অপরাধের দায় ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানের নয়

প্রকাশ | ২২ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৩০

মোজাফফর হোসেন

অনুসারীর সংখ্যা অনুপাতে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্ম ইসলাম হলেও কট্টর বিশ্বাসের জায়গা থেকে এটাই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ধর্ম হওয়ার কথা। সম্ভবত পৃথিবীতে দুশো কোটির মতো মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। সপ্তম শতক থেকে এর অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, যেখানে পৃথিবীর হাজার হাজার ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এরপরও আমাদের দেশের বিশ্বাসী মুসলমানরা ইসলামের ইনসিকিউরিটিতে ভোগেন কেন বুঝি না।

কোটি কোটি মানুষের বিপরীতে একজন মানুষ ইসলামী কৃষ্টির সামান্য সমালোচনা করলেই খুন করা দায়িত্ব মনে করে। সেটা করেও। কিন্তু আমার প্রশ্ন সে জায়গাতেও না। যখন দেখি ইসলাম ধর্মের কোনো আচার বা শেষ নবীর সমালোচনা নয়, সামান্য কোনো আতিপাতি ভণ্ড হুজুরের সমালোচনা করলেও লক্ষকোটি মুসলমানের হৃদয় কেঁপে ওঠে, রাগে গরগর করে, তখন আশ্চর্য না হয়ে পারি না।

ইউটিউবে অনেক ওয়াজি যে সব মনগড়া নারীবিদ্বেষমূলক কথা বলে, তাতে খুব লজ্জা পেতে হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলেই অনেকে মনে করেন ইসলামের ভিত্তি বুঝি কেঁপে গেল। এমনকি মাদরাসায় ধর্ষণের মতো বিষয়ের প্রতিবাদও করা যাবে না। ধর্ষণ কি ইসলাম সাপোর্ট করে? কখনোই না। মোটেও না। তাহলে হুজুর লেবাসে কেউ ধর্ষকের ভূমিকায় আসলে তাকে বাঁচানোর দায় কেন?

যখনই মাদরাসায় ছেলেশিশু বলাৎকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে যাই, তখনই হাজার হাজার মানুষ (মুসলমান) বলতে আসে, ‘অন্য কোথাও যে ধর্ষণ হয়, সেটা চোখে পড়ে না?’ আচ্ছা, মাদরাসার হুজুরদের ধর্ষণ নিয়েই যদি খালি বলি, তাতে সমস্যা কোথায়? ইসলামি সংস্কৃতিতে তো প্রাইমারি স্কুলের চেয়ে মাদরাসা বেশি নিরাপদ হওয়ার কথা। বিশেষ করে শিশুদের যৌন-নিরাপত্তার প্রশ্নে। ইসলামে বিবাহবহির্ভূত পরস্পর সম্মতির মিলনকেও সমর্থন দেয়নি, ধর্ষণ তো দূরের কথা। আর সমকামিতার জন্য একটা গোটা জাতিই ধ্বংস হয়ে গেছে। আল্লাহ সমকামিতার জন্য লুত (আঃ) পুরো জাতি নদীর নিচে তলিয়ে দিলেন, আর মাদরাসার একজন পায়ুকামী ধর্ষক হুজুরের বিরুদ্ধে আমি বলতে পারব না। পশ্চিমে সমকামী প্রেমের বিরুদ্ধে বললে বাহবা কিন্তু দেশে হুজুর দ্বারা ছেলেশিশুকে বলাৎকারের ঘটনা চেপে যেতে হবে। কেন? বললে কি ইসলাম ইনসিকিউরিটিতে পড়ে যাবে? শতকোটি মানুষের বিশ্বাস নড়ে যাবে?

কথাগুলো বলছি এমনি এমনি না। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, আমরা সব ধরনের ধর্ষণের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করে আসছি। সব ধরনের ঘুষখোর, সুদখোর, দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলি। কিন্তু যখনই মাদরাসার শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করি তখনই কিছু মানুষের (মুসলমানের) আঁতে লাগে। যখনই প্রজ্ঞাহীন ওয়াজিদের বিরুদ্ধে বলি, তখনই কিছু মানুষের (মুসলমানের) আচরণে মনে হয় বাংলাদেশের ইসলাম ঝুঁকিতে পড়ে গেল।

আচ্ছা বলেন তো, ইসলামের প্রকৃত শত্রু কে একজন অসৎ ভণ্ড ধান্দাবাজ, যে ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মের পোশাকে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে যাচ্ছে, নাকি সে যে এই ধান্দাবাজের পেছনে লেগে আছে? ধরুন যে লোকটা ধান্দাবাজ হুজুরের পেছনে লেগেছে সে ইসলাম ধর্মীয় পোশাকে বা ধার্মিক পরিচয়ে নেই, তাতে তো তার অভিযোগ মিথ্যা হয়ে গেল না। তাতেও যদি সমস্যা মনে হয়, তাহলে আপনি তো ইসলাম ধর্মীয় লেবাসে আছেন, আপনি কেন মাদরাসায় শিশু বলাৎকার, ইউটিউবে ওয়াজের নামে যা-তা বলার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব না? 

ইনসিকিউরিটি? অস্তিত্বের সংকট? কার? ইসলাম ধর্মের না আপনার বিশ্বাসের?

মাদরাসার ভেতরে যখন কোনো শিশু ধর্ষণের শিকার হয় তখন দোষটা মাদরাসার ওপর না নিলেই হয়। ওই ভণ্ড হুজুরকে ধরেন। একটা না, শয়ে শয়ে ধরেন, অটোমেটিক ঠিক হয়ে যাবে। বরঞ্চ স্থান মাদরাসা বলে, ধর্ষকের ভূমিকায় হুজুর বলে, সেটি নিয়ে আলোচনা না করে আপনি সাময়িকভাবে মাদরাসার মান রক্ষা করছেন বলে মনে হলেও আপনিই কিন্তু মাদরাসাকে অপমান করলেন। আপনিই কিন্তু পরোক্ষভাবে ধর্ষকের পক্ষ নিলেন।

ধর্ষণের মতো ঘটনায় আপনার মৌনতা কি ইসলাম সাপোর্ট করে, সেটা মসজিদ, মাদরাসা যেখানেই হোক? আপনি কখনো কখনো এতই নীরব যে আপনি জানেনই না মাদরাসায় নিষ্পাপ শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়। চীনের কোনো জঙ্গলে মুসলমানদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছে এমন অপ্রকাশিত খবরও উদ্ধার করে ফেলেন আর দেশের এই প্রকাশ্য খবরগুলো আপনার চোখে পড়েই না। একটা শিশুর চিৎকারে যদি মাদরাসার প্রাণহীন মাটিও কেঁপে ওঠে, আপনার হৃদয় কেঁপে ওঠে না। সমস্যা কোথায়? ইনসিকিউরিটি? কার?

লেখক: গল্পকার

ঢাকাটাইমস/২২অক্টোবর/এসকেএস