আগামী প্রজন্মর স্বপ্নযাত্রা এবং চাওয়া-পাওয়া

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৫২ | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৫৬

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল। আর সেখান থেকে আসা কাবুলিওয়ালাকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গল্প থেকে বাংলাদেশের মানুষ কম-বেশি জানে। ছোট্ট মেয়ে মিনিকে নিয়ে লেখা গল্পটি আমাদের পাঠ্যসূচিতে ছিল এবং এখনো সেটা সপ্তম শ্রেণিতে আছে। কাবুলিওয়ালার আফগানিস্তান ভুল রাজনীতির কারণে সুন্দর আধুনিক ইরানের মতো একসময় হয়ে গেল কট্টরপন্থী তালেবানদের রাজ্য। ১৯৭৫ সালের শেষ থেকে বাংলাদেশও জয় বাংলা ছেড়ে জিন্দাবাদের পাল তুলল। তালেবানরা অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক শিক্ষা পেয়েছিল গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত মানব ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারক যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সমালোচকদের মতে, তালেবানদের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাশিয়াকে দাবিয়ে আর ভারতকে চাপিয়ে রাখা। তালেবানদের পাশে সে সময় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানও ছিল। আজ যে চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈরিতা, সেই চীনও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারগুলোর বন্ধু ছিল।

যুক্তরাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এর একটি সুফল আছে। আর সেটা হলো গণতন্ত্র ও ধর্ম একসঙ্গে চলতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রকে ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে দূরে রাখে। সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা অন্য ধর্মকে সম্মান করার পাশাপাশি অধিকাংশ মানুষের গণতান্ত্রিক দাবিকে পূরণ করা সম্ভব হয়। যেমন বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা ও চর্চার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে। এবং ইসলাম ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতাও করতে পারে। আর যদি এর বিপরীত কিছু করে, তবে গণতন্ত্র নিচে চাপা পড়ে। চাপা পড়া গণতন্ত্র হয় হলুদ ঘাসের মতো। তাতে গরুর উদরপূর্তি হয় বটে, তবে মনোরম সবুজের সৌন্দর্য থাকে না। সেই সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে সংলাপ জরুরি।  

প্রথম দিকে তালেবানরা পাকিস্তানের সেনানিবাসে ছিল। ১৯৮৪ সালে লাহোর শহর থেকে সোয়াত বেড়াতে যাবার সময় তাদের আমি প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম। দামি ও ভারী অস্ত্র ১৯৭১ সালেও দেখতে পেয়েছি পাকহানাদারদের এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত জিয়ার আমলে, ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত লেজেহোমো এরশাদের সামরিক শাসন আমলে। হঠাৎ করে ২০০১ সালের শেষ দিকে তালেবানরা যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধুদের নজর কাড়ল বিশেষভাবে- সেটা রাশিয়ার কূটনীতিতে। আবার অনেকেই মনে করে, বুশ একটি ডিফেক্টিভ নির্বাচনে জিতে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। সুতরাং, যুদ্ধের দামামায় সবার দৃষ্টি আটকিয়ে দেয়া একটি পথ তিনি খুঁজছিলেন। আর এভাবে আফগানিস্তান, কুয়েত, ইরাক হয়ে উঠল নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। ৯/১১-এ ধসে পড়ল টুইন টাওয়ার। নির্বাচনের আগেই অবশ্য বুশ মুসলিমদের দেখবেন এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যেমনটি বিগত ৪ বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প করে যাচ্ছেন। মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করে যে দল ও দেশগুলো, তারা এবার ট্রাম্প ও বাইডেন উভয়ের কাছে গেছেন। তারা একটু যত্ন সেখানে পেয়েছেন হয়তো। সুতরাং, তারা সেটা জানান দেবেন নানাভাবে। ভাস্কর‌্য নিয়ে ফতোয়া কিংবা ধর্ষণ নিয়ে আন্দোলন তারা করছেন কেন, সেটা সহজে অনুমেয়। ২০০১ সালে তারা ওই রকম লবি করতে পেরেছিলেন বলে অনেক ভালো কাজ করেও আওয়ামী লীগ কিন্তু জিততে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশ স্বাধীন করা দলটির কাছ থেকে ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অবৈধভাবে ২১ বছর তারা শাসন করেছে। সেই খুনি ডালিম-রশিদ-মোশতাক-জিয়ার দোসররা বিদেশে বসে প্রকাশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে উস্কানি দিচ্ছে।

