মুক্তাচাষে সফলতার পথে তারেক

মনিরুজ্জামান, রাজবাড়ী
| আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২০, ১৫:২৯ | প্রকাশিত : ১৬ নভেম্বর ২০২০, ১৫:২৭

শখের বশেই পুকুরে মুক্তা চাষ শুরু করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমান তারেক। আভিজাত্য ছড়ানো এই রত্নটি চাষ করে সবাইকে চমকে দিতে নিজের বাড়ির পুকুরে মাছের পাশাপাশি মুক্তা চাষ শুরু করেছেন তিনি। তবে তার এ শখ পরিনতি পায় বাণিজ্যে।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে নিজের চাষের মুক্তা বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি করা যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের কালিচরণপুর গ্রামের এ বাসিন্দা। এরই মাঝে দেশের ও বিদেশের বেশ কিছু কোম্পানি তার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।

এখন তিনি পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে নেমেছেন মুক্তা চাষে। মুক্তা উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষি ও মৎস্য ক্ষেত্রে বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি। এবং এ স্বপ্নে সাফল্য পেতে যাচ্ছেন তিনি।

জানা গেছে, ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন সাজ্জাদুর রহমান তারেক। চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন তিনি। রসায়ন বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমবিএ করেছেন ফ্যাশন ডিজাইনে। ল্যান্স করপোরাল হিসেবে কর্মরত তারেক ২০১৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। দেড় বছর আগে নিজেদের এক একর আয়তনের পুকুরে মাছের পাশাপাশি মুক্তা চাষের উদ্যোগ নেন।

সাজ্জাদুর রহমান জানান, গহনা হিসেবে মুক্তার কদর রয়েছে বিশ্বে। প্রাকৃতিক মুক্তার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে পুকুরে ঝিনুকে মুক্তা চাষ শুরু হয়েছে। তাই মুক্তা চাষকে প্রসারিত করার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে তার। এর মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, বেকারত্ব দূর হবে। মুক্তা জাপানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি করা যায়। বাংলাদেশ ও ভারতে মুক্তার সুন্দর ডিজাইন হয়। বিদেশে এর প্রচুর চাহিদাও রয়েছে।

তিনি জানান, আপাতত তার সঙ্গে একজন কাজ করছেন। তবে বড় আকারে চাষাবাদ করতে গেলে প্রচুর শ্রম দিতে হবে। আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে এর ফল পাওয়া যাবে। জেলা মৎস্য অফিস থেকে এ ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। মুক্তা চাষে জেলার অন্য কেউ এগিয়ে এলে তিনিও তাদের সহযোগিতা করবেন।

সাজ্জাদুর রহমান তারেক জানান, তাদের গ্রামে অনেক পুকুর। গ্রামটি মৎস্যগ্রাম হিসেবে বেশ পরিচিত। গার্মেন্টস ও কনজুমার ব্যবসার সুবাদে প্রায়ই ভারতে যাতায়াত করতে হয় তাকে। ভারতের এক বন্ধুর পরামর্শে দেড় বছর আগে তিনি শখের বশে মুক্তা চাষে উৎসাহিত হন। তখন রংপুর, নীলফামারী ও কুয়াকাটা গিয়ে মুক্তাচাষিদের কাছ থেকে এ সম্পর্কে ধারণা নেন। পরে ভারতের মুক্তা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও নেন। দেড় বছর আগে বাড়ির পাশে নিজের পুকুরে মাছের পাশাপাশি মুক্তা চাষের অনুশীলন শুরু করলেও ছয় মাস আগে মাঠে নেমেছেন সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে। রাজবাড়ী জেলায় তিনিই প্রথম মুক্তা চাষ শুরু করেছেন বলে দাবি করেন।

গত মার্চ মাসে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা চাষ শুরু করেন তিনি। নিজের এক একর পুকুরে ১৪ হাজার ঝিনুকে মুক্তা চাষ করেছেন।

তিনি জানান, এই মিঠা পানিতে তিনি সাত হাজার ঝিনুকের মধ্যে ১৪ হাজার মুক্তা চাষ করছেন। একেকটি মুক্তার জন্য প্রয়োজন হয় একেকটি নিউক্লিয়াস, যা ভারত থেকে কেনা হয়। এই নিউক্লিয়াস ইনজেকশনের মাধ্যমে ঝিনুকের মধ্যে ইনজেক্ট করা হয়।

ইনজেক্ট করা ঝিনুক একটি কক্ষে সাত থেকে ১০ দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। ঝিনুকগুলো বাঁচিয়ে রাখতে দিতে হয় বিশেষ ওষুধ। তার পরও কিছু ঝিনুক মরে যায়। বেঁচে থাকা ঝিনুকগুলো জালের মধ্যে ঢুকিয়ে বোতল দিয়ে বেঁধে পুকুরে ফেলা হয়। যাতে ঝিনুক মাটিতে না পড়ে যায়। এভাবে এক বছর রাখার পর ঝিনুকের মধ্যে পরিপূর্ণতা পায় মুক্তা।

তিনি আরও জানান, প্রতিটি ঝিনুকের জন্য খরচ হয় ১০০ টাকা। যেহেতু গ্রোথ ভালো হচ্ছে, এজন্য তিনি ঝিনুক থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই মুক্তা সংগ্রহ করার আশা রাখেন।

সাজ্জাদুল রহমান বলেন, ‘২০১৮ সালের দিকে আমি ভারতের একটি মুক্তা গবেষণা কেন্দ্র (সেপা) থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর স্বপ্ন দেখি নিজের পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি মুক্তা চাষের। ২০১৯ সালের ১৪ হাজার ঝিনুকের মাঝে মুক্তা চাষ শুরু করি। প্রথমে স্থানীয় বিভিন্ন পুকুর থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করি। এরপর ঝিনুককের মধ্যে ডাইজ স্থাপন করা হয়। এরপর টিস্যু প্রতিস্থাপন করে বিভিন্ন ধরনের নিউক্লিয়াস পদ্ধতিতে মুক্তা চাষ শুরু করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঝিনুক সাধারণত শীতকালে পাওয়া যায়। তবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকায় তারেক স্থানীয়ভাবে এক লাখ ঝিনুক সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করছেন আগামী বছর চাষ করার জন। মুক্তা চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বাড়তি কোনো খরচ ও ঝুঁকি নেই। মাছের দেওয়া খাবার খেয়েই বেঁচে থাকে ঝিনুক। বর্ষায় পুকুর ভেসে গিয়ে মাছের ক্ষতি হলেও ঝিনুক ভেসে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।’ প্রথমে নয় লাখ টাকা দিয়ে মুক্তার চাষ শুরু করেন তিনি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে তার চাষকৃত মুক্তা পরিপক্কতা পাবে। ১৪ হাজার ঝিনুকের মধ্যে ১০ শতাংশ ঝিনুক মারা গেছেও বলে জানান তিনি।

সাজ্জাদুল রহমান জানান, প্রতিটি মুক্তার বাজার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি শেষে দিকে ২৫ লাখ টাকার মুক্তা বিক্রি করতে পারবেন বলে প্রত্যিাশা করছেন তিনি।

এ বিষয়ে আলিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত হাসান বলেন, ‘আমি খোঁজ-খবর রাখছি সাজ্জাদুলের মুক্তা চাষ নিয়ে। এখন যে পর্যায়ে রয়েছে আগামী ফেব্রুয়ারি বা মার্চে সে ব্যাপক লাভবান হবে। সে আর্থিকভাবে লাভবান হলে আলিপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন পুকুরে মৎস চাষের পাশাপাশি মুক্তার চাষ শুরু করা হবে।’

তারেকের চাচা আমিনুর রহমান বলেন, ‘মুক্তা চাষের পেছনে তারেক প্রচুর শ্রম দিচ্ছে। তার স্বপ্ন সফল হলে রাজবাড়ী জেলার মানুষের উপকার হবে। অন্যরা মুক্তা চাষে এগিয়ে আসবে। বেকারত্ব দূর হবে।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়েদেব পাল বলেন, ‘আমি এখানে যোগাদানের পর সাজ্জাদুল রহমানের মুক্তা চাষের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। আমরা মৎস্য বিভাগ থেকে তাকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। তার স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের পথে।’

জয়েদেব পাল জানান, রাজবাড়ী জেলায় সাজ্জাদুর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি যিনি মুক্তা চাষ করছেন। বিশ্বব্যাংক তাকে আর্থিক সহায়তা হিসেবে রাজবাড়ী মৎস্য বিভাগের মাধ্যমে চার লাখ ৮৫ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে। এছাড়া জেলা মৎস্য অফিস থেকে মুক্তা চাষে আগ্রহী যে কাউকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১৬নভেম্বর/পিএল)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :