একটি ঘরের গল্প
ঐ বিষ্যুদবার শীতের সেই সন্ধ্যায়
আমার ড্রয়িং-খাতা পেন্সিল নিয়ে
দাদাজানে’র গায়ের চাদরের এক ধার টেনে
গায়ে জড়িয়ে ওম-ওম ভাব নিয়ে পাশে বসতেই দাদাজান
আমার গায়ে গোটা চাদরটাই জড়িয়ে দিলেন।
আমাকে পোটলা বানিয়ে
এদিক ওদিকের ফাঁক-ফোঁকর পরীক্ষা করলেন।
চাদরের গিঁট আমার গলায় কষতে কষতে বললেন,
‘নেও দাদাভাই! শীত এই বার বিলাত পালাইবো’।
খাটের পাশের কুচকুচে কালো সোওয়া আলমারিটা থেকে
একটা ময়লা-মলিন হলদেটে কাগজ বের করে
দাদাজি এমন আলতো হাতে এর ভাঁজ খুলতে লাগলেন
যেনো জোড়ালাগা গোলাপ পাপড়ি আলগা করছেন;
কিংবা যেমন করে খেলাচ্ছলে আমরা বালকবেলায়
জলফড়িং প্রজাপতি কিংবা জোনাকি অতি সাবধানে
দুহাতের তালুর খাঁচায় আটকে রাখতাম:
এতোটা শক্ত হাতে চাপ দিতাম না যে,
পাছে মরে যায়,
আবার এমন আলগা করেও রাখতাম না যে,
পাছে উড়ে যায়;
অবশ্য বড়ো হয়ে এই তরিকায় যাকে আগলে আগলে রাখি,
এর নাম কেবলি প্রেম।
তো যা বলছিলাম;
ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়া কাগজটার পরত খুলতে খুলতে দাদাজান বললেন,
কই,দাদা ভাই! খাতা পেন্সিল লইছো নাকি?
একটা ছবি আঁকো; তেমন কিছু না
এই একটা বাড়িঘরের ছবি আর কি!
দাদাজি বলে যাচ্ছেন আর আমি এঁকে যাচ্ছি:
একটা তিন কোঠাঅলা বসত ঘর
বড়ো কোঠায় সার-কড়াইয়ের ময়ূর পালঙ্ক
মাটির বেড়া, ঢেউটিনের ছাউনি
শালের পালা, গজারি কাঠের দরজা জানালা
হাওয়া খেলার দুইটা বারান্দা
লম্বা চৌকাঠ, সামনে ঝকঝকা উঠান
পেছনে পানাপুকুর, পাশ ঘেঁইষা নয়া টিপকল
উত্তরপুব কোণায় গোয়াল ঘর
ডান কোণায় রসুই ঘর, বাম কোণায় কলার মুড়া
পাশের ঝোপেই ঝিঁঝিঁ আর জোনাক পোকাদের আস্তানা
এর পাশে মোত্তাক বাগানে টুনটুনির বাসা
বামের মোড়ে রাঙা মাটির পথ
সেই পথেই লাঙল কাঁধে কৃষকের চলাচল
খুড়ের ধুলা উড়াইয়া পথচলা গরুর পাল
পাশে আমের ছায়ায় বসা বাঁশিঠোঁটে রাখাল ছেলে
খেজুর গাছে ঝুইলা থাকা রসের ঘড়া
কাজলা দিঘির উঁচু পাড়ের দূরের আল পথে
একতারা হাতে বাউলের পথ চলা
বিরান মাঠের তাল গাছের পাতায় হাওয়ায় দোলা বাবুইর বাসা
দক্ষিণ বাঁকে মরা সোতের গোমতি নদির বেড়ি বাঁধে
শাদা শাদা কাশ ফুলের ঢেউয়ের দোলা।
এবার দাদাজান কাগজটাকে ভাঁজ করতে করতে বললেন,
কই, দাদাভাই, আঁকা শেষ অইলো না কি?
আমি হঠাৎ কুনো ব্যাঙ দেখার মতো লাফিয়ে উঠে বললাম,
আরে দাদাজি! এই দেখেন কী মজার কাণ্ড!
ওটাতো একশতে একশ আমাদের নিজেদেরই বাড়ি!
দাদাজি বললেন, ঠিকই কইছো, ওইডা আমাগো-ই বাড়ি।
তোমার বড় আব্বার আমলে আমাদের ঘর গেছে পদ্মার পেটে
এর বাদে সোনাপুরে আইসা নতুন ঘর বাঁধছেন বাবা
রাজু মানে তোমার বাবা মুক্তি যুদ্ধে গেলো
আর পাঞ্জাবিরা আইসা ঘর বাড়ি পুইড়া-ধুইরা
ছারখার কইরা দিলো।
বুইজলা দাদা ভাই!
আমাগো তিন কোঠার বসত ঘরটা আয়েশের না অইলেও
কইতে পারো মনের মতোই আছিলো।
তবে আরামের কিনা হেইডা বুইঝতে পারি নাই;
কারণ আরাম টারামডা-যে আসলে কী
হেইডা আমার মাথায় আসে না।
আরাম কি কোনো সুখ-সুখ ভাব?
তাইলে কইলাম আমাগো ঘরডার থাইক্যা আরামের ঘর
এই দুইন্নাইত আর কারোগ্গই আছিলোনা।
এমন একখান ঘরের খোয়াব আছিলো তোমার দাদীর,
তার কাছে হুইন্যা হুইন্না ঠোঙার কাগজে আমি
ওই ঘরডাই আঁইকা রাখছিলাম।
তার বাদে আমরা এই নিচিনপুরে ওই রকমের ঘর বানাইছি।
ঘরের চালের দিকে নজর তুলে আনমনে
বিড় বিড় করে দাদাজি বলতে থাকেন—
হায়রে নসীব! হায়াতে কুলাইলো না ,
দেইখা যাইতে পারলো না মনের ছবির মতন হেই ঘরখান।
আমি দাদাজানের হাঁটুতে ধাক্ক দিয়ে বললাম,
তাইলে দাদী এখনো এই ঘরে থাকেনা কেন?
প্রশ্ন শুনে দাদাজি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন
আমাকে কাঁধে তুলে নিতে নিতে বললেন,
এখনতো উনি অন্য দেশে;
সাড়ে তিন হাতের মানুষ; ঘরও সাড়ে তিন হাত!
উপরের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন,
সবই ঐ ওনার লীলাখেলা।
দাদাজির চোখের পাতা ভিজে আসে;
আমাকে কোলে করে মায়ের বিছানায় দিয়ে যায়।
আমি মায়ের গলা জড়িয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করি,
না, চোখে ঘুম নেই; বৃথা চেষ্টা।
এপাশ ওপাশ করি আর ভাবতে থাকি,ভাবতে থাকি;
কী ভয়ংকর!
সাড়ে তিন হাত দেহের জন্য সাড়ে তিন হাত ঘর।