অভূতপূর্ব উন্নয়ন করে আওয়ামী লীগ নেতারা এখন হয়তো অনেক কনফিডেন্ট। নেতারা হয়তো ভাবছেন ২০০১ সালের মতো কেউ ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারবে না। এ রকম নিশ্চিত ডোনাল ট্রাম্পও ছিলেন কিন্তু। বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। সেই বাস্তবতাকে মোকাবেলার জন্য আরও সতর্ক পদচারণার দরকার আছে। ফস করে কিছু একটা বলে বা করে ফেললে বিপদ আসতে পারে। যেভাবে মিথ্যে প্রচারণা চলছে এবং যেভাবে নিজের দলের লোক চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে, সেটা ভেবে দেখতে হবে। চারপাশে বঞ্চনার হা-হুতাশ লক্ষ্ করা যাচ্ছে। এই যেমনটি মাননীয় সাংসদ কাজী ফিরোজ রশিদ করেছেন। এ রকম আরও অভিমত সহযোগী দলগুলোর নেতাদের মুখে শোনা যায়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বেলুচ সেনারা সকালে ফজরের আজান শুনে হতবাক হয়েছিল নাকি। বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরুর প্রাক্কালে তাদের বলা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান নাকি হিন্দুদের দখলে চলে গেছে। তেমনি যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধুদের সৈনিকরা আফগানিস্তানে এসে দেখল ভিন্ন চিত্র। ইরাকে কোথাও তারা নিউ নিউক্লেয়ার বোমার অস্তিত্ব পেল না। দিনে দিনে তারা যুক্ত হয়ে গেল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। গত কয়েক দিন আগে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন জানালেন, অনেক অস্ট্রেলিয়ার সৈনিক যুদ্ধ অপরাধ করছেন। আজকের পত্রিকায় এসেছে অস্ট্রেলিয়ার সৈনিকরা অন্তত ৩৯ জনকে হত্যা করেছে। আর গতকাল জানতে পারলাম ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে সৈন্য সরিয়ে নিচ্ছেন এবং সেটা তার প্রস্থানের আগে শূন্যের ঘরে নিয়ে আসবেন। আমরা আরও জানছি, আফগানিস্তানে নাকি তিন ট্রিলিয়ন খনিজ সম্পদের ঠিকানা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সমালোচকরা বলছেন, সেটাই ছিল আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর উদ্দেশ্য। সেগুলোর ভাগাভাগি ও আহরণ যাতে বাধাহীন হয়, সেজন্য তালেবানদের আবার আপন করে নেয়া হচ্ছে কি? এমন করে আপন করে আরও অনেকের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে কি? প্রশ্ন হলো, যে মায়ের সন্তান আফগানিস্তানে গিয়ে যুদ্ধ অপরাধী হলো, তার দায় কার? তারা যেসব মায়ের বুক খালি করে কান্নার রোল উঠিয়েছিল, তাদের জন্য কে পাশে দাঁড়াবে?

খবর হলো তালেবানরা আবার ফিরে আসছে আফগানিস্তানের রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির পথ ধরে। এই তালেবানদের বন্ধু শিবির বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাবার স্লোগান দিয়েছিল। এটা একটি ভয়ংকর ঘোষণা ছিল বলে বাংলাদেশে ও বিশ্বরাজনীতির মাঠে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই পরিবর্তন আবার ভিন্ন আরেকটি পথ খুলেছে- যে কারণে মোদিরা গদি পেয়েছেন, এবং ভারতের রাজনীতিতেও এখন ধর্মের গন্ধ। মোদী-ট্রাম্পের কূটনীতির কারণে সেই গন্ধ আবার বাংলাদেশেও পাওয়া যাচ্ছে কি? ভারতে হয়তো পরিবর্তন আসতে পারে, কারণ মোদী সরকারকে মনেপ্রাণে অমর্ত্য সেনের মতো ভারতীয়রা মেনে নেয়নি। আর কমলা-বাইডেন ভারতীয় শিবিরে কিছু না কিছু প্রমিজ করেছেন যা পরিবর্তনের উদ্দীপক হতে পারে।

বাংলাদেশে দিন দিন ধর্মভিত্তিক চেতনা বিভিন্ন বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করছে। এবং তার সর্বশেষ প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিষয়ে ফতোয়া। যে আফগানিস্তানের কিশোরীরা স্কার্ট পরে ১৯৭৪ সালে স্কুল যেত, তা যেমন অনেক বদলে গেছে। ২০০১ সালে যে তালেবানরা বৌদ্ধমূর্তি ভেঙে বিশ্বনেতাদের নজর কেড়েছিল, সেখানে তালেবানরা আবার রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাচ্ছে। তেমনি কি বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ? ধর্ষণের কারণ পোশাক- একটি স্বতঃসিদ্ধে পরিণত হতে চলেছে তাদের ফতোয়ায়। অনুভব করেছেন কি?

আফগানিস্তানে বহিরাগত সৈনিক আসায় বাংলার মিনিরা উদ্বেগের সঙ্গে হয়তো কাবুলিওয়ালার মুখখানা কল্পনা করত। এখন সেই বাংলার মিনিরা এক মহাবিপদ দেখতে পাচ্ছে আগামী বাংলাদেশে। তাদের হয়তো বোরখা পরে চলতে হবে আশঙ্কা। আরও অনেক শঙ্কা আছে। আর সেজন্য আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবিদের দায় কোন অংশে কম নয়।

একসময় আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে দেশ গড়বার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু এই মূল্যবোধগুলো কেন জানি অবহেলিত এবং এগুলো যেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যেন পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠছে দিন দিন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত কয়েক দিন আগে দুটি উপনির্বাচন হয়ে গেল দেশে। সংবাদপত্রের অভিমত সেখানে গণতন্ত্র নির্মমভাবে পরাজিত।

তবে গণতন্ত্র খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই হোঁচট খাচ্ছে। আল গোর, হিলারির কাছ থেকে বিজয় কেড়ে নিয়ে তারা এত উন্মাদ হয়েছে যে কিছুতেই স্বচ্ছভাবে নির্বাচিত ৪৬তম প্রেসিডেন্টকে একটি পক্ষ মেনে নিতে চাইছে না। খুবই শঙ্কার বিষয় বিশ্ববাসীর জন্য। সারা বিশ্ব বিশ্বাস করে যা, তাকে অস্বীকার করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা ভীষণ বিব্রত তাদের প্রেসিডেন্টের কথায়। তিনি আগেই আমাদের ফিনাইল কিংবা ব্লিচিং দিয়ে করোনামুক্ত করতে পরামর্শ দিয়ে বিশ্ববাসীর হাসির খোরাক হয়েছেন। এখন একটি মিথ্যেকে সত্য বানাবার চেষ্টা করছেন।

আমরা যে আগামী প্রজন্মকে স্বপ্ন ও আদর্শ দিতে ব্যর্থ হচ্ছি, সেটা স্বীকার করা যেমন জরুরি, তেমনি এখনই সময় আরেকটি রূপরেখা রচনা দরকার, যেমনটি ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর রাজনীতিবিদরা দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। আমাদের নির্বাচন কমিশন স্পষ্টতই যে পথ হারিয়েছে, সেটা আর বলবার অবকাশ নেই। তাদের ব্যর্থতায় ১১টি বাস পোড়ানো হয়েছে মানতে হবে। যদিও সত্য মানতে পারা খুবই কঠিন। একজন ৭৫ হাজার ভোট পায়, আর আরেকজন ৫ হাজার, সেটা কেন তা খুঁজতে হবে। পত্রিকার পাতায় রাজনীতিবিদরাও বলছেন, আমলারা সব অর্জন ধ্বংস করে দিচ্ছে। ধ্বংস করেছে নির্বাচন ব্যবস্থাও। ওই আমলা সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হতে হবে। কিন্তু কীভাবে?

