রাজধানীতে ছিনতাই চক্র: পর্ব ২

বুঝতে পারার জো নেই, চোখের পলকে হাওয়া

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০২০, ০৮:২৩ | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ১৪:৩০

আল-আমিন রাজু, ঢাকাটাইমস

রাজধানীর আর সব এলাকার মতো সকাল হলেই মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে আগারগাঁও- শেরেবাংলা নগর এলাকা। বিশেষ করে এই এলাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে অনেকেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা এসব মানুষকে টার্গেট করে সকাল থেকেই সক্রিয় হয়ে পড়ে এক দল শিশু-কিশোরসহ বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ। ওঁৎ পেতে থাকে কখন কার মোবাইলফোন বা টাকা ছিনিয়ে নেয়া যায়। ছিনতাই করেই চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যায় তারা।

ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়া এসব শিশু-কিশোরদের বয়স আট থেকে সতেরো-আঠারো বছর। এদের প্রত্যেকেই আগারগাঁও বা মিরপুর এলাকায় ছিন্নমূল বা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এরা ছিনতাইকৃত বস্তু দলনেতার হাতে তুলে দিলে নির্দিষ্ট অংকের টাকা পায়। আর একটু বেশি বয়সী যারা তাদের বয়স ২০ থেকে পঞ্চাশ বছর।

গত বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত রাজধানীর আগারগাঁও-শেরেবাংলা নগর এলাকায় এই প্রতিবেদক সরেজমিনে এই চক্রের বেশ কয়েকজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। দেখা গেছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত লোকজনের কেউ কেউ ব্যস্ত সড়কে চলাচলে বা সড়ক পার হতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। তাল মেলাতে না পারা এসব লোকজনকেই টার্গেট করে তারা। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ছিনতাই চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ছিনতাই করে ওই এলাকা থেকে সটকে পড়ে। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সড়ক পার হতে গিয়ে অনেকেই ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে নিচে দিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করেন। যেহেতু ব্যস্ত রাস্তা, তাই এসময়ে পথচারীদের সবার মনোযোগ থাকে রাস্তার ডান-বাম দিকে। এসময়ে তাদের সঙ্গে মিলে যায় ছিনতাই চক্রের সদস্যরা। এরপর টার্গেট করা ব্যক্তির হাতে বা কাঁধে থাকা ব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে মোবাইলফোন, টাকাপয়সা, টান দিয়ে গলায় বা কানে থাকা স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায়। এরপর দ্রুত ওই এলাকা ত্যাগ করে তারা।

এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে শিশু-কিশোর বাদে যুবক, কিশোরী, মধ্য বয়স্ক নারীও আছেন। চক্রের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিনতাই করে নারী সদস্যরা। তারা সহজেই একজনের সঙ্গে মিলে যান। এমন কি রাস্তা পার হওয়ার সময়ে চক্রের নারী সদস্যরা একটি অভিনব কৌশল ব্যবহার করে। হাসপাতাল থেকে বের হওয়া অসুস্থ নারী বা বয়স্ক মহিলাদের রাস্তা পার করে দেয়ার কথা বলে তাদের বিশ্বাস অর্জন করে। পরে হাতধরে রাস্তা পার করে দেয়ার অভিনয় করে। চক্রের একজন রাস্তা পার করার জন্য হাত ধরে আর পেছন থেকে অন্য সদস্যরা ব্যাগের চেইন খুলে বা কেটে ব্যাগের ভেতরে থাকা টাকাপয়সা বা মোবাইলফোন হাতিয়ে নেয়।

যেভাবে ছিনতাই কাজে শিশুদের ব্যবহার

সোহরাওয়ার্দী হাপাতালের সামনের ছিনতাই চক্রের অধিকাংশ সদস্যই শিশু। এদের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে থাকা ছেলে ও মেয়ে শিশুদের প্রায় সবাই আবার মাদকাসক্ত। এমন কি এই চক্রের অন্যতম সদস্য রোজিনা (ছদ্মনাম) নামের এক নারীর কোলে তিন-চার বছর বছর বয়সী শিশুকে দেখা গেছে। রোজিনা রাস্তা পার হওয়ার ভান করে অন্য নারীদের সঙ্গে মিশে কৌশলে কোলের শিশুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ব্যাগ কেটে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে যায়।

ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রোজিনা ও তার ভাই একসঙ্গেই ছিনতাই করে। তিনি ছিনতাই করে তার ভাইয়ের কাছে দ্রুত হাত বদল করে দেয়। তার ভাই রাস্তার উল্টোপাশে রিকশাচালকের বেশে থাকা চক্রের আরেক সদস্যকে নিয়ে অপেক্ষা করে। পরে তারা রিকশায় করে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে।

রোজিনার সঙ্গে আলাপে জানা যায়, তার স্বামীও ছিনতাই চক্রের সদস্য। স্বামীর হাত ধরেই তিনি এই বিপথে নেমেছেন। ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পরে রোজিনার স্বামী বর্তমানে কারাগারে। স্বামী কারাগারে গেলেও থেমে নেই রোজিনা।

অভিযোগ দিতে ভুক্তভোগীদের  অনীহা

ক্যান্টনমেন্ট থেকে নানীকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাপাতালে এসেছিলেন ঝর্ণা আক্তার। চিকিৎসা গ্রহণ শেষে বাসায় ফেরার জন্য হাসপাতালের সামনের রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে বুঝতে পারেন তার কাঁধের ব্যাগে কেউ একজন হাত দিচ্ছে। পেছন ফিরে দেখেন এক কিশোরী তার ব্যাগের ভেতর থেকে মোবাইলফোন আর টাকা নিয়ে নিচ্ছে।

ঝর্ণা ওই কিশোরীকে নিকটে থাকা শেরে বাংলা নগর থানার টহল গাড়ির কাছে নিয়ে যান। পুলিশের কাছে নিয়ে আসার পরে প্রাথমিকভাবে পুলিশ তথ্য যাচাই করে ঘটনার সত্যতা পায়। ওই কিশোরীর বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা (এসআই) ইকবাল। তবে ভুক্তভোগী ঝর্ণা কোনো লিখিত অভিযোগ না দেয়ায় রিয়া নামের ওই কিশোরীকে সতর্ক করে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

এ ঘটনার পরে এ প্রতিবেদক রিয়ার পিছু নিয়ে দেখতে পান, রিয়া কোলে শিশু নিয়ে থাকা রোজিনা, সুখি (ছদ্মনাম) ও রোজিনার ভাই আর রিকশাচালকের বেশে থাকা চক্রের সদস্যের সঙ্গে মিরপুর রোড ধরে শ্যামলীর দিকে চলে যায়।

(ঢাকাটাইমস/১৮নভেম্বর/ডিএম/কেআর)