রাজধানীতে ছিনতাই চক্র: পর্ব-১

তাদের টার্গেট ছিনতাই, কাজ হলে জোটে ইয়াবা

প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০২০, ১০:১৫ | আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২০, ১৪:৫১

আল-আমিন রাজু

সাভারের ফুলবাড়িয়া থেকে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন সুমাইয়া আক্তার নামের এক তরুণী। ডাক্তার দেখিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে বাড়ি ফেরার বাস ধরতে দাঁড়ান হাসপাতালের বিপরীত দিকে। বাসে উঠেই তিনি বুঝতে পারেন তার কাঁধব্যাগে মোবাইলফোনটি নেই।

মোবাইলফোন চুরি হয়েছে নিশ্চিত হয়ে তড়িঘড়ি বাস থেকে নেমে রাস্তাতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সুমাইয়া। তার সঙ্গে থাকা বান্ধবীর মোবাইলফোন থেকে নিজের নম্বরে বারবার ফোন করেও কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন।

গেল বুধবার দুপুরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে সুমাইয়ার যখন ছিনতাই হয়, তখন এই প্রতিবেদক সেখানে ছিলেন। সুমাইয়ার কাছে পুরো ঘটনা শুনে ওই সময়ে একই পয়েন্ট থেকে রিকশায় উঠে পালানোর সময় এক কিশোরীকে দাঁড় করান প্রতিবেদক। জেরার একপর্যায়ে আনুমানিক ১৭ বছর বয়সী সুখি (ছদ্মনাম) নামের ওই কিশোরী স্বীকার করেন সুমাইয়ার মোবাইলফোন তিনিই চুরি করেছেন। পরে এই প্রতিবেদকের মাধ্যমে ফোনসেটটি ফেরত পান সুমাইয়া।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, হৃদরোগ, কিডনি, পঙ্গু ও শিশুসহ একগুচ্ছ হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মানুষের সমাগম হয়। হাসপাতালগুলোতে যেতে দূর-দূরান্ত থেকে এসে তাদের নামতে হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনের সড়কে।

চিকিৎসাপ্রত্যাশী কিংবা স্বজনদের নিয়ে আসা এসব মানুষকে ঘিরেই এই এলাকায় সক্রিয় একাধিক ছিনতাই চক্র। এমনই একটি চক্রের হয়ে ছিনতাই করেন সুখি। এই প্রতিবেদকের প্রশ্নে সুখি জানান, তিনি চার বছর ধরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল এলাকায় ছিনতাইয়ের কাজ করছেন। সঙ্গে তার নানিও একাজে জড়িত। আর তারা মামুন নামের একজনের হয়ে ছিনতাই করে আসছেন। তার মতো অন্তত ২০ জন শিশু-কিশোর ও নারী সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সামনের এলাকায় ছিনতাইয়ে জড়িত।

সুমাইয়ার মোবাইল ছিনতাইয়ের পরদিন এই প্রতিবেদক বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত প্রতিদিন অর্ধবেলা ওই এলাকায় পার করেন। দেখা গেছে, হাসপাতাল পল্লীতে আসা নানা জায়গার অজস্র মানুষের কারও না কারও সুমাইয়ার মতো মোবাইলফোন, স্বর্ণালঙ্কার কিংবা টাকা খোয়া যাচ্ছে। চিকিৎসা নিতে বা অসুস্থ স্বজনকে দেখতে এসে অনেকেই আবার সর্বস্ব হারাচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থাকা ৬০ ফিটের একটি রাস্তা পার হতে গিয়ে টার্গেট করা ব্যক্তিকে ছিনতাই চক্রের একজন গায়ে ধাক্কা মারে। পরে আরেকজন সেই সুযোগে চোখের পলকে ছিনতাই করে সটকে পড়ে। এরপর রাস্তার উল্টোদিকে তড়িঘড়ি কোনো বাসে উঠে পড়ে।

সুখির দেয়া তথ্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঢাকা টাইমস নিশ্চিত হয়েছে, শেরে বাংলা নগর ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘিরে ছিনতাইয়ের একাধিক বড় চক্র রয়েছে। এই চক্রের সদস্যদের প্রধান টার্গেট হাসপাতাল থেকে বের হওয়া সাধারণ মানুষ। হাসপাতালের কাজ শেষে রাস্তা পার হওয়ার সময় এই চক্রের সদস্যরা অভিনব কায়দায় হাত বা কাঁধে থাকা ব্যাগ থেকে মোবাইল টাকা পয়সা উঠিয়ে নিয়ে যায়।

কখনো কখনো সঙ্গে থাকা ব্লেড দিয়ে ব্যাগের তলা কেটে ছিনতাই করে থাকে। শুধু সোহরাওয়ার্দীর সামনের রাস্তায় এ চক্রের ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য কাজ করে থাকে। এদের মধ্যে শিশু, কিশোর, তরুণী এমনকি মধ্যবয়সী নারীও আছে। এদের প্রায় সবাই আগারগাঁও-মিরপুর এলাকায় বাস করে।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, চক্রের সদস্যরা ছিনতাইয়ের পরে দ্রুত এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বেশিরভাগ সময়ে ব্যবহার করে রিকশা। এই রিকশার চালকও আবার এই চক্রের সদস্য। ছিনতাইয়ের পরে চক্রের সদস্যদের নিরাপদে সরিয়ে কোথায় নিয়ে যেতে হবে সেটি আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। রিকশাচালকও ছিনতাইয়ের টাকার ভাগ পায়।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের গেটের সামনে বসা হকারদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন হাসপাতালের মেইন গেটের সামনেই অন্তত ৩০টি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে সড়ক পার হতে ৩ থেকে ৪ জন ব্যক্তি জড়ো হলেই চক্রের সদস্যরা ছিনতাইয়ের টার্গেট করে।

সুখি জানায়, সে মামুন নামে একজনের হয়ে কাজ করে। কাজ না করলে মারধর করে। আর ছিনতাই করতে পারলে পাঁচশ-এক হাজার টাকা আর সেবনের জন্য ইয়াবা জোটে। চক্রটিতে শিশু থেকে নারী সবাই মাদকাসক্ত। চক্রটির প্রধান মামুন সম্পর্কে সুখি জানান, সে খুব বেপরোয়া স্বভাবের। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে খালি সিম বদলায়। কেউ কাজ করতে না চাইলে বেদম মারধর করে। একবার সুখিরও মাথা ফাটিয়ে দেয় মেরে। ব্লেড দিয়ে শরীরে টান মারে। মামুন থাকে আগারগাঁও এলাকার পাসপোর্ট অফিসের আশপাশ এলাকায়। দিনের বেলা মামুন তার চক্রের সদস্যরা ঠিক মতো কাজ করছে কি না তা তদারকির পাশাপাশি আগারগাঁও এলাকায় ইয়াবাসহ মাদক বিক্রি করে বলে জানায় সুখি।

(ঢাকাটাইমস/১৮নভেম্বর/ডিএম/জেবি)