করোনাভাইরাস শরীর-মন দুটোকেই ক্ষত করে দেয়

প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৪১

আমিনুল ইসলাম

করোনা থেকে আরোগ্য লাভের সপ্তাহ দুয়েক পর তার বুক যেন চেপে আসছিল। মনে হচ্ছিল কয়েক টন পাথর যেন তার বুকে কেউ বেঁধে দিয়েছে অথবা কেউ লেপ্টে দিয়েছে সিমেন্ট- আগের মতো আর বুক ভরে শ্বাস নিতে পারে না। গলাব্যথা, মুখ শুকিয়ে যায়, হাত-পা ঝিঝি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, বসা থেকে দাঁড়ালে বা একটু পরিশ্রম করলে বুক ধড়ফড়ানি, রাতে ঘুমের দৈন্যদশা, কখনো ঘুমের মধ্যে যেন পানিতে ডুবে যাচ্ছে এমন দমবন্ধ অবস্থা। এ এক বিষণ্নকারী দশা।

কিছুদিন ভালো থাকার পর আবার তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সামান্য হাঁটাতেই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। সে ভেবে পায় না আবার আগের জীবনটা ফিরে পাবে কি না। কোনো ইনফেকশন আর নেই তবু রোলার কোস্টারের মতো এই ভালো এই খারাপ জীবনটা যেন সঙ্গী হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ ঠিকঠাক হাঁটতে পারে, কাজ করতে পারে তো পরের সপ্তাহেই আবার কাত। ইলেকট্রিক সুইচের মতো অন-অফ যেন জীবনের অন্য দ্যোতনা হয়ে গেছে।

সুগার, কোলেস্টেরল, প্রেসার আগে সব স্বাভাবিক ছিল, করোনার পর এলোমেলো। ইসিজিতে হার্টের ছন্দ স্বাভাবিক থাকে না সব সময়। হার্ট রেট এমনকি দেড়শ-দুইশ হয়ে যায় হঠাৎ করে, এমনকি সুস্থ হয়ে যাবার কয়েক মাস পরেও অক্সিজেন স্যাচুরেশন কিছুটা কমতে থাকে বিশেষ করে বসা থেকে দাঁড়ালে। মাথা হঠাৎ হালকা লাগা, মনঃসংযোগের সমস্যা, স্মৃতিভ্রষ্টতায় হঠাৎ করেই মন-মস্তিষ্ক যেন ধোঁয়াশায় ঢেকে যায়।

বিশ্বব্যাপী এমন এক উদ্বিগ্নতা কাজ করছে যে মহামারি চলে যাবার পরও কোনো কোনো কোভিড সারভাইভারকে ‘এ অনন্ত সংশয়ে আর পারি না ঝুজিতে’ এর মতো সংগ্রাম করে যেতে হবে। কেউ জানে না কতদিন।

রোগটি এতই নতুন- এর দীর্ঘমেয়াদি ফল কি হবে এ নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকার দূর হয়ে যায়নি এখনো। প্রলম্বিত সমস্যাগুলোর জন্য কাউকে আইসিউতে যাওয়া বা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকতে হবে ব্যাপারটা তেমন নয়। মৃদু সংক্রমণের পরও কেউ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার ফাঁদে পড়তে পারে।

সব ভাইরাল মহামারির পরই কিছুই দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত থেকে যায়। ২০১৪-২০১৬ এর ইবোলা মহামারির পর পশ্চিম আফ্রিকানদের মধ্যে দুর্বলতা, মাথাব্যথা, গা ব্যথা, জয়েন্ট পেইন, স্মৃতিভ্রষ্টতা, ঘন ঘন প্রস্রাব- এই ৬টি সমস্যা দীর্ঘদিন বিরাজ করেছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে বিলম্ব হলেও সেগুলো প্রায় সব চলে গেছে।

সার্চ করোনাভাইরাস থেকে দেখা গেছে সুস্থ হয়ে যাবার পরও তার আঘাত কয়েক বছর ধরে ছিল। ২০১১ সালে টরেন্টো ভার্সিটির দুজন গবেষক দেখিয়েছেন বেশকিছু রোগী ১৩ থেকে ৩৬ মাস পরেও কাজকর্মে পুরোপুরি সক্ষম ছিলেন না। তাদের সমসাময়িক সমবয়সীদের চেয়ে বিষণ্নতা, গা ব্যথা, ক্লান্তি, নিদ্রার সমস্যা ছিল বেশি।

সার্চ আক্রান্ত রোগীদের চার বছর ধরে ট্রেক করে ২০০৯ সালে প্রকাশিত আরেক স্টাডিতে দেখা গেছে ৪০ ভাগের চোরা স্রোতের মতো দীর্ঘস্থায়ী শ্রান্তি অবসাদ (Chronic Fatigue )। এ fatigue বা ব্যাখ্যাহীন দুর্বলতার রোগ নিরূপণে কোনো ব্লাড টেস্ট নেই। প্রায় সময়ই রোগীকে বলে দেয়া হয় এটা কোনো ব্যাপার না (dismissive attitude), কিন্তু কোনো পরীক্ষায় ধরা না পড়ুক, কেউ বিশ্বাস না করুক, রোগী নিজে তো জানে তার বেদনাটা বাস্তব (real one)।

তাদের অনেকে কাজ হারিয়ে হয়ে গিয়েছিল বেকার, সমাজে হয়েছিল stigmatized। ইতালির রোমে সম্প্রতি ১৪৩ জন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া কোভিড রোগীর ওপর স্টাডি করে দেখা গেছে ২ মাস পরেও তাদের ৫৩ শতাংশ ক্লান্তিতে, ৪৩ শতাংশ শ্বাসকষ্টে ভুগছে। চীনে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, তিন মাসের মাথায় ২৫ শতাংশের লিভার ফাংশন এবনরমাল, ১৬ শতাংশ ভুগছে বিষণ্নতায়।

কীভাবে ভাইরাস এটা দীর্ঘদিন যাবৎ করে যায় সেটা নিয়ে পুরো ধারণা এখনো পরিষ্কার না। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক রিভিউতে দেখা গেছে তুষের আগুনের মতো হালকা মাত্রায় দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। তাই মুক্তি মেলে না সহজে জড়ালে ভাইরাসের জালে। আর সেটা যদি হয় করোনাভাইরাস! শুধু শারীরিক নয় মন- মনস্তত্ত্বেও দফায় দফায় ক্ষত রেখে যায়।

রোগী আরোগ্য লাভের পর তখনো সামনে থেকে যায় এক বিরাট সুড়ঙ্গ পথ। সে সুড়ঙ্গের শেষ মাথা পর্যন্ত রোগীদের নজরে রাখাটা হওয়া উচিত treatment গাইডলাইনের অংশ। অদূর ভবিষ্যতে ফুসফুসের ফাইব্রোসিস, Chronic Fatigue Syndrome এর অনুরূপ দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা, অবসাদ বিষণ্নতার রোগীর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী বেড়ে যাবে আশঙ্কাজনক হারে।

দীর্ঘমেয়াদে আসলে কি হবে, এ ভোগান্তি কতদিন ভোগাবে, সেটা জানার জন্য যে জিনিসটা আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করবে সেটা হলো- সময়।

লেখক: চিকিৎসক

ঢাকাটাইমস/১৮নভেম্বর/এসকেএস