ও মেয়ে, লাগাও ধমাধম নরাধম বরাবর

শামীম আজাদ
 | প্রকাশিত : ১৯ অক্টোবর ২০২০, ১৩:৫৮

আমি তখন অনার্স পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে পড়ি। শীতের রবিবার। পঁচাত্তর সাল। আজাদ বাংলাদেশ টোব্যাকোর বড় চাকুরে। সুকন্যা ঈশিতার বয়স দু বছর হবে। কিন্তু তাকে ছেড়ে পড়তে বসলেই পেছন থেকে বেয়ে বেয়ে উঠে হঠাৎ করে বইর ওপর থপ করে বসে পড়ে। আমি তখন রাত জেগে পড়া করি। ধুলো মুছি। অতিথি আপ্যায়ন করি। এমনকি করি কাঁচাবাজারও।

আমাদের বয়স্ক সুদর্শন বাবুর্চির নাম দরবেশ আলী। বাজার করতে দিলে তার বার্ধক্য আর দরবেশত্ব মিলে লাগে বিরানব্বই ঘণ্টা। কিন্তু আমি করলে এক ঘণ্টা। তাছাড়া পছন্দের জিনিস পাওয়া যায় মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোডের কোলে বসা বিশাল কাঁচাবাজারে। নামেই কাঁচাবাজার। সেখানে পাকা, আধাপাকা, কাঁচা সবজি, ফলমূলের সঙ্গে মাছওয়ালা, মুরগিওয়ালা, মাংস, শুঁটকি সবই আছে। আরও আছে বাজারের লাগোয়া আমার খালার বাড়ি। গাড়ি নিয়ে গেলে এক ঘন্টার মধ্যে চট করে শুধু বাজার না খালামনির হাতের স্বাদু খাবার ও আদর খেয়েও আসতে পারি। তো গেছি বাজারে আমার বাজারের ড্রেসে।

আমার বাজারের পোশাক আলাদা। যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সোবহানবাগ মায়ের বাসায় যাই এ সাজ তা থেকে আলাদা। বাজারের ড্রেস নামে আমার সালোয়ার-কামিজের একটি সেটই ছিল যার উড়নার কাপড়টা মোটা এবং দৈর্ঘে-প্রস্থে সমান। পড়লে গায়ে চাদর হয়ে বসে। কামিজটি ঢিলা নীল ছিটের ঘটি হাতা আর সঙ্গে সিধা সাদা পাজামা। পায়ে প্লাস্টিকের জবা কুসুম মার্কা স্যান্ডেল। আর বাজারে গেলে চোখেমুখে কাজল ফাজল বা লিপস্টিক দেবার প্রশ্নই ওঠে না। আমি কি পার্টি বা উৎসবে যাচ্ছি নাকি!

কিন্তু মোটা পরলেই কি আর পাতলা পরলেই কি। ওড়না দিয়ে গা ঘিরে রাখলেই কি আর না রাখলেই কি! তুমি হিজাব পরলেই কি বা জিলবাব পরলেই বা কি! বদমায়েশদেরকে আটকায় কে? সেই পারভার্টদের চোখ তোমার দিকে যাবেই। আর ওরা যে তোমাকে তাক করেছে তা তুমি ঠিকই টের পাবে।

যেমন শত কোলাহলের মধ্যে নিজের নাম ধরে কেউ কিছু বললেই নিজের নাম কানে লাগে। তেমনি শত ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ বিশেষভাবে তাকালে গায়ে ঠিকই বিঁধে। তো মিন্তি টোকাই নিয়ে মুরগীওয়ালাদের সামনে দিয়ে আমি মাছের ভাগাগুলোর দিকে এগুবার সময়ই ঠিক তেমনটি করে আমার গায়ে কি যেন কেমন বিঁধছিল। তো আমি হাঁটি আর এদিক-ওদিক তাকাই। কে? কে দেখছে আমাকে? আমাকে যেন কেউ ফলো করছে। কিন্তু মাথা উঠালেই কিছু একটা সরে যাচ্ছিল। পাচ্ছিলাম না।

এখানে-ওখানে কজন মাছের উপর পর জল ছিটাচ্ছে। মনে হলো সুতরাং কাচকি মাছের দাম কষাকষি করা যাক। বাজারে তেলওয়ালা সরপুঁটি উঠেছে। দরবেশ আলীকে দিয়ে কাটিয়ে যে কমলার খোসা শুকিয়ে রেখেছি তা দিয়ে বেগুনের সঙ্গে মাখা মাখা করে রান্না করবো। মাছ কেনা শেষ হলে সবজির দিক থেকে কিনবো ছুরি বেগুন। কাচকি কিনেই টের পেলাম সে চোখ জোড়া অত্যন্ত সন্নিকটে। সরপুঁটির দিকে পা ফেলতেই পরিষ্কার বুঝি এ আমাকেই অনুসরণ করছে। তখন তীর্যক ধর্ষক চোখ তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। লোকটার সজারু গোঁফ, লুঙি ও ফুলহাতা শার্ট পরা। আমি আর সরপুঁটির দামাদামিতে যাই না। এক্ষুণি আমার বাঁধা মিন্তি বাচ্চা নিয়ে ভাগবো।

কিন্তু সে ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে। আমিও বাউলি কাটতে থাকি। মাছওয়ালাদের সারির মধ্যে অত্যন্ত সরু জায়গা। মানুষ মানুষকে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে। এমন জায়গায় এসে আমি জল বাঁচিয়ে, লোক কাচিয়ে চলতে বেগ পাচ্ছিলাম। আর ঠিক তখনি লোকটি আমার গায়ে হাত দিতে এগিয়ে এলো। আমার বাঁ কনুইয়ের নিচ দিয়ে। আমিও যেহেতু ছিলাম তক্কে তক্কে। দে হাওয়া চাগিয়ে চাপড় প্রাণপণ এক থাপ্পর! কোথা থেকে যে এত শক্তি পেলাম কে জানে! চড়ের ধাক্কায় বা অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কায় বদমায়েশ লোকটা এক মুহূর্তের জন্য বেকুব হয়ে গেল। কিন্তু সে এক মুহূর্তই। কেন মারলেন কেন মারলেন বলে হাত উঁচু করতেই আমি টাইট করে তার হাত ধরে ফেলি আর দাঁতে দাঁত চিপে নিচুস্বরে বলি, সবাইকে চিৎকার দিয়ে বলি আপনি কি করতে যাচ্ছিলেন!

বলেছি বটে কিন্তু আমার গা ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। লোকটা হাত ছাড়াতে যায়। এমন শক্ত সে হাত যে আমার মুঠো খুলে যেতে থাকে। লোক জমে যায় আমাকে ঘিরে। আমার টোকাই বাবা আমার কামিজ ধরে পেছনে টানতে থাকে। চারদিকে টান টান উত্তেজনা। হুড়মুড় করে কিছু লোক আমাকে কিংবা আমার হাতে ধরা লোকটাকে কি কি যেন জিজ্ঞেস করতে থাকে। তাকিয়ে দেখি চীনে জোকের গায়ে লবণ পড়লে যেমন লোকটা তেমন হয়ে গেছে। ওর আর আগের চোখ নেই।

এমন সময় কোথা থেকে ট্রাউজার আর টি শার্ট পরা একহারা গড়নের এক যুবক লাফিয়ে এসে লোকটার হাত ধরে ফেলে আর আমাকে ঈশারা দিয়ে বলেন, আপনি বাড়ি যান। আমি দেখছি।'

আমি একটি কৃতজ্ঞতার শব্দ বলেই ভিড় ঠেলে দিই দৌড়। পেছনে আমার টোকাই। খালের পাড়েই খালামনির বাসা। আমি দ্রুত বিশাল তিমি মাছের মতো গেটের পেটে ঢুকে গেলাম। পেছনে টোকাই বাবা। ততক্ষণে বাজারের ভেতর কি চলছে জানি না। টোকাই বাবাকে বিদেয় করতেই পরীর মতো দেখতে কিশোরী দুই খালাতো বোন রাজি ও রিমা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে পেয়ে ওদের চোখ আঙ্গুরের মতো ঘন সবুজ হয়ে গেল। কি হয়েছে তা এখানে বড়দের জানানোর প্রয়োজনই বোধ করলাম না।

শুধু বাসায় ফোন করে আজাদকে বললাম, আমি এখান থেকে নাস্তা খেয়ে আসছি। তুমি দরবেশের ধ্যান ভঙ্গ করে রবিবারের লুচি হালুয়া খাও। আমি ঈশিতা উঠবার আগে আসছি।

সেই ঈশিতা তরুণী হলে এক বৃষ্টির দিনে তাকে এ গল্পটি বলতেই সে ফিক করে হেসে বলে, মা আমি তো গতবার বাংলা একাডেমি বইমেলায় এক লোককে আমার হিল দিয়ে পায়ে পাড়া দিয়ে রক্ত বের করে অবস্থা কাহিল করে দিয়েছিলাম। লোকটা না মা কঁকিয়ে লেংচে লেংচে পালিয়ে গিয়েছিল। টু শব্দ করেনি। তুমি আর বাবা সেদিন সামনেই ছিলে।

-হায় আল্লা তাই!

হ্যাঁ মা ঐ যে বার হুমায়ুন আহমেদ আমার কাছ থেকে দু টাকা নিয়ে আমাকে তাঁর অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন।

বলিস কি?

- যা ভয় পেয়েছিলাম! কিন্তু ঠিক করেছি।

- একদম ঠিক। মহা ঠিক মা!

আজ ভাবি আর কোনো কথা না। বলো বালিকারা মা ভৈ মা ভৈ । ভিড়ের রাস্তা, চিড়ের ফুটপাতে তোমাদেরও সমান দাবি। জনতার আড়ালে সেই সুযোগে কেউ গায়ে হাত দিলেই সঙ্গে সঙ্গে লাগাও ধমাধম। তোমাদের যার যা আছে। স্যান্ডেল, ব্যাগ, হাত। তাই নিয়েই।

আর যদি লাথিটা জায়গা মতো দিতে পারো- কেল্লা ফতে। মনে রাখবা, অপরাধী কোনদিন চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। পারে না।

লেখক: কবি

ঢাকাটাইমস/১৯অক্টোবর/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :