অনলাইন ভেটেরিনারি হাসপাতাল উদ্বোধন: প্রাণিস্বাস্থ্য সেবায় একটি নতুন অধ্যায়

ডঃ মোঃ আওলাদ হোসেন
 | প্রকাশিত : ২৯ অক্টোবর ২০২০, ১১:১১

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ‘পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে `প্রাণিস্বাস্থ্য নিশ্চিত করি, লাভবান খামার গড়ি` প্রতিপাদ্য নিয়ে ২৫ অক্টোবর, ২০২০ ফেসবুক লাইভ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ‘প্রাণিসেবা ভেট’ নামে একটি অনলাইন ভেটেরিনারি হাসপাতাল এর শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হলো। ঐ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আলোচক হিসাবে আমিও ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলাম।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, এমপি, আশা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত প্রাণিসম্পদের প্রথম এবং একমাত্র বিশেষায়িত টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্ম ‘ভার্চুয়াল হাসপাতাল’টি অবশ্যই দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের মাধ্যমে মানসম্মত ও বিশেষায়িত প্রাণিস্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকল্পে কাজ করবে এবং প্রাণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অনলাইন ভেটেরিনারি হাসপাতাল বাংলাদেশে সম্পূর্ণ একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ যা প্রাণিস্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব রওনক মাহমুদ তার বক্তব্যে বলেন “দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাণিস্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। অন্যদিকে এই করোনাকালীন সময়ে প্রাণীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আরও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘অনলাইন ভেটেরিনারি হাসপাতাল’ এমনি একটি প্লাটফর্ম যা কিনা সাধারণ ফোনকলের মাধ্যমে খামারিদের সেবা নিশ্চিত করে, তা যুগোপযোগী এবং অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে।” অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ডাঃ আবদুল জব্বার সিকদার তার বক্তব্যে বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ খাতে দিন দিন তরুণ প্রজন্মের খামারিরা যুক্ত হচ্ছে। প্রাণিস্বাস্থ্য সেবায় প্রযুক্তির এই ব্যবহার তরুণদের আরও উদ্বুদ্ধ করবে।”

অনলাইন ভেটেরিনারি হাসপাতাল “প্রাণিসেবা ভেট” এর লক্ষ ও উদ্দেশ্য হলো, প্রাণিস্বাস্থ্য সেবায় সহজ প্রবেশাধিকার, মেডিসিনের ব্যবহার, ১০০% অভিজ্ঞ চিকিৎসক নির্ভর, এন্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় অপব্যবহার রোধ ও নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ নিশ্চিতকরণ। সর্বোপরি প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের মিশন এবং ভিশন বাস্তবায়নে একসাথে কাজ করা। এছাড়াও, খামারিরা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে শুধুমাত্র একটি ফোনকলের সাহায্যে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি সার্জনগণ কর্মরত থাকলেও গ্রামে-গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষকের গোয়ালের গরু, ছাগল, ভেড়া এবং খোয়াড়ের হাঁস-মুরগী যথাযথ চিকিৎসা খুবই দূরহ কাজ। এছাড়া সরকারী সহযোগিতা ও পরামর্শে প্রতিটি গ্রামেই ছোট-বড় অসংখ্য ডেইরী বা পোল্ট্রি খামার গড়ে উঠেছে। সদিচ্ছা থাকলেও জনবল সংকট ও সময়ের সংক্ষিপ্ততার কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠা ঐ খামারগুলোতে জেলা-উপজেলায় কর্মরত ভেটেরিনারিয়ানগণ উপস্থিত হয়ে নিয়মিত সুচিকিৎসা প্রদান করতে পারেন না। ফলে অনেক সময় প্রয়োজনের তাগিদে ভেটেরিনারি হাসপাতালের কর্মচারীরাও চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত হয়। ফলে গবাদিপশুর যথাযথ চিকিৎসা দিতে না পারায় বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়। এন্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় অপব্যবহার বাড়তে থাকে। প্রাণিকুলের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে, প্রাণীগুলো দুর্বল হয়ে যায়। এজন্য দুধ ও দুধ থেকে পণ্য উৎপাদন, প্রস্তুতকরণ ও বাজারজাতকরণ ব্যাহত হয়। মুরগীর বাচ্চা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ছোট খামারগুলো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের গ্রামের দুর্গম এলাকা সমূহে অসংখ্য গরীব কৃষক নিজঘরে বা ঘরের দরজার সামনে একটা ছাউনি দিয়ে একটি বা দুইটি গরু-ছাগল লালন-পালন করেন। উদ্দেশ্য, গরুটি বড় করে উঁচু দামে বিক্রয় করে ভাঙ্গা ঘরটা মেরামত করবেন ও মেয়ের বিয়ে দিবেন বা এক খণ্ড আবাদি জমি কিনবেন বা বন্ধকী জমিটা মুক্ত করে নিজ চাষের আওতায় আনবেন। দুর্গম এলাকার গরুর মালিকের মূল্যবান প্রানীটি অসুস্থ হলে উপজেলা সদরের ভেটেরিনারি হাসপাতাল থেকে সেই দুর্গম এলাকায় পৌছুতে ঘণ্টার পর ঘণ্টার সময়ের প্রয়োজন হয়। ফলে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় ‘কোয়াক’ ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল হতে হয় অথবা বিনা চিকিৎসায় গরুটি মারা যায়। নিঃস্ব হয়ে গরীব কৃষক। তাই এমন দুর্গম এলাকার কৃষক বা খামারির জন্য ঘরে ঘরে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অনলাইন ভেটেরিনারি হাসপাতাল এর স্বাস্থ্যসেবা সুফল বয়ে আনবে। আর এতে অর্জিত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন।

প্রাণিকূলের বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগ রয়েছে যাতে আক্রান্ত হওয়ার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রানীটি মারা যায়। ইচ্ছা থাকলেও চলাচলে অক্ষম প্রানীটি নিয়ে উপজেলা সদরে ভেটেরিনারি হাসপাতালে আনা সম্ভবপর হয় না। এমতাবস্থায় যথাযথ চিকিৎসার জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ জরুরী। এক্ষেত্রে অনলাইন ভেটেরিনারি হাসপাতালের চিকিৎসা অপরিহার্য। করোনা’র সংক্রমণ রোধে যখন সারাদেশে লকডাউন চলছিল, মানুষ ঘরের বাহির হত না, কেনাকাটা, চিকিৎসা ও অন্যান্য জরুরী কাজে প্রযুক্তি নির্ভর অনলাইন ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে, সেসময়ে প্রাণীর জরুরী চিকিৎসা এবং প্রানীসম্পদের যথাযথ উন্নয়নের জন্য মৎস্য ও প্রানীসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রানীসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে সারাদেশে অনলাইনে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে টেলিমেডিসিনে ৫০ লক্ষ গবাদিপশু ও ৩.৫১ কোটি হাঁস-মুরগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়। করোনাকালের অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ‘অনলাইনে ভেটেরিনারি চিকিৎসা সেবা প্রদান’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে সেবা প্রদানে প্রতিযোগিতা বাড়বে, সেবার মান উন্নত হবে, কর্মচারী নির্ভর চিকিৎসা বন্ধ হবে, খামারীর গবাদিপশু-হাঁস মুরগী সুস্থ থাকবে, অধিক পরিমাণ মাংস, দুধ, ডিম উৎপাদন হবে। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, জনগণ সুস্থ থাকবে।

লেখক: ভেটেরিনারিয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :