বঙ্গবন্ধু হত্যা: আমাকে যা বলেছিলেন সফিউল্লাহ

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০২০, ১৬:১৮

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু

বাংলাদেশ স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর ছয় মাসের মাথায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শুক্রবার বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে গুলি করে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খুনিরা জোরপূর্বক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নিয়ে এই মহান নেতাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল হোসেন মুহম্মদ এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া এই হত্যার বিচার বন্ধ করে রাখেন। এর চেয়ে বড় অপরাধ, লজ্জা অন্যায় আর কী হতে পারে?

এই হত্যায় জড়িয়ে আছে অনেক অজানা রহস্য, অনেক ষড়যন্ত্র, অনেক গুপ্ত কৌশল যা হয়তো কোনোদিন প্রকাশ পাবে না।

১৫ আগস্টের পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসা সামরিক ও বেসামরিক সরকার এই হত্যার বিচার সেদিন কেন করেনি, তা এখন জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। অনেকের মতে, পরোক্ষভাবে জেনারেল জিয়াই ছিলেন মূলত এই হত্যার নেপথ্য পরিকল্পনাকারী। তাই তিনি বেআইনি পথে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে, বঙ্গবন্ধু খুনিদের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত ও পুনর্বাসিত করেন।

পরবর্তীতে এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া তার কোনো ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে শুনেছি আশি দশকের শেষের দিকে এরশাদ নাকি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ও ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার শুরু করার একটা উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তান ফেরত সামরিক বাহিনীর কিছু কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও জাতীয় পার্টিতে থাকা আওয়ামী লীগের সময়ের সুযোগ গ্রহণকারী এবং স্বাধীনতাবিরোধী কট্টরপন্থীদের বাধার কারণে তার সেই আশা পূরণ হয়নি।

এ ব্যাপারে সেই সময় এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শেখ শহিদুল ইসলাম আমাকে (মন্ত্রী থাকাকালে) বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট এরশাদ নাকি খুব শিগগিরই বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক ঘোষণা করবেন।’

কিন্তু পরে খুব সম্ভবত জাতীয় পার্টিতে মুক্তিযুদ্ধ ও কট্টর আওয়ামী লীগ বিরোধীদের বাধার মুখে সেই ঘোষণা জেনারেল এরশাদ আর দিতে পারেননি।

শেখ শহিদুল ইসলাম এখনও বেঁচে আছেন। তিনি বলতে পারবেন এরশাদ সেদিন কী কারণে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘোষণা করতে পারেননি, তাঁর হত্যার বিচার করেননি।

পরে জাতীয় পার্টির বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনেকাংশে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে জাতীয় পার্টিতে থাকা আওয়ামী লীগপন্থী নেতাদের চাপ এখানে একটা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এখনও সংসদে বিরোধীদলীয় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টির বড় বড় অনেক নেতাকে আওয়ামী লীগের সুরেই কথা বলতে দেখা যায়।

এসব কারণেই সম্ভবত বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এরশাদের প্রতি কিছুটা হলেও একটা সফট কর্নার প্রকাশ পায়। তিনি এরশাদকে তার বিশেষ দূতের পদমর্যাদা দিয়েছিলেন।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ছিল শুক্রবার। পুরো বিশ্বের মুসলিম জাতির একটি পবিত্র দিন। সেদিন ভোরে মুয়াজ্জিনের আজানের পরপরই ঢাকাবাসী শুনতে পায় প্রচণ্ড গুলির শব্দ। আমরা তখন সোবহানবাগ সরকারি কলোনিতে থাকতাম।

বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে সোবহানবাগ কলোনির দূরত্ব মাত্র পায়ে হাঁটা পাঁচ মিনিট। হঠাৎ গুলির শব্দে সোবহানবাগ মসজিদে সেদিন অনেকেই ফজরের নামাজে যেতে সাহস করেনি। বাসার আশপাশে থেমে থেমে শুধু গুলির শব্দ।

আমাদের বাসাটা ছিল (টু-বি) নিচের তলায়। প্রাণ রক্ষায় বাসার সকলে ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড শব্দে ঘর কেঁপে উঠছিল। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি কলোনির টিনের গ্যারেজের ছাদের ওপর কালো পোশাকধারী সৈনিক। হাতে তাদের ভারী অস্ত্র।

হঠাৎ মোহাম্মদপুর থেকে ছোট ফুফুর টেলিফোন এলো। বললেন, ‘রেডিও শোন’।

রেডিও খুলতেই আওয়াজ, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে।’ কিছুক্ষণ পর পর রেডিওতে একই ঘোষণা।

আমাদের বাসার উঁচু দেওয়ালের অপর পাশে মিরপুর রোড। হঠাৎ রাস্তায় একটি গাড়ি ব্রেক করে থামার শব্দ শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে মিলিটারিদের দৌড়াদৌড়ি ও অস্পষ্ট কথার শব্দ, সাথে উচ্চৈঃস্বরে ‘হল্ট’ বলার কণ্ঠ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর সব কিছুই নীরব। নিচের তলায় থাকায় কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। 

