মায়ার টানে ফোটা ছায়া

দীলতাজ রহমান
 | প্রকাশিত : ০৪ নভেম্বর ২০২০, ১৫:২৭

বাও-বাতাস কিচ্ছু নেই। তবু কী একটা ঝুপ করে পড়লো সামনে। একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো হিরু। মাথা নিচু করতেই শিউরে উঠলো সে- কোনো পাখির ছানা হবে ভেবে। শরীরে এখনো পালক ওঠেনি। ধরতে ওর নিজের শরীর ঘিনঘিন করে। তবু চিঁ চিঁ শব্দ শুনে মন কেমন করে ওঠে। ও দু’হাতের থাবায় পুরে ছুটে দৌড় দিতেই চতুর্দিক থেকে অসংখ্য কাক কায়া-কায়া-কাস্বরে ওকে ঘিরে ফেলে। কয়েকবার মাথায় ঠোকরও খেয়েছে সে। হিরু কোনোরকম চোখ বাঁচিয়ে ঘরে এসে ওঠে। একটা ঝুড়ি দিয়ে ছানাটিকে ঢেকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। ততক্ষণে কাকের সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে। উঠোন থেকে ঘরের চাল পর্যন্ত কাকদের দাপাদাপি। তারস্বরে কানের তালা খুলে যাওয়ার দশা। হিরুদের একটুখানি ঘরের পুরনো ঝরঝরে টিনের চালের ওপর বড় একটা আমগাছ। তার ডালপালাও ছেয়ে কালো হয়ে গেছে কাকে। আরো দু-চারটি করে অনবরত উড়ে উড়ে আসছে। ও ঘরের মধ্য থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটু উঁকি দিয়ে দেখে অবাক হয়, পৃথিবীর সব কাক মিলেও এত্তোগুলো হতে পারে এটা ও আগে কল্পনা করতে পারেনি।

অবস্থা বেগতিক দেখে কৌতূহলী মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। কিন্তু হিরু চিঁ চিঁ বাচ্চাটির চিন্তায় ধুকপুকাচ্ছে। এটাকে এই শত্রুদের কবল থেকে বাঁচাতেই হবে। সে পানিভর্তি ছোটো একটা বাটি ঝুড়ির নিচে রাখে। একটু পরে পাতিল থেকে নিয়ে আবার কটা ভাত ছিটিয়ে দেয়। বন্ধ দরজার ওপাশে লঙ্কাকাণ্ড তাকে ছানাটির প্রতি মমতা তরতর করে বাড়িয়ে তোলে। বুকের ভেতর সে এই প্রথম একটা সুখ অনুভব করে। কাউকে ভালোবাসার সুখ! প্রয়োজন হলে ছানাটির জন্য সে আর দরজাই খুলবে না। একা একে লালন করবে। এখনি একটি খাঁচার প্রয়োজন অনুভব করে হিরু। বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা দাদির খালুইটিকে এ ব্যাপারে তার মোক্ষম মনে হয়।

প্রতিবেশী ছেলেমেয়েগুলো খুব উপভোগ করছে কাকের ক্ষুব্ধ উৎপাত। কুলক্ষণ মনে করে বড়রা কেউ কেউ মুখ বাড়িয়ে কাক দঙ্গলের প্রতি দূর্ দূর্, তফাৎ যা! কথা উচ্চারণ করে চলে যাচ্ছে যে যার কাজে। কিন্তু বন্ধ ঘরে ভেতর নিশ্চুপ হিরুর কাণ্ড-কারখানা কেউই আঁচ করতে পারছে না। একসময় নড়বড়ে দরজায় টোকা পড়তেই হিরু চমকে ওঠে। দরজা খুলতেই দাদি ঘরে ঢোকে। চিঁ চিঁ শব্দ শুনে বিষয়টি টের পেয়ে ঝুড়ি তুলে রেগে উঠে বলে- এইডা কী?

হিরু কিছুটা নিচুস্বরে বলেÑদাদি এইডা আমি টোকাইয়া পাইছি। পাঁজি কাকগুলো এইটারে খাওনের লাইগা এমুন ভিড় করছে। তুমি ওগোরে ঠেকাও।

দাদি হিরুকে এমনিতে খুব ভালো চোখে দেখে না। বুড়ির আরো অনেক ছেলেমেয়ে, নাতিপুতি আছে। হিরুর মায়ের সাথে তার বাবার বনিবনা হতো না। মাকে বাবা যৌতুকের জন্য প্রায়ই মারধর করতো। মা ফিরে এলে আবার তাড়িয়ে দিতো। একটা সময় মার সাথে বাবার ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়। নানার অবস্থা ভালো না। নানাও ওর মাকে উপদ্রবের মতো মনে করতো। মা হিরুর জন্য হিরুর বাবার কাছে খোরপোষ দাবি করে কোনো কাজ হতো না। গ্রাম্য সালিশেরাও একপেশে আচরণ করতো। সেই কবেকার কথা। হিরুর একটু একটু মনে পড়ে, তারা বলতো, ঠিক আছে, যার পোলা তারে দিয়া দাও! সে যেমনে পারে মানুষ করুক। তাইলে তো আর তোমার ঝামেলা থাহে না। খোরপোষ না দিতে পারলে কী করবা?

হিরুকে বাবা একদিন ওর মার কোল থেকে জোর করে নিয়ে আসে। মায়ের সেকি বুকভাঙা কান্না। হিরু আজো সে শব্দ শুনতে পায়। সে বোঝে তার নিজের কান্নার শব্দ থেমে গেলেও মায়ের কান্নাটা থামেনি। নদী দেখলে, বৃষ্টি নামলে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। যখন তখন চোখে দিয়ে পানি গড়ায়। বুকের মধ্যে দমটা অনেক সময় আটকে থাকতে চায়। তাই তো সে প্রায়ই একা একা এখানে-ওখানে চুপ করে বসে থাকে। সবসময় খেলা করতে, ভিড়ের মধ্যে থাকতে তার ভালো লাগে না। মাকে সে দেখে না অনেকদিন। দাদি বলে ওর মা যাওনের সময় ওর বয়স তখন চার বছর আছিলো।

সেই যে বাবা তাকে কেড়ে এনেছে, তারপর থেকে তার মা ওকে দেখতে এসেছে শুনলে ওকে কাউকে দিয়ে কোথাও লুকিয়ে রাখা হতো। প্রথম প্রথম বুঝতে পারতো না হিরু। পরে বাড়ি ফিরে এলে বেফাঁস কারো কারো কথা থেকে বুঝতে পারতো, ওর মা ওকে দেখতে এলে ওর দাদি আর বাবা মিলে মা’কে তাড়িয়ে দিয়েছে। অন্য কারো ঘরে আশ্রয় নিলেও টেনে হিঁচড়ে বের করে একেবারে গ্রাম ছাড়া করে তারপর হিরুকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে। তাই বলে বাবা আর দাদি হিরুকে যত্ন করে মানুষ করেছে তাও নয়। বরং মায়ের ওপরের রোষটা কিল-থাপ্পড়ে ওর ওপর উসুল করেছে। মায়ের প্রতি এই নিষ্ঠুর আচরণের হিসাব কষে সে মনে মনে বাবাকে তার বেইমান মনে হয়। কারণ বাবা তাকে ভালোবাসলে তার মাকে কেন অত্যাচার করতো? বাবা মা’কে মারলে যে তার কষ্ট হয় এটা কেন বোঝে নাই?

ঢাকার যাত্রাবাড়ী বাজারে ওর বাবার সবজির দোকান। রোজগার ভালোই। ওর বাবা আবার বিয়ে করেছে। সৎ মা ওকে ভালো চোখে দেখে না। নিজের ছেলেমেয়ের চেয়ে ওকে খেতেও দেয় কম। দাদি অবশ্য এ নিয়ে বাবাকে নালিশ করে। তাতে একটু আধটু যে অশান্তি হয়, পেটে খিদে থাকলেও হিরুর তা ভালো লাগে না। ও দোকানে বাবার পাশে বসে সবজি বিক্রি করতে বাবাকে সাহায্য করে। আর হঠাৎ হঠাৎ ওর মাকে মনে পড়ে। হিরুর মনে হয় মা ওকে ভুলে গেছে। না হলে এখন তো দেখা করতে আসতে পারতো। এখন সে ঠিকই মায়ের সঙ্গে চলে যেতে পারতো। বাবা ঠেকালে লুকিয়ে যেত। ও এখন অনেক দূর একাই চিনে চলে যেতে পারে। ওর বয়স এখন আট। দাদি বলেছে। দাদি ঢাকায় গিয়ে এবার ওকে সঙ্গে করে গ্রামে বেড়াতে নিয়ে এসেছে। বাবা এলে আবার চলে যাবে। কারণ ওকে দিয়ে নাকি দোকানে বাবার অনেক সাহায্য হয়। বাবার মুখ ফসকে অনেকদিন হিরু শুনেছে-‘পোলা দেইখ্যাই তো লইয়াইছি। মাইয়া অইলে কেডায় আনতো... য্যায় বিয়াইছে হ্যাঐ পালতো!’

দাদি ছানাটা দেখেই হুংকার দিয়ে ওঠেÑড্যাকাইত্যা পোলা, এর লাইগ্যাই তো বাড়ি বইরা গ্যাছে কাউয়ায়! শিগগির মাটিতে নামাইয়া দিয়া আয়। গরের চাল উড়াইয়া লইয়া গেলো। এর লেইগ্যাই তো কই কাউয়ায় বাড়িগর বইরা গ্যাছে ক্যা? বাড়িগর কালা অইয়া গেছে!

হিরু ব্যাকুল হয়ে বলেÑদাদি এইডা কাউয়ার ছাও তুমি বুঝলা কেমনে?

Ñএইডা কাউয়ার ছাওই! তুই দেহছ না ওইডারে নেওনের লাইগা সব একজোট অইয়া আইছে। অইডারে না ছাইড়া দিলে সব কাউয়ায় মিল্যা তোরে চোউখ আর গায়ের মাংস খুবলাইয়া খাইয়া ফেলবো। তাড়াতাড়ি কইরা ছাড়...।

হিরু নির্ভীক কণ্ঠে তবু বলেÑনা দাদি এইডার লাইগ্যা আমি কয়দিন ঘরতন বাইর অমু না। এইডারে আমি বড় করমু। বড় অইলে, উড়তে শিখলে ছাইড়া দিমু। কথা দিলাম। ওই কাউয়া এইডারে পালতে পারবো না।

Ñকাউয়ার বাচ্চা কাউয়া পালতে পারবো না, তুই পারবি?

Ñহ, পারমু। আর এইডা তো উড়তে পারে না, ও ওগো লগে যাইবো কেমনে?

Ñতুই এইডারে বাইরে রাইখা আয়, তারপর দেখ ওর মা ওরে ঠোঁটে কইরা তার বাসায় লইয়া যাইবো। সন্তান এই দুনিয়ায় সব চাইতে মায়ের কাছেই ভালো থাকে। সন্তানরে মা-ছাড়া করতে নাই... মায়রে সন্তান-ছাড়া করতে নাই... আল্লার অভিশাপ লাগবো। যা বাই, যা বাচ্চাডারে ছাইড়া দিয়া আয়। হিরুর ভাষা বদলে যাওয়া চোখের দিকে না তাকিয়েই দাদি ঝপ্ করে ছানাটা বারান্দার কোণায় এনে রাখে। সাথে সাথে একটা কাক নেমে এসে তাকে ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে গেলো। এতে হিরু আশ্চর্য হয়ে যায়। ভাবে, ওই কাকটাই ছানার মা!

অল্পক্ষণের মধ্যেই খালি হয়ে গেলো উঠোন, ঘরের চাল।

চালের ওপরের বড় আমগাছটা। কিন্তু হিরুর মাথাটা ভরে গেলো অন্যরকম ভাবনায়। দাদি আজ তার সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। তার একটু একটু মনে পড়তে থাকে বাবা প্রথম যখন তাকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে আসে, তখন ট্রেনে করেই এসেছিলো। আনার সময় কাকের মতো বড় না হোক, একঝাঁক মানুষ তার নানার উঠোনেও ভরে ছিলো। কিন্তু তার মাকে কেউ সন্তান বুকে ধরে রাখতে সাহায্য করেনি। মায়ের পক্ষে কেউ কথা বলেনি। আজো তো কেউ মা’য়ের কথা বলে না! ঝাপসা একটা ছায়াছবির মতো স্পষ্ট হতে হতে আবার মিলিয়ে যায়। মাকে কাছে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছে ছাড়া মায়ের কাছে পৌঁছানোর শক্তি তার নেই। তবু হিরু স্টেশনের দিকে দৌড়াতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো ট্রেনের যাওয়া-আসা ঘটলো তার চোখের সামনে।

সে আর কাউকেই বিশ্বাস করে না। ট্রেন যদি তাকে ভুল করে অন্য কোথাও নিয়ে যায়? রংপুর থেকে দিনাজপুরের ট্রেন কোনদিকে যায়, এটুকু জেনেই হিরু রেল লাইনের নিচে পাতা কাঠের সি পারের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকে।

অন্তহীন সে যাত্রায় চোখের সামনে মায়ের মুখ ছাড়া সে আর কিছু দেখতে পায় না। একই পথে যাতায়াতে সে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে অবতীর্ণ হয়। ট্রেনে এটা ওটা বিক্রি করতে করতে ওই পথের সব ফেরিওয়ালা তার আত্মীয় হয়ে ওঠে। বাবার সঙ্গে যোগাযোগটা অব্যাহত না হলেও, থাকে। থাকে না কেবল মায়ের ঠিকানা। বহুবার, বহুস্থানে খুঁজতে গিয়ে দেখেছে, সব সূত্রই ছিন্ন। শেকড় ঘিরে ঝরা পাতার ওড়াউড়ির মতো পান সিগারেটের বাক্স কাঁধে হিরু তাই রংপুর থেকে দিনাজপুর রেল স্টেশনের মাটি প্রতিদিন একবার করে ছোঁয়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

ঢাকাটাইমস/৪নভেম্বর/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :