নিভৃতে পুরুষ নির্যাতন!

রেজাউল করিম
 | প্রকাশিত : ১৯ নভেম্বর ২০২০, ২১:৩৫

আজ বিশ্ব পুরুষ দিবস। অন্যান্য দিবসের মতো কোনো প্রচার নেই এই দিবসের। নারী দিবস যেমন নানা অভিবাদন, অভিভাষণ আর নারীর উন্নয়নযাত্রার জয়গান গাওয়া হয়; নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের অন্যায়, নির্যাতনের সমালোচনা, নিন্দা আর হুঁশিয়ার উচ্চারিত হয় মহলে মহলে, তার ছিঁটেফোঁটাও নেই পুরুষ দিবসে। নীরবে-নিভৃতেই চলে যায় দিনটি। অনেকটা নির্ভৃতে পুরুষ নির্যাতনের মতো।

এই লেখাটি কেউ দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না। কিংবা আমাকে নারীবিদ্বেষী ভাবারও কোনো কারণ নেই। এই লেখার প্রসঙ্গটি সাম্প্রতিক সময়ে পত্রপত্রিকায় এসেছে বলে আজ লিখতে প্রয়াস পেয়েছি।

পুরুষশাসিত সমাজ বলা হয়। আদপেই কি এখন আর পুরুষশাসিত বলা যায়? বলা উচিত? উচিত-অনুচিত, যা-ই হোক, সব সময়ই আলোচনায় আসে নারী নির্যাতনের খবর। তবে কি সমাজে-পরিবারে শুধু নারী নির্যাতিত হচ্ছেন? বিভিন্ন মামলার পর্যালোচনা আর বর্তমান প্রেক্ষাপট বলছে, সমাজের অনেক পুরুষ তার নিজ ঘরে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছেন। লোকলজ্জা আর পরিবারের কথা ভেবে নির্যাতন-নিপীড়ন আর হুমকি-ধমকি নীরবে সহ্য করে যান পুরুষ। পুরুষ অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বলছে, সমাজে অনেক পুরুষই স্ত্রীর যন্ত্রণায় নীরবে কাঁদেন।

আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। সংসদের স্পিকার একজন নারী। বিরোধীদলীয় নেত্রী একজন নারী। দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধান একজন নারী। স্থানীয় সরকার থেকে প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্র নারীরা উচ্চাসনে। শিক্ষা-দীক্ষায় নারীরা অনেক অনেক এগিয়েছে। অর্থাৎ নারীরা পিছিয়ে আছে এ কথাটা এখন আর সেভাবে বলা যায় না। বরং নারীসমাজ পরাধীনতার খোলস ভেঙে, নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে গেছে অনেকটা পথ। এটা আমাদের গর্ব। তারপরও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন; ধর্ষণ, অত্যাচার, যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। এই অনাচার ভাঙতে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ-আয়োজনও আছে বিস্তর। এটা ইতিবাচক একটি দিক। নিশ্চয়ই একদিন নারী নির্যাতন থাকবে না সমাজে, দেশে।

বিপরীতে এখন নানা সমাজ ও পরিবারে পুরুষ নির্যাতনের খবর আসছে হরহামেশা। এর কোনো বিচার-মীমাংসা নেই। অনেকটা অবাধ এবং ইমডেমনিটি পাওয়ার মতো।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাওয়া সমাজেরই নতুন রূপ হলো পুরুষ নির্যাতন। নির্যাতিত পুরুষের কেউ শারীরিক, কেউ মানসিক, কেউ দৈহিক-আর্থিক, কেউ সামাজিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। তুলনামূলক কম হলেও নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা এ দেশে নেহায়েত কম নয়। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান থাকলেও নেই পুরুষ নির্যাতনের সঠিক তথ্য। ফলে নারী নির্যাতনের খবর ফলাও করে প্রকাশ করা হলেও অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাগুলো।

তবে সাম্প্রতিককালে পুরুষ নির্যাতনকে কেন্দ্র করে বেশকিছু সংগঠন গড়ে উঠছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমানে দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার বন্ধন আগের চেয়ে অনেকটা হালকা। এ ছাড়া সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক অবক্ষয়, লোভ-লালসা, উচ্চাভিলাষ, পরকীয়া, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব, সাংস্কৃতিক প্রবাহসহ নানা কারণেই এমনটা ঘটছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না পুরুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, চক্ষুলজ্জা, জেল-পুলিশ আর উল্টো মামলার ভয়ে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর নির্যাতন নীরবে সহ্য করে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। পুরুষ চাইলেও নির্যাতনের কথা বলতে পারছে না। অন্যদিকে একজন নারী আইনের অপব্যবহার করে ইচ্ছে করলেই ঘটনা সাজিয়ে পুরুষের বিরুদ্ধে থানা বা আদালতে সহজেই নারী নির্যাতনের মামলা বা যৌতুক মামলা দিতে পারছেন। এমনকি মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর উদাহরণ আছে ভ’রি ভ’রি। সাম্প্রতিক সময়ে এমন মিথ্যা মামলার কারণে দেশের বিভিন্ন আদালতে কয়েকজন নারীর কারাদণ্ডের খবর পত্রিকায় এসেছে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব হলো, জেল খেটে, নানা কাঠখড় পুড়িয়ে মামলা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারায়।

আমাদের সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে নারীর অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে নারীর সুরক্ষার জন্য দেশে একাধিক আইন রয়েছে। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০, এসিড নিরোধ আইন-২০০২, পারিবারিক সহিংসতা ও দমন আইন-২০১০, যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ উলে¬খযোগ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য নারীর সুরক্ষার জন্য আইনগুলো তৈরি হলেও বর্তমানে এ আইনগুলোকে কিছু নারী পুরুষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সামান্য কিছুতেই স্বার্থান্বেষী কোনো কোনো নারী স্বামী কিংবা অন্য পুরুষদের নাজেহাল করতে এসব আইনের অপপ্রয়োগ করছেন। অন্যদিকে দেশে ‘পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ’ আইন বলে কিছু সৃষ্টি হয়নি এখনো। নেই পুরুষ নির্যাতনবিরোধী ট্রাইব্যুনালও। ফলে আইনি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগী কিংবা নির্যাতিত পুরুষ।

পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রে যৌতুক আইনের অপপ্রয়োগ সবচেয়ে বেশি। আইনজীবীরা বলছেন, যৌতুক আইনের অধিকাংশই মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। পারিবারিক যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত ঝগড়া হলে সেটি থানা পুলিশে গড়ালে পরিণত হয় যৌতুক মামলায়। কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে অথবা স্ত্রীকে তালাক দিলে অথবা উচ্ছৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে অথবা স্ত্রীর পরকীয়ায় বাধা দিলে নারী ও তার পরিবারের লোকজন থানায় বা আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০-এর ১১(খ) অথবা যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০-এর ৪ ধারায় মামলা করেন। একজন পুরুষের জীবন অতিষ্ট করার জন্য এ একটি মামলাই যথেষ্ট।

আমাদের দেশে সাধারণত বিয়ের সময় পাত্রীপক্ষ দেনদরবার করে পাত্রকে সাধ্যের অতিরিক্ত টাকা দেনমোহর হিসেবে কাবিননামায় ধার্য করতে বাধ্য করেন। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কাবিন হয় বাকিতে। অর্থাৎ দেখা গেল কনেপক্ষের দাবি অনুযায়ী কাবিন করা হলো ৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে গহনা ও অন্যান্য জিনিস বাবদ ২ থেকে ৩ লাখ টাকা পরিশোধ দেখিয়ে পুরোটাই বাকি রাখা হয়। যদিও ইসলামি বিধান হলো বিয়ের সময়ই দেনমোহর পুরোটা পরিশোধ করা। তবে এই কথা শোনে কে? বাকি থাকা বা বাড়তি এই দেনমোহরই পরে কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন কেস স্টাডি থেকে জানা গেছে, অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে স্বামী তার স্ত্রী ও তার পরিবারের লোকজনের অনৈতিক দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয় আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই! বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। কবির সাথে একমত হয়ে বলতে হয়, যেহেতু পৃথিবীতে কল্যাণের অর্ধেক নারী অর্ধেক নর সেক্ষেত্রে নারী-পরুষের সমধিকার থাকা প্রয়োজন।

নারী সমধিকার নিয়ে এখনো আন্দোলন হয়। সত্যিকার অর্থে অনেক আগেই নারীরা সমধিকার পার করে অধিক অধিকার ভোগ করছেন। আসা যাক, ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। নারী, পুরুষ ভোটে অংশ নেওয়ার সুযোগটা সমধিকার। অথচ একটি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থাকাটা হতে পারে অধিক অধিকার। চাকরির ক্ষেত্রেও তেমন। যে কেনো চাকরিতে আবেদন করার অধিকার সমধিকার। অথচ নারীদের অগ্রাধিকার বা আলাদা কোটা থাকাটা অবশ্যই অধিক অধিকার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে নারীদের নির্বাচন করার অধিকার হল সমধিকার। ৫০টি অতিরিক্ত সংরক্ষিত আসন থাকাটা অধিক অধিকার। যদিও কথাগুলো পুরুষ নির্যাতনের সাথে যায না, তবে এতে অন্তত এটা বোঝা যায় যে, নারীর অগ্রগতি এবং অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী এখন আর পিছিয়ে নেই।

শেষ করি প্রেম, ভাঙন ও পরিণতি দিয়ে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রেম কিংবা সম্পর্ক তৈরি হওয়া চিরায়ত ধারা। যুগে যুগে বিপরীত মেরুর দুজনের ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে আসছে, ভবিষ্যতেও হবে। এই সম্পর্ক কখনো কখনো কারও বেলায় অনাকাক্সিক্ষত মেলামেশায়ও পর্যবসিত হয়। অতি উচ্ছ্বাস কিংবা আবেগে স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হয়ে যায় কারও কারও ক্ষেত্রে। ধর্মীয়, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সব স্তরেই অনৈতিক ও অবৈধ হিসেবে গণ্য এই কার্য তত দিন গোপন থাকে, যত দিন দুজনের সম্পর্ক ভালো থাকে। সম্পর্ক ভেঙে গেলেই পুরুষের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় ধর্ষণ মামলা। নারীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ চলে না এখানে।

আবার এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, কখনো কখনো কোনো কোনো পুরুষ তার নারী সঙ্গীকে প্রলোভিত করে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে। এ বিষয়ে এখানে বিস্তারে যাচ্ছি না সঙ্গত কারণে।

হত্যায় আর চিকিৎসায় যেমন নারী নির্যাতন প্রকাশ পায়, সেভাবে পুরুষ নির্যাতন প্রকাশ পায় না। তাই নিভৃতে থেকে যায় পুরুষ নির্যাতন।

আসলে নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। এক পক্ষকে বাদ দিয়ে আরেক পক্ষের পূর্ণতা পায় না। নারীর সুরক্ষায় নারী অধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে পুরুষের কথাও। নারী অধিকার নিশ্চিত করতে গিয়ে যেন পুরুষের অধিকারকে হেয় করা না হয়, তাকে হেনস্তা কিংবা বঞ্চিত করা না হয়। সেটা হলে একদিন তা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করবে।

লেখক: শিক্ষক ও সংবাদকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :