স্বাধীনতার কবিতা

নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া
| আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৪৬ | প্রকাশিত : ০৭ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৩৮

গোমতী নদীর দখিন বাঁকে জোড়পুকুরের গাঁ,​

সেই গাঁয়ের এক জীর্ণ ঘরে কাঁদছে রাজুর মা।

রাজু-যে তার ঘর ছেড়েছে শূন্য মায়ের বুক,

চোখ জুড়ে তার স্বপ্ন ছিলো স্বাধীনতার সুখ।

দেশ বাঁচাতে যুদ্ধে গেছে ঘরকে করে পর,

স্বাধীনতার সাজ বেহুলা, রাজু লখিন্দর।

কখন যে তার খোকন সোনা ফিরবে মায়ের বুকে,

পথ চেয়ে মা’র দিন কেটে যায় ভাত রোচে না মুখে।

গাঁয়ের মেঠো পথ জুড়ে তার চোখ দু’খানি জাগে,

তার খোকনের পায়ের আওয়াজ নিত্য কানে লাগে।

ঐতো বুঝি রাজু এলো ডাকলো মা-মা বলে,

সোহাগ ভরা আদর নেবে জড়িয়ে মায়ের গলে।

আনমনা হয় একটু যদি খোকার ছায়া ভাসে,

তার মমতার বাহুর ডোরে খিলখিলিয়ে হাসে।

চেতন ফিরে আসলে বুঝে মনের ভীষণ ধোকা,

এই ছায়াতো মায়ার ছায়া নয়তো মায়ের খোকা।

মনের ছবি ছায়ার বেশে মায়ার সাথে খেলে,

কোথায় পাবে তার রাজুকে কোন দেশেতে গেলে?

খোকন গেছে কোন সুদূরে কোন সাগরের পাড়?

যতোই ভাবে ততোই বাড়ে মায়ের ব্যথার ভার।

‘খান সাহেবের পুত্তুর এলো বিলেত থেকে ঘুরে,

আমার রাজু বাস করে কি তার চেয়েও দূরে?

কেমন করে খোকন বুকে পাষাণ বেঁধে রাখে,

একটু বুঝি হয় না মনে তার দুঃখিনী মাকে?

ময়নামতির মায়ের সাথে কথাও হলো পাকা,

বউ সাজিয়ে তুলবে ঘরে যতোই লাগুক টাকা।

জমি জিরাত নাইবা থাকুক গতর খেটে রাজু,

আনবে কিনে ঢাকাই শাড়ি, সোনার বালা-বাজু।

অঘ্রাণে সে ফিরবে বাড়ি বাঁধবে নতুন ঘর,

ময়নামতি সাজবে কনে, সাজবে রাজু বর।’

এমনি করেই ভাবনা ভেবে দিন কেটে যায় মা’র,

মায়ের মনে নিত্য জমে রোদন-হাহাকার।

হাঁড়ির মাঝে রাখলো তুলে লাল-সিঁদুরে আম,

রাখলো সাথে এক পুটুলী পাকা কালোজাম।

কালো গাইয়ের দুধ রেখেছে মিষ্টি ভারী সর,

মুড়ির মোয়া, গুড়-পাটালী, নাড়– থরে থর।

বানায় কতো সাজের পিঠা নকশী আঁকা ফুলে,

সবার চোখের আড়াল করে সিকেয় রাখে তুলে।

দুঃখী মায়ের শোকের ভেলা চোখের জলে ভাসে,

আশায় আশায় প্রহর গোনে; রাজু কি আর আসে!

দিন গড়িয়ে রাত্রি আসে রাত পোহায়ে দিন,

তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে আয়ু-যে তার ক্ষীণ।

চোখের নীচে জমলো কালি কমলো চোখের জ্যোতি,

শোকের সাথে ধরলো রোগে, মন্দ হলো মতি।

পথ চেয়ে আর কেঁদে কেঁদে অন্ধ হলো চোখ,

পথের মাঝে রাজুতো নেই পথিক হরেক লোক।

ফজর আলীর ঘরের কোণের আঁধার আঙিনায়,

বিবিজানের রোদন-বিলাপ নিত্য শোনা যায়।

গাঁয়ের পথে যাচ্ছে শোনা কিসের কোলাহল,

বিজয় বেশে ফিরলো বুঝি মুক্তি সেনা দল।

কেউবা বলে রাজ এসেছে কেউবা বলে রাজু,

বিষাদ-পালা শেষ হলে মা’ হর্ষে কাঁদে আজো।

রাজুর মায়ের অন্ধ দু’চোখ দেখবে কেমন করে?

তার ছেলে যে ফিরলো গাঁয়ে বিজয় মালা পরে।

ওঠোন জুড়ে ভিড় জমালো গাঁয়ের নর-নারী,

অশ্বদিয়ার হাট জমেছে ফজর মিয়ার বাড়ি।

শহীদ হলো যুদ্ধে রাজু, ফিরলো হয়ে লাশ,

হায়রে বিধি কেমন তোমার নিঠুর পরিহাস!

দীর্ঘ হলো শোকের মিছিল বাতাস হলো ভারি,

ঘরে ঘরে আকাশ-কাঁপা আর্তি-আহাজারি।

জীবন মরণ খোদার হাতে বিধান বিধাতার,

রাজুর মা’কে প্রবোধ দেবে সাধ্যি আছে কার?

বুক ভাসে তার চোখের জলে নাইরে শোকের শেষ,

তার বিষাদের অশ্রুবানে ভাসছে সারাদেশ।

আঁচল কি আর রুখতে পারে চোখের জলের ধারা,

বালির বাঁধে যায় কি বাঁধা সাগর পাগলপারা!

আর্তনাদে মূর্ছা গেলো ‘রাজু-রাজু’ বলে,

মাটির কোলে আছাড় খেয়ে ধরলো রাজুর গলে।

বুকের মাঝে ধরলো চেপে খোকার সোনা মুখ,

সব হারানোর শোকের মাঝে একটুখানি সুখ।

বক্ষ-ফাটা কান্না মায়ের হঠাৎ গেলো থেমে,

ঝড়ের পরে শান্ত যেমন সুপ্তি আসে নেমে।

মরণ মা’রও কাড়বে জীবন জানতো কি তা কেহ?

কাতর হলো কন্ঠ মায়ের, নিথর হলো দেহ।

জোড়পুকুরের পূর্ব পাড়ে বাঁশ বাগানের ছায়,

রাজুর মা আর রাজু ঘুমায় নিঝুম নিরালায়।

এক কবরে রাজুর মা আর পাশের গোরে রাজু,

শোকের গাথায় সব পথিকের অশ্রু ঝরায় আজো।

রাজুর মা আর রাজুর জীবন এমনি হলো শেষ,

আমরা পেলাম এক পতাকা আর এক স্বাধীন দেশ।

রাজুর মা আর রাজু পাবে যোগ্য প্রতিদান,

আমরা যদি রাখতে পারি দেশ-পতাকার মান।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :