বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্ষয়ে যাচ্ছে!

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, পিপিএম
| আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২০, ১১:২৬ | প্রকাশিত : ২০ নভেম্বর ২০২০, ১৮:৫৯

বাঙালি জাতিসত্তা সৃষ্টি ও তার উৎকর্ষ সাধনে আবহমানকাল থেকেই বাংলার শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা এককথায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুণবাচক প্রভাব অনন্য ভূমিকা রেখে আসছে। এর প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়েছে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামে গতি সঞ্চার করা, সহযোদ্ধাকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করা, অধিক প্রাণশক্তি জুগিয়ে সফলকাম না হওয়া পর্যন্ত তাদের চেতনাকে শাণিত করা, দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে ক্ষিপ্রতা তৈরি করা এবং শত্রুকে পরাস্ত করে লাল-সবুজের সীমানাকে পাকিস্তান থেকে ছিন্ন করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সাংস্কৃতিক শক্তির ভূমিকা ছিল অনন্য। ক্ষেত্রবিশেষে তা বুলেটের বিরুদ্ধে কার্যকরি শক্তি হিসেবে বুলেটকেও হার মানিয়েছে।

সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যতটা রাজনৈতিক, যতটা অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে, ঠিক ততটাই ভাষা, শিল্প-সাহিত্য, সাংস্কৃতিক বঞ্চনার বিপরীতে বাংলার মানুষের মধ্যে দীর্ঘসময়ের সঞ্চিত ক্ষোভ ও দ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটেছিল মুক্তিকামী শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। সেজন্যই মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত মানচিত্র লাল-সবুজের বাংলাদেশ পৃথিবীর ইতিহাসে এক এবং অদ্বিতীয় সফল অর্জন।

সৌভাগ্য আমাদের, বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত বিশেষ আশীর্বাদ হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম, যাঁর ডাকে বাংলার সব শ্রেণী-পেশার মানুষ মৃত্যুকে তুড়ি মেরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।বাংলার নীরিহ মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তার। লোভ-লালসার প্রস্তাবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মতো দৃঢ়চিত্ত, সেই সাথে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে বাংলার সাধারণ মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মনে বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আস্থার জন্ম দিয়েছিল। তাই কতিপয় রাজাকার ছাড়া বাংলার মানুষ নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন এবং মাত্র নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করেই জন্ম দিয়েছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।

সংগীত কিংবা সাংস্কৃতিক চেতনার শক্তি অসীম, যার বিরল উদাহরণ আমরা দেখতে পেয়েছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধকালেযেখানে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি কার্যকর ছিলনা কিংবা অকার্যকর হয়েছে, ঠিক তেমন প্রেক্ষাপটে সাংগীতিক শক্তিকে সফল হতে দেখেছি আমরা।জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশংকরের 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' জ্বলন্ত উদাহরণ। খোদ শত্রুশক্তির মাটিতে সে দেশের মানুষকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অনুপ্রাণিত করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করার কনসার্টটি সেদিন সংগীতের বিশ্বশক্তিমত্তার পরিচায়ক ছিল।

বাংলা ভাষার গাঁথুনি, বাংলা সংস্কৃতির সংগীত, কবিতা ও অন্যান্য উপজীব্যের উপযুক্ত উচ্চতা বিশ্ববাসী ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বিজয়ের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে শিখেছিল। তেমনি ১৯৫২ সালে পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য নীলনকশা করেছিল এবং সেটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে চরম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হয় তাদের। সেদিন মায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় বাঙালি জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিল এই ভাষা আমাদের হৃদয়ে কতটা গভীরে প্রোথিত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ তদানীন্তন বাংলার বীর সন্তানেরা এ ভাষা রক্ষা তথা বাংলার সংস্কৃতি রক্ষায় অনন্যসাধারণ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বলেই আজ বিশ্বে এ ভাষাটি সগর্বে মাথা তুলে আছে। নইলে বিশ্ব থেকে অনেকের মাতৃভাষা যেমন বিলুপ্ত হয়েছে, আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হতো না। আজও পরাজিত শক্তির পক্ষে এদেশের কিছু গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ দেশীয় ভাষা, সংগীত ও সংস্কৃতির বিপক্ষে অহরহ ভুলভাল বুঝিয়ে বাংলার মানুষকে বিপথগামী করে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টায় অহর্নিশি কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অনন্য। কিছু বিশেষ সাহিত্য, গণমুখী গান সে সময়ে যোদ্ধাদের কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে, কতটা শক্তি জুগিয়েছে, তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কণ্ঠযোদ্ধাদের সৃষ্টি ও তা পরিবেশনা এবং সাহিত্য অঙ্গনের কিছু বিশেষ পরিবেশনা- যেমন এম আর আক্তার মুকুলের চরমপত্র পাঠ মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণশক্তি জাগিয়ে তুলে দেশমাতৃকার তরে ঝাঁপিয়ে পড়তে কত বেশি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, তার মাত্রা নিরূপণ করতে বিশেষ গবেষণার প্রয়োজন বোধ করি। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’- এমন কালজয়ী শত সাংগীতিক শক্তি সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের কত বেশি গণশক্তি জুগিয়েছিল, কত বেশি দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত করেছিল, তাও আজ গবেষণা ছাড়া যেনতেনভাবে মন্তব্য করা যথেষ্ট স্পর্ধার বলেই আমার মনে হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। বিশেষ করে প্রশাসনযন্ত্রের বাইরে যারা সাধারণভাবে চেতনাতাড়িত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের জন্য এ মাধ্যমটি ছাড়া বিশেষ কোনো যোগাযোগের আর কোনো ব্যবস্থাই ছিলনা বললে অত্যুক্তি হবেনা। সেইসাথে বাংলার জারি-সারি, ভাটিয়ালি, কবিগান, বাউলগানের কিছু কিছু সাধক কণ্ঠযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ফেরি করে গান শুনিয়ে বেড়াতেন তার নিজ অঙ্গনের আশপাশের এলাকাগুলোতে। যাতে করে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে নিজেদের নিবেদিত করে এবং ভয়-ভীতি দূর করে মুক্তিকামী চেতনাকে জাগ্রত রাখতে পারে। আমরা শাহ আব্দুল করিমকে এমন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে দেখেছি। তাছাড়া বাংলাদেশের গুণীচিত্রশিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, ঘটে যাওয়া নৃশংসতা, বর্বরতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেসব চিত্রকর্ম বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছেন, তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এবং তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের পৈশাচিক আচরণ বিশ্ববাসীর কাছে নিবিড়ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্মোত্তর স্বীকৃতির ক্ষেত্রে এ চিত্রকর্ম কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখার প্রয়াসে চলমান এবং আগামী প্রজন্মের জন্য অপরাজেয় বাংলা থেকে শুরু করে অন্যান্য যেসব ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান স্মৃতি বহন করছে। এসব স্থাপত্যকর্ম আমাদের চেতনা, প্রেরণা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশ্বদরবারে শিল্প ও স্থাপত্যকর্মের নিদর্শন স্বরূপ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে।

বঙ্গবন্ধুর 'বাংলাদেশ' জন্ম দেওয়ার মতো সম্পূর্ণ নেতৃত্বগুণ অর্জন করার আগেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন কিছু গুণী মানুষ এ মাটিতে জন্মেছিলেন ঠিকই, তাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বগুণের মাত্রাগত উৎকর্ষে একটা পার্থক্য তৈরি করেছিল যে বিশেষ বিষয়টি তা হলো 'বাংলাদেশ জন্ম দিতে পারার আত্মবিশ্বাস'। বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য নেতাদের মধ্যে এটি জন্ম নিতে পারেনি স্থায়ীভাবে। তবুও এ বঙ্গের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় তাদের অবদান অনস্বীকার্য।

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ জন্ম দিতে পারার আত্মবিশ্বাসের বিশেষ কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বিশেষ কারণ ছিল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ রূপে গড়ে তোলা। রবীন্দ্রসাহিত্য ও দর্শন, সঙ্গীত, শিল্পকলা বঙ্গবন্ধুকে গড়ে তুলেছিল পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক আত্মবিশ্বাসী একজন সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষ হিসাবে, একজন সম্পূর্ণ মুক্তকামী নেতা হিসাবে।লোকজ সংস্কৃতির ছোঁয়ায় গরিব, দুখি, মেহনতি মানুষের প্রতি ভালোবাসা, তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে নিজেকে নিবেদিত করা, আর দেশপ্রেমের আত্মোপলব্ধিতে এসব সাহিত্য-সংস্কৃতি বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এক ভিন্নতর মাত্রার সম্মিলন ঘটিয়ে হিমালয়সম আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। সে কারণেই স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক অনেক আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' আর ডিএল রায়ের 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা' গান দুটি বিশেষ করে পাকিস্তানি জান্তা কিংবা পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের এ মাটিতে কোনোপ্রোগ্রামে বঙ্গবন্ধু খুব সচেতনভাবেই পরিবেশন করে তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন বারবার। এমনকি অন্যান্য পরিসরেও তিনি শিল্পীদের দিয়ে আজকের এই জাতীয় সংগীত তখন পরিবেশন করাতেন।

বলতে দ্বিধা নাই, ঠিক যেদিন যে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু প্রথম চিন্তা করেছিলেন এ দেশের জাতীয় সংগীত হবে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান যা বঙ্গবন্ধুর অন্তরে সার্বক্ষণিক গুনগুন করে বেজে চলত- 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'- ঠিক সেদিন সে মুহূর্ত থেকেই বঙ্গবন্ধু আত্মায় আর তার বিশ্বাসের যাত্রায় বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি, মেধা ও কবিগুরুর সাহিত্য-দর্শন অনেকেই খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলছিলেন। এই ধারাবাহিকতায় সাতচল্লিশে ভারত উপমহাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন ভিন্ন দেশের জন্ম হলেও পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীদের জন্য বড় একটি উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল রবীন্দ্রসাহিত্য। যে কারণে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য ও বুদ্ধির চর্চার সীমানায় একটি বিষয়ে খুব কড়া নাড়ছিল পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীদের, তা হলো উদীয়মান স্বাধীনতাকামী নেতা বঙ্গবন্ধুকে বুলেট বোমা বারুদের ভয় দেখিয়ে রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে এক ঢিলে দুই পাখি মারার একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও বুদ্ধিজীবীরা। সাধারণ মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা, বাংলাদেশ যেন কোনো দিনই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে না পারে সে জন্য ধর্মের ধোয়া তুলে রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্রসাহিত্য ব্যান্ড করার প্রয়াস নিয়েছিলেন মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রুখতেই।

রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অনুরাগ ছিল অত্যন্ত প্রগ্রাঢ় এবং তা ছিল লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধুর হাতে বাংলাদেশ জন্মের সফলতায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের সে স্বপ্ন পূরণ না হলেও বিজাতীয় ধর্মের পরিচয়ে যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল, তা স্বাধীনতা-উত্তর যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বাস না এনে নিজ দেশের মুক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতাকামী পরিবার-পরিজনকে হত্যা করেছে, অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতে যারা সরাসরি ভূমিকা রেখেছে, এমনই বিশেষ জনগোষ্ঠী আজও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবিনাশী গান 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' কেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা হলো সেটি নিয়ে নানাভাবে বিরোধিতা করেই চলছে।

সে সময় পাকিস্তানিরা যা করতে চেয়েছিল, তারা তখন করতে না পারলেও তাদের দোসররা সেই কাজটি বাস্তবায়ন করল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারসহ স্বজনদের হত্যার মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম জঘন্য ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকেই শুধু হত্যা নয়, সেদিন যেন বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক, বাহক, শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে হত্যার উদ্দামতা প্রদর্শন করেছিল সেই প্রেতাত্নারা।

পরবর্তীতে দীর্ঘসময় যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন তারাও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নামে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে সরে গিয়ে সেই পশ্চাৎমুখী সংস্কৃতিকে অভিযোজিত করে, মূল লোকজ ও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি চরম বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন নতুন প্রজন্মের মাঝে। ওদের বিশ্বাস এবং সংস্কৃতিকে চর্চা করতে গিয়ে দিন দিন নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি কিম্বা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করে বাঙালি সংস্কৃতিকে পর্যায়ক্রমে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে খুব কৌশলে। যার ধারাবাহিকতায় আমরা জন্ম হতে দেখেছি বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমান থেকে শুরু করে চরম জঙ্গিবাদ। যাদের মূল লক্ষ্যই এ দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা এবং সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষকে নানারকম হুমকি-ধমকি মেরে, সিনেমা হলে বোমা মেরে, রমনার বটমূলে বোমা মেরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করা।

মধ্যবর্তীসময়ে কী দেখেছি আমরা? এ দেশের জারি-সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, যাত্রা, সার্কাস, কবিগান, পুথিপাঠ এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক ধারাগুলো চোখের সামনে ক্ষয় হতে দেখলাম আমরা। খুব সুপরিকল্পিতভাবে এদেশের সংগীত ও সিনেমা শিল্পকে এতটাই দুর্বল করে দেয়া হয়েছে, যা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে পুনর্জাগরণ ঘটানো সত্যিই আর সম্ভব কিনা সংশয় জাগছে মনে।

জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব বক্তব্য বর্তমানে জাতির সামনে উঠে আসছে, তা নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীরা সত্যিই খুব শংকিত। সেই প্রেতাত্মারা দম্ভভরে দেশীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির গলা এমন করে চেপে ধরেছে, যেন মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ছাড়বে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনায় প্রকৃত বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের ধারক-বাহক এবং ভবিষ্যতে যাদের হাত ধরে আওয়ামী লীগের ঝান্ডা উড়বে, তারা বিষয়টি অনুধাবন করে সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মূলভাবধারায় বঙ্গবন্ধুর মনস্তত্ত্বে গ্রথিত অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক সংগ্রামে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। না হলে অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের স্বাধীনতা রক্ষা এবং সেই সাথে দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষা করার মতো কঠিন কাজটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।

লেখক: পুলিশ সুপার, গীতিকবি, প্রাবন্ধিক ও কণ্ঠশিল্পী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :