খানসামার জয়িতাদের জীবনযুদ্ধের গল্প

নুরনবী ইসলাম, খানসামা (দিনাজপুর)
 | প্রকাশিত : ০৭ নভেম্বর ২০২০, ১৮:৪৬

মানুষের জীবনে চলার পথে আসে নানা ধরনের বাধা। কিন্তু তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে? অনেকেই আছেন যারা সব বাধা মোকাবেলা করে এগিয়ে যান সামনের দিকে। অর্জন করেন সফলতা। হয়ে উঠেন একজন সংগ্রামী জয়িতা। নিজের অদম্য মনোবলকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে জয়িতারা সমাজে নিজের জায়গা তৈরি করেন।

দিনাজপুরের খানসামায় এমনই তিন নারী যারা সব ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সফল হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সমাজে ‘জয়িতা’ নামে।

সফল মা হিসেবে কুলছুমা বেগম, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী স্বপ্না রাণী রায় এবং নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন প্রতষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে মুক্তারিনা বেগম জয়িতা নির্বাচিত হন।

তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ মহিমায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এই জয়িতাদের জীবনের গল্প শুরু অনেক দুঃখ-কষ্ট ও অভাব-অনটনের মধ্যে। প্রতিটি ক্ষণে বেড়ে উঠেছেন সংগ্রাম করে। সংসার, স্বামী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে অতি দুঃখ-কষ্টে তাদের দিন কাটাতে হয়েছে। জীবনের প্রয়োজনে তারা বিভিন্নভাবে ছুঁয়েছেন সফলতার স্তর।

চুরির অপবাদে বের হওয়া কুলছুমা

এদের মধ্যে সফল মা কুলছুমা বেগম উপজেলার আঙ্গারপাড়া ইউনিয়নের ইছামতি শাহপাড়া গ্রামের মৃত শুকর আলীর স্ত্রী। অপ্রাপ্ত বয়সে সাধারণ কৃষক পরিবারে কুলছুমা বেগমের বিয়ে হয়। বিয়ের ১৪ বছরের মধ্যে তিনি চার ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তানের মা হন।

কুলছুমার বড় ছেলের বয়স যখন ১৩/১৪ বছর তখন তার স্বামী মারা যায়। স্বামী মারা যাবার পর যৌথ পরিবারে তার সাত সদস্যের পরিবারকে বোঝা মনে করে। এরপর সুপরিকল্পিতভাবে চুরির অপবাদ দিয়ে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত এক খন্ড আবাদি জমি দিয়ে তাদের পৃথক করে দেয়া হয়।

কম বয়সী ছয়জন ছেলে-মেয়ে নিয়ে কুলছুমা বেগম খুব বেকাদায় পড়েন। পরে জীবন-জীবিকা নির্বাহের একমাত্র সামান্য কৃষি জমি, নিজের গহনা বিক্রি করে এবং প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। ধানের ভাপাই করে নিজের পায়ে ঢেঁকিতে চাল করেন। সেই চাল বড় ছেলের সহায়তায় বাজারে বিক্রি করেন। এভাবে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করেন ছেলে-মেয়ে নিয়ে।

সময়ের ব্যবধানে তার সন্তানরাও বড় হতে থাকে। ছেলেবেলা থেকেই সন্তানদের লেখাপড়ায় খুব আগ্রহ থাকায় নিজে অশিক্ষিত হওয়ার পরও সন্তানদের পড়াশোনার জন্য ধানের ভাপাই ব্যবসার পাশাপাশি হাঁস-মুরগী পালন ও বর্গা পদ্ধতিতে গরু-ছাগল পালন করেন। পরে তার বড় ছেলে শামসুল হক পরিণত বয়সে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের খানিকটা দায়িত্ব নিয়ে ভাই-বোনদের পড়াশোনার অর্থ যোগান দেন।

বর্তমানে কুলছুম বেগমের চার ছেলের প্রথম তিন ছেলে শিক্ষকতা করেন এবং ছোট ছেলে বেসরকারি কোম্পানিতে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। এছাড়া দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে গৃহিণী ও ছোট মেয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে চাকরি করেন। তার সংসারে এখন আর কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। বর্তমানে সন্তানাদি নিয়ে সুখে-শান্তিতে জীবন-যাপন করছেন।

রক্তের স্বজনদেরও বোঝা ছিলেন স্বপ্না রানী

আরেকজন জয়িতা অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী স্বপ্না রানী রায়। তিনি পাকেরহাট জেলে পাড়ার ধীরাজ রায়ের স্ত্রী। ১০ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় ধীরাজ রায়ের সঙ্গে। তার স্বামী মায়ের সূত্রে এক আত্মীয়ের সহায়তায় পাকেরহাটে চায়ের দোকানে শ্রমিকের কাজ করে সংসার পরিচালনা করেন।

যদিও তখন স্বপ্না রানী সংসারের কিছুই বুঝতেন না। স্বামীর নিজস্ব কোনো বসতবাড়ি না থাকায় স্বামী-স্ত্রী উভয়ে স্বপ্নার বাবার বাড়িতে বসবাস করেন। বিয়ের পাঁচ বছর পর স্বপ্নার প্রথম সন্তান জন্ম হয়। এরপর তার ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী তাদের বাড়তি বোঝা মনে করে। তাদের অসহায়ত্ব দেখে একই পাড়ার এক প্রতিবেশী তাদের আশ্রয় দেন।

স্বামীর কাজের পাশাপাশি স্বপ্না রায় কানের দুল বিক্রি করে মাত্র ৬০০ টাকা দিয়ে ঘরের এক পাশে দোকান করে পাউরুটি, বিস্কুট, চকলেট, পান সুপারি ও সাবান বিক্রি শুরু করেন। তাদের এ কষ্ট দেখে স্বপ্না রায়ের বাবা-মা আড়াই শতাংশ জমি তার নামে লিখে দেন।

সময়ের ব্যবধানে স্বপ্নার আরো দুই মেয়ে সন্তান হওয়ায় সংসারে অভাব অনটন বাড়ে। এক সময় তার বাবার পাওয়া জমি বিক্রি করে ব্যবসা শুরু করেন। পরে ব্যবসা লাভজনক হলে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা বড় করেন। বর্তমানে জায়গা কিনে পাকা বাড়ি করেছেন। একইসঙ্গে তার সন্তানেরাও পড়াশোনা করছেন। তিনি বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।

সন্তান হারা মুক্তারিনা বেগম

আরেকজন জয়িতা হলেন মুক্তারিনা বেগম। তিনি নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার বাবা পেশায় শিক্ষক। আর মা গৃহিণী। নয় ভাই-বোনের মধ্যে মুক্তারিনা সপ্তম। তার বাবা শিক্ষকতা করলেও সন্তানদের লেখাপড়ায় কোনো আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু মুক্তারিনা বেগম বাবা-মায়ের বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে টিউশনি করে অর্থ উপার্জন করে এসএসসি পাশ করেন।

এর মধ্যে মুক্তার বাবা-মা তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু সে চাপ উপেক্ষা করে টিউশনির পাশাপাশি ব্র্যাকের এনএফপি প্রোগ্রামে স্কুল পরিচালনা করে অর্থ উপার্জন করে। এইচএসসি পাশ করে বিএসএস অধ্যয়রনত অবস্থায় ব্র্যাক মাইক্রোফিনেন্সে চাকরি নেন। ২০০৮ সালে সেখানকার তার সহকর্মী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

বিয়ের কিছুদিন পর অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারিজনিত কারণে মুক্তার স্বামী চাকরিচ্যুত হয়ে আত্মগোপন করেন। পরে সেই অর্থ মুক্তারিনার কাছে থেকে নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করলে তিনি অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর তাকেও তার পাওনা দুই লাখ ৬৭ হাজার টাকা দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়।

সময়ের ব্যবধানে মুক্তা এক ছেলে সন্তানের মা হন। কিন্তু তার স্বামী তাদেরকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তালবাহানা ও গরিমসি করেন। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনও করা হয় মুক্তাকে। এক সময় স্ত্রী ও ছেলের স্বীকৃতির দাবিতে স্বামীর বাড়িতে অনশন করেন। এতে মুক্তার শ্বশুর-শাশুড়ি প্রথমে পুত্রবধূ হিসেবে অস্বীকৃতি জানালেও পরে প্রতিবেশীদের চাপে বাধ্য হন স্বীকৃতি দিতে। কিন্তু তার সঙ্গে ‘কাজের মেয়ের’ মতো আচরণ করতেন পরিবারের লোকজন।

জমি লিখে দেয়ার নাম করে মুক্তার চাকরিচ্যুতির সময় পাওয়া টাকা আত্মসাৎ করেন মুক্তার স্বামী ও শাশুড়ি। এর প্রতিবাদ করায় মুক্তাকে ডির্ভোস দেন স্বামী। মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করা হয় মুক্তার তিন বছরের সন্তানকে। পরে মুক্তা তার বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু প্রতিবেশী, আত্বীয়-স্বজন ও ভাই-ভাবিদের কটূক্তি ও তিরস্কারে বাধ্য হয়ে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ঢাকায় চলে যান। সেখানে বেসরকারি স্কুলে চাকরি ও সাংবাদিকতা শুরু করেন।

এতে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বচ্ছলতা ফিরে এলেও ফেলে আসা অতীতের নির্যাতনের বিভীষিকা, শিশু সন্তানের সঙ্গে স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলোর কথা এবং তাকে কাছে না পাওয়ার বেদনা সারাক্ষণ পীড়া দেয় মুক্তাকে। প্রকিকূলতাকে জয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

খানসামা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কার্যক্রমটি খুবই ভালো উদ্যোগ। উপজেলার বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা এই তিনজন শ্রেষ্ঠ জয়িতার জীবন কাহিনী পড়ে আমাদের নারী সমাজ উৎসাহিত হবে এবং এভাবেই নারীর ক্ষমতায়ন হবে।

(ঢাকাটাইমস/৭নভেম্বর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :