ভণ্ডবাবা-পীরদের রুখবে কে?

প্রকাশ | ২৯ অক্টোবর ২০২০, ১২:১৮

মজিব রহমান

রাষ্ট্র ও সমাজে গির্জার তীব্র প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য খ্রিষ্টধর্ম সংস্কারের দাবি উঠে। ৫০০ বছরেরও আগে অর্থাৎ ১৫১৭ সালে মার্টিন লুথারের ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরম্ভ হয়। এই আন্দোলনের বস জাগতিক পরিস্থিতি ধর্মসংস্কারকে প্রায় অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। এই আন্দোলনের সাফল্যে প্রটেস্টান্ট ধর্মের উৎপত্তি ঘটে।

এতে পুরোহিত শ্রেণির বিত্তসম্পত্তি, ভোগবিলাস ও ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের অন্যতম দাবি ছিল ঈশ্বরের বিকেন্দ্রীকরণ! মানে হলো- ব্যক্তি ও ঈশ্বরের মধ্যে পুরোহিত শ্রেণির দালালির কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষের সরাসরি যোগাযোগ থাকবে ঈশ্বরের সাথে। বাইবেল পাঠ ও আরাধনার মাধ্যমে মানুষ নিজেই ঈশ্বরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে। অর্থাৎ পোপেরও প্রয়োজন নেই।

ইসলামধর্মে এখন পীরপন্থা এবং আরও বহুপন্থা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। হিন্দুধর্মেও বাবারা জাঁকিয়ে বসে আছে। বাবা-পীররা বংশ পরম্পরায় জনগণের টাকায় থাকছে আরাম-আয়েশে। ভারতে দেখছি ভণ্ডবাবাদের আখড়ায় হাজার হাজার যৌনদাসী। তাদের রক্ষার জন্য থাকে নিজস্ব বাহিনী। আমাদের পীরদের অনেকেই বহুবিবাহ করেন। তাদের আঙিনায় স্থাপন করেন প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে যারা থাকে তারা পীরদের রক্ষা করে। এ যেন আলাদা একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা! ট্যাক্সের মতোই জনগণের কাছ থেকে, জনগণকে বিভ্রান্ত করেই হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

যারা দরিদ্র মানুষকে যে দানখয়রাত করতো তাও এখন চলে যায় ওই মধ্যস্থতাকারীর পকেটে। একেকজন পীরের দরগায় জমে কোটি কোটি টাকা। প্রটেস্টান্ট পন্থাও কিন্তু খ্রিষ্টধর্মের অসারতার বিপরীতে খুব বেশি কিছু করতে পারেনি, সে লক্ষ্যও ছিল না। তবে সেই আন্দোলন ইউরোপের রেনেসাঁয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই পুনর্জাগরণের ধারায় বিজ্ঞানের উত্থানই আজ ইউরোপে খ্রিষ্টধর্ম আস্তে আস্তে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ এবং হাজী শরিয়তুল্লাহরা প্রভাবশালী হয়ে উঠায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়রা ইংরেজ ঘনিষ্ঠ ও ধর্ম ঘনিষ্ঠ থাকায় দক্ষিণ এশিয়ায় ইউরোপের কয়েক শ বছর পরেও নবজাগরণ ঘটলো না। হিন্দুদের মধ্যে অসংখ্য স্বামী/বাবাদের উত্থান ঘটলো আর মুসলিমদের মধ্যে উত্থান ঘটলো পীরদের। সমাজ চলে গেল তাদের নিয়ন্ত্রণে। আজ গ্রামে গ্রামে তরুণ থেকে বৃদ্ধরা বছর ধরে টাকা জমায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান করার জন্য। অসংখ্য সংগঠনও গড়ে উঠেছে যারা পূজা-পার্বণের আয়োজন করে, কীর্তন/শোভাযাত্রা/ভগবৎ পাঠের আয়োজন করে। পীরদের রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক সংগঠনে জড়িয়ে থাকে। পীরগণ সেই সংগঠনের ব্যানারেই ধর্মসভায় হাজির হয়। পীরদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সরকারের জন্য খুবই দরকার। সরকার সময়মতো তাদের হাতে টাকা পৌঁছে দিলেই হলো।

গত নির্বাচনে কয়েকজন পীরের রাজনৈতিক দলকে কিনে ফেলতে দেখা গেল। ধর্মাশ্রয়ী সংগঠনগুলো বাস্তবিক জনমানুষের স্বার্থে কখনোই থাকে না। তারা রাজনীতিও করে নিজের স্বার্থে, অর্থবিত্তের জন্য সেই প্রমাণই হয়েছিল। বাবা/স্বামী ও পীরগণ একটি অন্ধ ও বদ্ধ সমাজ তৈরি করে রেখেছেন।

আমাদের উপজেলা শ্রীনগরে এক দাদার কাছে যখনই জানতে চাই, কেমন আছেন? তিনি বলেন, ‘বাবা যেমন রেখেছেন!’ তিনি প্রতি বছরই একাধিকবার ভারতে যান ওই বাবার দর্শনে, অর্থ-কড়ি দিয়ে আসতে। বাবাই যেন তাকে ভালো রেখেছে! অথচ তাঁর হার্টে সমস্যাসহ অনেক সমস্যা রয়েছে যার চিকিৎসা নেন ডাক্তারের কাছ থেকে। তারা সমাজে একটা বিজ্ঞানবিরোধী পীর/বাবাময় ভাবাদর্শ গড়ে তুলেছে।

সমাজে এই ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। অথচ আমরা ধর্মানুযায়ীই বলতে পারি, সমাজে ধর্ম পালন করার জন্য মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের দরকার নেই। ব্যক্তি ও স্রষ্টার মধ্যে বাবা/পীর/স্বামী শ্রেণির দালালির কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষের সরাসরি যোগাযোগ থাকবে স্রষ্টার সাথে। এখন বাংলাতেই ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও আরাধনার মাধ্যমে মানুষ নিজেই স্রষ্টার সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জন্য এ জরুরি কথাটিও বলার কেউ নেই।

লেখক: সভাপতি, বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ

ঢাকাটাইমস/২৮অক্টোবর/এসকেএস