লীলাবতী ললিতাকে লেখা কবিতা

প্রকাশ | ০৪ নভেম্বর ২০২০, ১০:৪৭ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২০, ১০:৫০

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

সে দিনের কথা মনে আছে লীলাবতি?

আমাদের অলৌকিক অভিসারে নির্দোষ লীলার বিহারে

শাখায় শাখায় আশিস বিলিয়ে ওষুধি-বনস্পতি,

আমাদের প্রমত্ত প্রেমে দেখালো কী-সব তেলেসমতি!

 

যে দিন শ্রাবণমুখর সন্ধ্যায় 

সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা’য়

পত্র পল্লবের বোঁটায় বোঁটায়

টাপুর টুপুর বৃষ্টির ফোঁটায়

মোহন সুরের মূর্চ্ছনা ছড়িয়ে দিলো

আলো-ছায়ার আবেশ যোজনায়।

 

সে দিনই তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা

অবশ্য এর আগেও হয়েছে চোখে চোখ রাখা;

সে সব চোখাচোখি কোনক্রমেই দেখা নয়,

বলতে পারো গ্রন্হের প্রচ্ছদ পরিচয়;

তিন শ’তেত্রিশ পৃষ্ঠার পুরো বইটাই বাঁকি;

না পড়ে কেবল উদাস মনে চোখ বুলিয়ে রাখি।

 

সে অর্থে নীপছায়ায় দুজনের হাতে হাত;

বলতে পারো, দেখার মতো দেখা’র সেদিনই সূত্রপাত।

 

চকোরিয়ার চারুঘাটে কেতকি কদমতলে

পায়ে পায়ে জলকেলি দিঘির কাজলা জলে;

কে আকুল করেছে বেশি- কদম না কেয়া?

আমরা জানিনি, জেনেছে নজরের খেয়া।

সে খেয়ায় পারাপার হলো কী-না মন,

সে খবর রাখাটা কি খুউব প্রয়োজন?

পারের কড়িই গেছে রসাতলে যার,

তার আবার কোন খেয়া,কোন পারাবার?

 

মমতার জলস্নাত কদম-কেয়ার কী মৌমিতা সুবাস!

তুমি আর আমি ছাড়া, জানো লীলা! 

সুবাসের গভীর দীর্ঘশ্বাস।

ফুলের সুবাস আর আমাদের শ্বাস,

একাকার না হলেতো অকালেই প্রেমের বিনাশ।

 

আকুল ভাবনায় কে ছড়ালো গনগনে আগুন

সে কি নীপতরুর পেলব প্রসূন!

নাকি, আমাকে তোমাতে ভোলানো

যমুনার জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া কূল!

 নাকি, তনুর তরঙ্গে দোল-দোলানো

‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’!

 

ঠিক কে পেয়েছিল আমার অবুঝ ভালোবাসা, বল তো?

ঠিক কে চেয়েছিল আমার অবুঝ ভালোবাসা, বল তো?

 

জানি, বরাবরের মতই গদ্য রীতিমতে স্পষ্ট করে

জবাব দেবে না তুমি।

গদ্যের বিপরীতে পদ্য হলেও হয়তো-বা বোঝা যেত কিছু;

কিন্তু না; গদ্যে নয়, পদ্যে নয়, 

তোমার জবাব কবিতায়;

আর কবিতার ভাবে জবাবের জবা কালেভদ্রে কলি ফোটালেও

আঁধফোটা ফুলও ফোটায়নি যুগ-যুগান্তে,  

কাল-কালান্তে, কিংবা সত্তর বসন্তে।

 

তবুও প্রাপ্তি ছিল সেই অর্থহীনতায়;

সব অর্থ কি পাওয়া যায় অর্থবোধকতায়!

বলো তো লীলা !

অর্থ খুঁজলে কোন প্রেম অর্থবাচক হয়? 

আমাদের  যেমনটা বিশ্বাস;

প্রেমের অর্থ ভাষায় থাকেনা 

থাকে মর্মবোধের ভিন্ন মাত্রায়,

কিংবা, সেই মুলুকে অন্তহীন অভিযাত্রায়।

 

কিন্তু দেখো, কী কদর্য বাস্তবতা!

প্রেমেও আজকাল পদ্যের পেলবতা চায় না মায়ামন বিহারি,

কবিতার সরসতা চায় না প্রেমের বেরসিক বেপারি,

নিহিতার্থকে গিলে খায় বহিঃরঙ্গের কুহেলি বাহার ,

এভাবেই সভ্যতা হয় অভব্যের অকিঞ্চন আহার।

গদ্যের গদার ঘায়ে ঘাড় ভাঙলেও ঘায়েল হয় না নন্দদুলাল,

কারণ জলবৎ তরলং; কালটা যে ঘোর কলিকাল।

 

বাঁশে এখন হয়না সুরের ডাকাতিয়া বাঁশি 

বরং ডাকাতির কাজে সদর্প লাঠি হয় দস্যুর পেশিবহুল হাতে, 

মেতে উঠে  অসহায় গৃহকর্তার সাথে তাকে নিঃস্ব করবার 

পৈশাচিক সংঘাতে।

 

অথচ দেখো, কী আশ্চর্য লীলাবতী; ললিতা আমার!

আমরা দুজন ভুবনে ভুবনে  কত প্রেম করেছি শুমার।

প্রেমের অবারিত প্রান্তর তবুও বিরান ধু-ধু বালুচর ,

কাব্যের নকশি কাঁথার মাঠে শ্বাপদ সরীসৃপ বাঁধিয়াছে ঘর।

কাব্যের জলসা এখন পেঁচা আর বাদুরের বাড়ি,

কবিতার চুলোয়  আর চড়েনা তো হাড়ি। 

উনুনে আরামে ঘুমায় বিশ্বাসি বিড়াল,

জানিনা ভাসাবে কারে স্রোতে মহাকাল?

 

কবিতার ভিটায় খোশখেয়ালে ঘুঘু চড়ে

কোলা ব্যাঙ পড়ে থাকে  চিৎ হয়ে মরে।

চিকা-চামচিকে খেলে গোল্লাছুট মাঠে

পরিত্যক্ত কুঞ্জের শেওলার চৌকাঠে।

 

কিন্তু হায়!

কবিতার কোমল জমিন বাদে 

কোথায় আর প্রেম উপ্ত হবে,লীলা?

বীজের জন্যে চাই পলিমাটি

কতটুকু কাজে আসে পাললিক শিলা?

 

ব্যূহভেদ করে কেমন করে মন যাবে বাইরে গোলকের?

কদম-কেয়া’রা কেমন করে অংশি হবে প্রেমের পুলকের?

 

কী আর বলবো লীলা!

দিন-দিনান্তে কত আর সহ্য হয় এতো মাজা-ঘষা ,

গোলেমালে দিন যায় কিছুতেই পাই না ভরসা।

প্রেমের ভবিতব্যে দেখি অনিবার ঘোর দুর্দশা!