থেকে উত্তরটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব যথাযথভাবে সেই শাখায় সংকেত পৌঁছে দেয়া, সেখান থেকে স্পষ্ট-অস্পষ্ট কিছু একটি উত্তরের আভাস মেলা, আরও পরিষ্কার করে উত্তর তৈরি করার জন্য একটি অনন্য চিত্র মনে ধারণ করা, সেখানে বাছাইকৃত সুষম পদ রচনা করে ছড়ামালা বা বাক্য গঠন করা, সুরারোপ করা, তাল-লয়-ছন্দে পরিবেশনযোগ্য করে  গড়ে তোলা, দোহাররা যথারীতি সাহায্য করতে পারবে তেমনটি ভাবা এবং পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অপর কবিকে বোধগম্য করা, সেই সাথে উপস্থিত সুধীগণকে রূপ, রস, গন্ধের সমন্বয়ে উপভোগ্য করে তোলা এবং প্রাসংগিক লড়াইয়ের জন্য নতুন করে প্রশ্ন ছোঁড়া- এই সামগ্রিক বিষয়টি সময়ের এত ক্ষুদ্র অংশে এতটা পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ সত্যিই পৃথিবীতে বিরল। দিব্য চোখে দেখলে মনে হবে যেন যুগ যুগ ধরে মুখস্থ কোনো বিদ্যায় সুরের মাধ্যমে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে মাত্র। আসলে  বিষয়টি তা নয় বলেই কিন্তু পর্তুগিজ এন্টনি ফিরিঙ্গি তার যথার্থ দর্শন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং একজন কবিয়াল হিসেবে বাঙালিয়ানার বাইরে অনন্য অসাধারণ উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলার কবিগানে।

তথাকথিত শহরের সাহিত্যের জাতাকলে নিষ্পেষিত হতে হতে গ্রামবাংলার চিরায়ত উন্নত সাহিত্য নক্ষত্রগুলো বাঙালির হৃদয় ও মনন থেকে নিভে গিয়ে বাঙালির চিন্তাজগতে যে অন্ধকার অমানিশা নেমে এসেছে, তারই ফলশ্রুতিতে আজকের মানুষ যত অনিয়ম, অনাচার, ঠকবাজি, প্রতারণা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ এমনই সব ঋণাত্মকতায় নিমজ্জিত হয়েছে। তাই  চারপাশে হতাশা, অস্থিরতা, অনিরাপত্তা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।

অথচ, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠতম এই নিদর্শন শুধুমাত্র সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং সংরক্ষণের অভাবে আজ বিলুপ্তপ্রায়। স্বাধীন বাংলাদেশে কতিপয় কিছু গুণী মানুষ যেমন, অহীগুরু মাতাল রাজ্জাক, শাহ্ আলম সরকার, বিজয় সরকার, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, মনসুর বয়াতী, কুদ্দুস বয়াতী, সংগীতশিল্পী- বরেণ্য সাংসদ মমতাজ ইত্যাদি প্রমুখ এই অত্যন্ত উচ্চমার্গীয় চর্চা কিছুটা প্রচলিত রেখেছিলেন। হয়তো কালের পরিবর্তনে এই প্রবাহ অচিরেই বিলুপ্ত হবে বাংলা সংস্কৃতি থেকে হায়!

লেখক: পুলিশ সুপার, গীতিকবি ও কণ্ঠশিল্পী।