দুপুরে জুমার নামাজের জন্য কিছু সময় সান্ধ্য আইন শিথিল করা হলো। নামাজ পড়ার জন্য কলোনির ওপারে সোবহানবাগ মসজিদে পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা। এখানেই জানতে পারলাম কর্নেল শাফায়েত জামিল হত্যার কথা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে নিজের গাড়িতে বসা অবস্থায় পবিত্র এই মসজিদের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছুটে এসেছিলেন।

সকালে যে গাড়ি থামার শব্দ শুনেছিলাম সেটা ছিল কর্নেল শাফায়েত জামিলের গাড়ি এবং তাকে গুলি করে মারার শব্দ।

শাফায়েত জামিলের স্ত্রী মিডিয়ায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাওয়ার আগে শাফায়েত জামিলের সাথে জিয়ার টেলিফোনে কথা হয়। জিয়া তাকে সেখানে যেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু কেন?

একদিকে রেডিওতে মেজর ডালিমের ঘোষণা আর অন্যদিকে খান আতা কর্তৃক খুনি মিলেটারিদের সমর্থনে লেখা গান প্রচার হচ্ছিল। খান আতা আজ না ফেরার দেশে চলে গেলেও এসকল শিল্পী এখনও বর্তমান।

এই গানটিতে যারা সেদিন কণ্ঠ দিয়েছিলেন তাদের বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। খুনিদের পক্ষে খান আতার লেখা এই গানের কথাগুলো শুনলে আপনি অবাক হবেন।

গানে কণ্ঠ দেওয়া এই শিল্পীদের এখন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করতে দেখা যায়। এদের একজনকে বঙ্গবন্ধু-কন্যা চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্য পর্যন্ত করেছেন।

১৫ আগস্টের হত্যা সম্পর্কে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ আমাকে বলেন, ১৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক ৫-৩০ মিনিটের দিকে তার ডিএমআই সালাউদ্দিন আমার কাছে এসে বলে, ‘স্যার, আপনি কি ট্যাংক ও আর্টিলারিকে শহরে মুভ করার নির্দেশ দিয়েছেন?’ আমি বললাম না। তখন তিনি বললেন, কিন্তু তারা ইতিমধ্যে রেডিও স্টেশন ও শেখ মুজিবের বাসভবনের দিকে অগ্রসর হয়েছে।

আমি বললাম, স্টপ দেম। শাফায়েত জামিল কোথায়?  তিনি কি ঘরে?  এই বলে আমি সাথে সাথে শাফায়েত জামিলকে ফোন করি। কারণ তিনি তখন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন।’

“তাকে বলি, ‘আপনি জানেন কী হচ্ছে?’। তিনি বললেন, ‘কী ব্যাপার স্যার?’ আমি বললাম, ‘আর্টিলারি নাকি মুভ করেছে?’ তিনি বললেন, ‘আমি কিছুই জানি না স্যার।’ আমি তখন বললাম, ‘আপনি যখন কিছুই জানেন না তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে বন্ধ করুন, ফার্স্ট, সেকেন্ড এবং ফোর্থ বেঙ্গলকে যাওয়ার জন্য বলুন।”

‘তারপর আমি বঙ্গবন্ধুকে ফোন করি। উনার ফোন এনগেজ পাই। এই সময় আমি নেভাল চিফ খান ও এয়ার চিফ খন্দকার সাহেবের সঙ্গে কথা বলি। তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে বললেন।’

“তারপর জিয়াকে ফোন করি। ‘আপনি কি কিছু জানেন?’ তিনি আমার কথা শুনে বললেন, ‘তাই নাকি?’ আমি তখন তাকে আমার এখানে আসার জন্য বললাম। এরপর পরই আমি খালেদ মোশারফকে ফোন করলে তিনি বললেন, তিনিও কিছুই জানেন না। এই সময় আমি আবার শাফায়েত জামিলকে ফোন করি। কিন্তু কোনো রেসপন্স পাইনি।”

“এমন করতে করতে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেল। এর মধ্যে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কানেকশন পাই। তিনি আমাকে বললেন, ‘সফিউল্লাহ আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। কামালকে মনে হয় মেরেই ফেলেছে। তুমি ফোর্স পাঠাও।”

“আমি তাকে শুধু এইটুকুই বলতে পেরেছি স্যার, ‘Can we get out? I'm doing something’. এর পর পরই শুনতে পেলাম টেলিফোনে গুলির শব্দ। এটাই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা।”

সম্প্রতি এক ভাষণে সফিউল্লাহকে বলতে শুনেছি তিনি নাকি ওই সময় বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘Can you get out, I am doing something’. তবে আমার কাছে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যদি বাইরে আসতে পারি তাহলে আমি কিছু করব।’

লেখক: সুইডেন প্রবাসী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা