কতিপয় পোশাক বিভ্রম

জিনিয়া ফেরদৌস রুনা
 | প্রকাশিত : ০৮ নভেম্বর ২০২০, ১৪:৩০

পরিচয় শুধু পোশাকে থাকে না। আচরণ, মানসিকতা, শিক্ষা, কর্মকাণ্ড সবকিছু মিলে একজন মানুষ। ধর্ম, বর্ণ, জাতি যার যার কিন্তু মানুষের পরিচয় একটি যে সে শুভ-সুন্দরের প্রতীক। কেউ মাথা ঢাকেন, কেউ খোলা রাখেন। কেউ আপাতমস্তক আচ্ছাদিত করেন। কেউ সাধারণ গেটআপে চলেন। কেউ ফ্যাশন করেন। কেউ সেকেলে পোশাক পছন্দ করেন। কেউবা সব ধরনের পোশাক পরে থাকেন। এটা রুচি, পছন্দ, তার সুবিধার কথা ভেবেই পরেন। তাতে আপত্তি করার কি আছে।

পরিবার, দেশ ও দশের কথা ভেবে আমরা চলি। সমাজে যেটা দৃষ্টিকটু, পথে যা বেমানান সেটা না পরলেই হলো। ধর্ম আমাদের চোখ খুলে দেয়, একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে বলে। জীবনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের মেধা, মনন জাগ্রত রাখা উচিত। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নয়। মানুষের জন্য ধর্ম প্রতিবন্ধক নয় সেভাবে। তাহলে এক ধর্ম আরেক ধর্মের বিনাশ করে ফেলত! আরশ থেকে বজ্রপাত হয়ে একে অন্যকে ধ্বংস করত!

স্বনামধন্য কোনো পুরুষ খেলোয়াড়, শিল্পী, গুণীজন যখন নিজেকে প্রকাশ করেন সেখানে সাধারণ মানুষ তার গুণের চেয়ে বাহ্যিক পোশাক, বিশেষত সঙ্গী, স্ত্রীর পোশাক, দেহের গঠন নিয়ে রুচিহীন আলাপে মত্ত হয়! মহিলা যেন তার চাচাতো বোন বা চুরির দায়ে দোষী গৃহকর্মী! যে যেভাবে পারে জিহবা দিয়ে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখতে শুরু করে, সাথে সাথে তার বেহেশত, দোজখ নিয়ে যারপরনাই উৎসাহী হয়ে পড়ে! গায়ে মানে না আপনি মোড়ল! মেয়েদের আনন্দ, সুখ, সাফল্যে অনেক পুরুষ কখনো মহিলারাও হতাশ, হিংসুক আচরণ করেন। কি ভয়ানক!

দেশে দেশে কত রকম সমস্যা আছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা, সমাধানে কথা ও কাজ দরকার। সেসব বাদ দিয়ে শুধু মেয়েদের পোশাক নিয়ে এই শতাব্দীতেও কত লোকজনের কত রকম অতিউৎসাহী হীনম্মন্যতা ভাবলে অবাক লাগে! আর শালীনতা কি শুধু মেয়েদের পোশাকের ভাঁজে লেগে থাকে? না। মোটেও নয়। ভদ্রতাসূচক মানদণ্ড পুরুষ, নারী সবার জন্য আছে। পুরুষ অশালীন পোশাকে আসলেও সেটা দৃষ্টিকটু, অগ্রহণযোগ্য। ধর্মের লেবাস নিয়ে যদি অন্য কারও ক্ষতি, সমস্যার কারণ হোন তাহলে ধর্ম কোনো কাজে আসবে না। স্রষ্টা এত ক্ষুদ্র নন যে তিনি পোশাকে আবদ্ধ রইবেন। আপনার দায়িত্ব, কর্তব্য এড়িয়ে পোশাকের গুণে পুলসিরাত পার হতে পারবেন না। নো ওয়ে!

বলা বাহুল্য, আমাদের নতুন প্রজন্ম পছন্দ করছে ধর্মীয় পোশাক, কেউ কেউ পাশ্চাত্যের পোশাক। সেটা নিয়ে আনন্দিত হতে পারি না সবসময়। কারণ কিছু অপরাধ ঘটতে দেখি এই সব পোশাক পরা অবস্থায়। দেহকে ঢাকলেও মনেপ্রাণে তারা আধুনিক, ধার্মিক কোনোটাই হতে পারছে না। আগ্রাসী সমাজের কুটিলপথে তারা আপাতদৃষ্টিতে লাভজনক জনপ্রিয় হওয়ার নেশায় জড়িয়ে ফেলছে সর্বনাশের জটিল জালে! আমরা তাদের সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত না করে, সাংস্কৃতিক শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে, মানবিক শিক্ষাকে অবমূল্যায়ন করে কেবলই ফাঁকিবাজি শেখাচ্ছি।

তরুণী একজনের লাইভ শুনছিলাম আর ব্যথিত, ক্ষুব্ধ হচ্ছিলাম। সে তার কাজের পথে টেম্পোতে আরেকজন যাত্রী দ্বারা কীভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে! তার অপরাধ সে লম্বা গেঞ্জি, ডিভাইডার, ওড়না পরে এসেছে; এসব পোশাকে রাস্তার লোকজন নাকি আরও লোভী হয় নারীর প্রতি! প্রকাশ্যে টেনে-হিঁচড়ে মেয়েটিকে আঘাত করেছে বোরখা পরা সেই নারী। অনেকে দেখেছে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি রক্ষা করতে। হয়তো মেয়েটির প্রতিপক্ষের লোকজন সেখানে ছিল। তাদের নীরব সমর্থনে সে আরও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা ভেলকি দেখতে ওস্তাদ! নীরবে কাউকে অত্যাচারিত হতে দেখলে আমরা মনে হয় বেশ মজা করে দেখি কীভাবে, কত জোরে, কি কি অশ্রাব্য খিস্তি করছে!

যদি পোশাক কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারত তবে উপাসনালয়গুলোতে কখনোই শারীরিক, মানসিক অত্যাচারের কাহিনি ঘটত না। পোশাকের চেয়ে প্রয়োজন মানসিকভাবে প্রস্তুত করা যেন ঘরে, কর্মক্ষেত্রে, পথে নিজেকে রক্ষা করতে পারে নারী কিংবা পুরুষ। পোশাকে মানুষের রুচিশীলতা, নান্দনিকতা, ঐতিহ্য, জাতীয়তা প্রকাশ পায়। নানা দেশের নানান মানুষের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবিও পাওয়া যায় পোশাকের ধরনে, বর্ণে, বিচিত্রতায়। পোশাকের আচ্ছাদনে মনুষ্যত্ব কখনো ঢাকা পড়ে না; একই রক্ত-মাংসের নর-নারী আচরণে, কৃতকর্মে এই নতুন বিশ্বে সর্বোত্তম হয়েই জাগরুক থাকে। মানবতার দ্বীপশিখা মানুষের হাতেই জ্বলে! জ্বলবেই।

লেখক: আবৃত্তিশিল্পী ও লেখক

ঢাকাটাইমস/৮নভেম্বর/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :