বাজারে নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৫৬

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

মহামারীকালে জীবিকায় টান পড়ায় সাংসারিক খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। বিশেষ করে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবীরাই পড়েছেন বিপাকে। একদিকে প্রতিষ্ঠান থেকে বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংক কমানো হয়েছে। আবার কারও কারও চাকরিই নেই হয়ে গেছে।

অন্যদিকে মহামারীকালের আগের ধারাবাহিকতায় জীবন চালাতে গিয়ে তারা না পারছেন সইতে আবার না পারছেন কারও কাছে হাত পাততে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে তাদের জন্য বাজার হয়ে পড়েছে যেন এক দুস্বপ্ন। নিত্যপণ্য থেকে কাঁচাবাজার- সবখানেই তাদের হতে হচ্ছে বেজাড়।

করোনা মহামারীকালে বাজারে পণ্যের জোগান ও সরবরাহে এখন পর্যন্ত কোনো সংকট দেখা দেয়নি। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যও যথারীতি বাজারে ঢুকছে। অনেক পণ্যের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় বেশিও। বিশেষ করে রবিশস্য মৌসুমে শীতের নানা সবজিতে ভরেছে বাজার। তবে এবার সবজি থেকে শুরু করে চাল-তেল-পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। পেঁয়াজ আর আলুতেই ক্রেতার নাজেহাল হওয়ার জোগাড়।

মৌসুমেও সবজির দাম কেন চড়া- তার কোনও সদুত্তর নেই পাইকার কিংবা খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের। খুচরা ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, পাইকারি দরের চেয়ে সামান্য লাভে তারা বিক্রি করেন। দাম কমানো-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। আর দাম কমা-বাড়া নিয়ে পাইকারদের একেকজনের একেক রকম ভাষ্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার কারওয়ান বাজারের এক পাইকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, গত দুই সপ্তাহে বেশ কয়েকটি সবজির দাম কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। অনেক সবজির দাম কমেছে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। সামনে আরও কমবে। যদিও বাজার ভেদে সবজির দামে ফারাক থাকার কথাও স্বীকার করেন এই ব্যবসায়ী।

তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় নিয়মিত নজরদারি না থাকায় ব্যবসায়ীরা যখন যেমন ইচ্ছে দাম কমায় বাড়ায় বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। এমনকি বাজারে পণ্যের মূল্য তালিকা ঝুলানোর নির্দেশনা থাকলেও শুক্রবার রাজধানীর অন্তত পাঁচটি বাজার ঘুরে তা দেখা যায়নি।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে বাজার করতে আসা সাবিহা আকতারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। একটি প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র বেতনে কর্মরত এই তরুণী বাজার করতে দিশেহারা হয়ে পড়েন। সাবিহা জানান, তার মাসিক আয়ের একটি অংশ গ্রামে মা-বাবাকে পাঠাতে হয়। হাতে যে সামান্য টাকা থাকে তা দিয়ে ঢাকায় তার একার পক্ষে জীবন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নিত্যপণ্যের বাড়তি দামকে ‘মরার উপর খরার ঘা’ বলেই মন্তব্য করেন সাবিহা।

সাবিহা বলেন, ‘চাল, ডাল থেকে শুরু করে সব কিছুর দাম বেশি। সবজির দামটা অন্তত কম থাকা উচিত, সেটাও চড়া। করোনাকালে আমাদের আয় কমেছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বাড়তি খরচ। তার ওপর বাজারে এসে দাম শুনে হতবাক হয়ে যেতে হয়।’

সাবিহার মতোই বিপাকে পড়েছেন পেশায় স্কুল শিক্ষিকা মুসলিমা খানম। ঢাকার একটি এমপিওভুক্ত স্কুলে ননএমপিও শিক্ষক হিসেবে কর্মরত দুই সন্তানের এই জননী প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র বেতন পান। সবশেষ বেতন পেয়েছেন মার্চ মাসে। করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে ননএমপিও হওয়ার কারণে মুসলিমা খানমের বেতন এপ্রিল থেকে বন্ধ হয়ে পড়ে।

তিনি জানান, মহামারীর কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই নারীর স্বামীরও বেতনের বেশ কিছু অংশ কেটে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠান। স্বামী-স্ত্রী দুজনের আয়ে ভাটা পড়ায় সাংসারিক খরচ চালাতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত এই দম্পতি। বিশেষ করে নিত্যপণ্য আর বাচ্চাদের খাবারদাবার কিনতেই হাতে টান পড়ছে তাদের।

গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, পলাশী, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউনহল, শিয়া মসজিদ বাজার, খিলগাঁও বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক মাসের বেশি সময় ধরে বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে। কমেনি টমেটোর দাম। বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে পটল, মূলা, করলা, ঢেড়স, শিম। এরমধ্যে পটল ৬০ টাকা, মূলা ৪০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, ঢেড়স ৬০ টাকা, শিম ৬০ টাকা, কচুরলতি ৫০-৬০ টাকা, কচুরমুখি ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি। বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। তবে বাজার ভেদে গোল বেগুন ৬০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হতে দেখা গেছে। ঝিঙা ৫০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৫০ টাকা কেজি, কাঁচা মরিচ ১২০ টাকা কেজি, ধুন্দল ৬০ টাকা, শশা ৫০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, কলিসহ নতুন পেয়াজ ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

লাউ প্রতি পিছ ৫০-৬০ টাকা, ফুলকপি ও বাধাকপি প্রতি পিছ ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচকলার হালি ৪০ টাকা, চাল কুমড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা পিছ। এখনো শতকের ঘরেরি আগে গাজর। বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে। ক্যাপসিকাম কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৬০ টাকায়। আর আকারভেদে পিছ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়।

এদিকে সরকারের বেঁধে দেয়া দরে কোনো বাজারেই আলু বিক্রি হতে দেখা যায়নি। সরকার প্রতি কেজি আলুর দাম ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারের পাশাপাশি দোকান ভেদেও দামের বিস্তর ফারাক দেখা গেছে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে। দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি  বিক্রি হতে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। ভারতীয় পেঁয়াজ ৫০ টাকা এবং পাকিস্তানি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। দেশি আদা ৮০ থেকে ৯০ টাকা, চায়না আদা প্রতি কেজি ২৭০ থেকে ৩৩০ টাকা এবং রসুন দেশি ১১০ থেকে ১২০ টাকা ও ভারতীয় রসুন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়।

 

চালের বাজার

 

চালের প্রকার ভেদে মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকার মধ্যে, আটাস চাল ৪৮ টাকা, গুটি চাল ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা, নাজিরশাইল প্রকারভেদে ৫২ থেকে ৬০ টাকা ও আতপ চাল প্রতি কেজি ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা।

শাকের বাজার

 

পুইশাক আটি ৩০ টাকা, লালশাক ১৫ টাকা, পাটশাক ১০ টাকা, লাউশাক ৩০ টাকা, কলমি শাক ১০ টাকা আটি, মূলা শাক ১০ টাকা, পালং ২০ টাকা, ডাটা শাক ১০ টাকা ও সরিষা শাক বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা আঁটি। এছাড়া ধনিয়া পাতা ৬০ কেজি টাকা, লেবু ২০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে।

 

মাছের বাজার

 

মাছের বাজারে এখন ইলিশের রাজত্ব। তবে দাম তেমন কমেনি। এক কেজি আকারের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা কেজি দরে। সোয়া কেজি বা তার বড় ইলিশের কেজি হাজার টাকা। আর এক কেজির চাইতে কিছুটা ছোট আকারের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়।

এছাড়া প্রতি কেজি রুই মাছ ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা, কাতল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, চাষ করা পাঙ্গাস মাছ ১২০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি, নদীর পাঙ্গাস ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি, চাষের কৈ ২০০ টাকা, নদীর কৈ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, আইড় মাছ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি, চিংড়ি মাছ ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা, কাচকি ৩৫০ টাকা, শিং ৪০০ টাকা, রূপচাঁদা মাছ ৭০০ ও রিটা মাছ ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

মাংসের বাজার

 

কিছুটা কমেছে গরুর মাংসের দাম। ৫৫০ থেকে ৫৭০ টাকায় কেজিতে বিক্রি হওয়া গরুর মাংস এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা কেজি দরে। অপরিবর্তিত রয়েছে ব্রয়লায় ও সোনালী মুরগির দাম। ব্রয়লার মুরগি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা ও প্রতি কেজি সোনালী মুরগি ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

(ঢাকাটাইমস/২১নভেম্বর/ডিএম)