  

তদবিরে যাকে-তাকে ‘কি পয়েন্টে’ বসিয়ে দিচ্ছেন কি?

সরকারের বিরুদ্ধে মাননীয় সাংসদ কাজী ফিরোজ রশিদের অভিযোগটির যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। তিনি বলেছেন: “আমলাদের মধ্য থেকে তদবিরে যাকে-তাকে ‘কী পয়েন্টে’ বসিয়ে দিচ্ছেন।” অভিযোগটা আরও কঠোর হতো যদি তিনি বলতেন- ১৯৭৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বিগত ২৬ বছর যারা ক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, নাম-নিশানা মুছে দিতে চেয়েছে- তাদেরই সরকার ‘কি পয়েন্টে’বসিয়ে দিচ্ছেন। যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও হত্যাকারীদের দোসর, তারা ১/১১-র সময় দুর্নীতির মিথ্যা মামলা দিয়ে মাইনাস করতে চেয়েছে- তারাই আছে বিগত ১২ বছর মহাসুখে। আর যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে জাতির পিতার হত্যার বিচারের দাবিতে রাজপথে থেকে নিপীড়িত হয়েছে, তারা অনেকে দফায় দফায় নিপীড়নের শিকার হয়েছে বিগত ১২ বছর। যাদের কি পয়েন্টে ১২ বছর বসানো হয়েছে, আমরা লক্ষ্ করেছি তিনি একটু জামাত-বিএনপি কিংবা বাম ঘেঁষা। এবং তারা সুযোগ পেলে জামাত-শিবির-বিএনপি-বামদের সুযোগ করে দিয়ে এবং সরকারের পরীক্ষিত লোকদের বঞ্চিত করে সরকারকে দুর্বল করে দিচ্ছেন। তারা বেশ ‘ওদের’ কাছে প্রিয়। আর যারা আদর্শ মেনে চলে, তারা হয়ে যায় দলীয় এবং অগ্রহণযোগ্য।

আমরা হয়তো ভুলে গেছি, ওই আদর্শবাদীরাই লড়াই করে ১/১১-র নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে গণতন্ত্রকে। সম্ভব হয়েছে জাতির পিতার হত্যার বিচার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের যাত্রা। যদি ওই ত্যাগী নিপীড়িতদের এভাবে দিনের পর দিন অবহেলা করা হয় তবে ‘সে বিচার আল্লাহ করবেন’ বলে যে দীর্ঘ নিঃশ্বাস মানুষটি ত্যাগ করবে তা কিন্তু লেগে যেতে পারে!

বিচার একটি কঠিন কাজ। আল্লাহ বিচার করেন। সেই বিচারে পার পাওয়া খুবই কঠিন। ফুলসিরাত যা কিনা একটি চুলের চেয়েও চিকন, সেই পথ পার হতে হবে সব মানুষকে। অবিচার আরও আছে। কেউ এক পাত খাওয়ার পর আরেক পাত খেতে থালা ধরে। এবং ওরা সৌভাগ্যবানও। তাদের দ্বিতীয়, তৃতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেয়া হয়। এমনকি তাদের পদোন্নতিও হয় কিংবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও হয়ে যায়। তারা অবশ্য অনেক কনফিডেন্ট। জেনারেল সফিউল্লাহর এক্সটেনশন, জেনারেল এরশাদের এক্সটেনশন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। একজনকে এক্সটেনশন দিলে অন্যের পদোন্নতি ও স্বপ্ন মিলিয়ে যায় এবং সেটি যে অবিচার সেটা মানতে অনেকেই রাজি নন। স্বাস্থ্য মহাপরিচালককে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তার পরিণাম কী হলো তা দেখলাম। আবার যাকে দেয়া হয়েছে, তার এক্সটেনশন নিয়ে আলোচনা চলছে। এই এক্সটেনশনের সংস্কৃতিও কিন্তু বিপজ্জনক এবং অবিচার- সেটা বলা যাবে কি? বললে পত্রিকা হয়তো ছাপবে না। ‘ঘাড় মটকানোর’ ঘোষণা তো হয়েই গেছে!

তবে, মিথ্যা বললে কিংবা একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম থাকলে সুবিধা আছে। যেমন সাংসদ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহান সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বলে চলেছেন সুললিত কণ্ঠে বুলেট ট্রেনের গতিতে। ছোটখাটো ভুলগুলোই বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। আর বিশ্বাসভঙ্গ ওই পাশের মানুষগুলোই করে, যেমন ডালিম-মোশতাক করেছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, শিখ সেনা করেছে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে, বেল্টুরা করেছে ১/১১-র সময়। জনাব কাজী ফিরোজ রশিদ ঠিকই বলেছেন- মানুষ চিনতে ভুল করলে আবার জাতির জীবনে অমানিশার অন্ধকার নেমে আসবে। প্রশাসনের আমলারা সবচে মেধাবী ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের যেভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে, তার মূল্য কিন্তু একদিন দিতে হবে জাতিকে। আমরা সেই বিভীষিকাময় যুগ (১৯৭৫-১৯৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৯ ) আর চাই কি?

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিতর্ক তৈরি না করে আমার অভিমত হলো, প্রতিটি ইউনিয়নে একটি পাঠাগার করা যায়। সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটি মুরাল কিংবা ভাস্কর্য থাকতে পারে। আর কথা বলার সময় যেন আমরা ‘শালীনতা’ শব্দটার মান রাখতে চেষ্টা করি।

আমাদের গ্রামে গ্রামে মাদক, পর্নো ও দুর্নীতি ছড়িয়ে গেছে। সবগুলো মোকাবেলা করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য। এবং সেটা করতে হলে এখনই বসতে হবে। যেভাবে ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বসেছিলেন, সেভাবে আবার বসতে হবে। বিদ্যমান সিস্টেম যে কাজ করছে না, সেটা কেবল উপলব্ধি করলেই হচ্ছে না। সেটা ঠিক করবার প্রয়োজন। আর মিডিয়া এখানে একটি সহায়ক শক্তি হতে পারে। সেজন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আরও সহনীয় করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে একটি পক্ষ একটি মত দিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া ‘ঘাড় মটকানো’ আগুনকে উসকে দেবে অনুমান করা যায়। তালেবানদের পাশে যেমন মানুষ আছে, তেমনি আছে ওদের পাশে।

এ মুহূর্তে বাঙালি চেতনার আলোকে একটি সামাজিক উন্নয়নের রূপরেখা নির্মাণ একান্ত জরুরি। যেখানে সামাজিক ন্যায্যতা ও সাম্য কেন্দ্রবিন্দুটিতে থাকতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম হবে শহর- স্বপ্নটির সঙ্গে ‘পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য আমরা’ যুক্ত হতে পারে কর্মপরিকল্পনায়।

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বাঙালি বলতে আমি কী বুঝি? আমার কাছে বাঙালি মানে মিনি, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টার-রতন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং জসীমউদদীনের ‘৩০ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’। আমার কাছে বাঙালি মানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। বাঙালি মানে সমতা ও মিলে-মিশে বাস করা। বাঙালি মানে ঈদ, বাঙালি মানে হালখাতা। বাঙালি মানে শাপলা-ইলিশ, বাঙালি মানে বাংলাদেশ। বাঙালি মানে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সুশাসন। বাঙালি মানে অন্যের মঙ্গল কামনা করা। এভাবে বাঙালিত্বকে বিস্তৃত করেই হতে পারে আমাদের আগামী প্রজন্মের স্বপ্নযাত্রা।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়