নেয়ামত ভূঁইয়া’র কবিতা: খাঁচার পাখির গান বসন্ত আনে না
কালের কীলক আঁটা যাদুঘরের এক কোণে অনাদরে পড়ে থাকা
লাল মলাটের সেই মোটা বইটা খুলে দেখি
পাতায় পাতায় প্রস্থানের পদচিহ্ন;
অক্ষর শব্দ বাক্য সবি হাওয়া, লাপাত্তা।
পাতা জুড়ে কেবল দাঁড়ি কমা সেমিকোলন হাইফেন
প্রশ্ন আর বিস্ময়সূচক কতগুলো যতি চিহ্নের মাতম;
পরিত্যক্ত কুরুক্ষেত্রে যেনো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে
ঘৃণার কালি আর অপ্রাসঙ্গিকতার জংয়ে ধরা
অবসন্ন বর্শা বল্লম তীর ধনুক তলোয়ার।
অথচ এককালে শব্দেরাই ছিলো এই চিহ্নগুলোর প্রাণ-ভোমরা
যারা কিনা হালের হাওয়ায় পাখি হয়ে উড়ে গেছে দিক-দিগন্তরে
ভর করেছে ‘কি চেয়েছে’, ‘কি দিয়েছে’ আর ‘কি পেয়েছে’র
কাউন্টিক মেশিনের রিবনে।
কিন্তু না,সেখানেও শকুনি মামার কূটচাল,পাশবিক পাশা খেলা,
দুর্যোধনের অধর্মাচার , ধৃতরাষ্ট্রের অনৈতিক রাষ্ট্রধৃতি ;
মাধবের ধর্মস্থাপনা যেনো মর্ত্য মুলুকে শৈবিক বিড়ম্বনা।
পূঁজির পাজির পাতায় পাতায় ছড়ি আর চাবুকের খাতে
মস্ত অঙ্কের দাপট; আহরণের অহংকার,
বিপরীতে ঘাম অশ্রু আর রক্ত প্রবাহের খাতে
কারবালার হাহাকার; শূন্যের শূন্যতার।
নিরুপায় পাখিরা তাই গতিপথে আনে নতুন গতি
পথে আনে বৈচিত্র্য, বন্ধুত্বের বৃত্ত করে বিস্তৃত
পরিযায়ীর মতো ডানা মেলে অনুকূল অজানায় পাড়ি জমায়।
জগতের সব পাখির ঠোঁটে ঠোঁটে তুলে দেয় সেই গান
পাখিরাও যার যার তল্লাটে ছড়িয়ে দেয় সে গানের দ্যোতনাঃ
‘ খাঁচার পাখির গান হোক যতো মনকাড়া সুরেলা মধুর
করুক যতোই মোহন সুরের যোজনা,
সেই গান প্রকৃতিতে কোনো কালেই বসন্ত আনে না।’
সেই থেকে বইয়ের পাতারা যতোবার হিংসার আগুনে পুড়ে যায়
ততোবারই শব্দগুলো অক্ষত রয়ে যায়।
ওরা পাখি হয়ে উড়ে যায় চঞ্চল ডানায়
গান হয়ে সুর বাঁধে একতারা দোতরায়
কবিতা হয়ে স্বপ্ন বিলায় পত্র-পল্লবের পদ্যে
ছন্দ হয় মরমী গানের পালায়
রিনিঝিনি নিক্বণ হয় প্রিতমের কাঁকন পায়েলে
ঝাঁজালো মিছিলের স্লোগান হয় উত্তাল রাজপথে
সমবেত গণসংগীত হয় বঞ্চনার খেদে
রজ্জবি আর রজ্জার মনের কথা হয় কলিজার ভাষায়।
বইয়ের মলাটের শিকলে যে কথার পায়ে বাঁধা বেড়ি
মতবাদে পিষ্ট হয়ে মরে তিলে তিলে
সে আর মুক্তি দেবে কোন অভাজনে
তারই নিজের যদি মুক্তি না মিলে!
যে নিজেই ডুবে আছে স্বখাত সলিলে,
মুক্তি মিলবে না কারো সে নিদান গিলে।
তাই সেই পাখিদের মুক্ত গানের রেশে
পথ হারিয়ে ছুটে যেতে চাই মুক্তির মঞ্জিলে।