অণুকাব্য: পঞ্চপর্ণ: উদ্ধৃতি (পর্ব দুই)

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৩২

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

৩৪।

দুষ্ট লোকের দাপট এখন বাড়ছে শত গুণে,

কেউ দেখেনা সুস্থ সমাজ ধ্বংস করে ঘুণে।

নষ্টরা হয় সমাজপতি

সব সুজনের কী দুর্গতি!

শিষ্টেরা সব দৌড়ে পালায় আঁধার ঘরের কোনে;

পরলোকে পাড়ি দেবার মিনিট-সেকেন্ড গোনে।

৩৫।

আমরা যতোই দিনে দিনে হচ্ছি আধুনিক,

সুখের চেয়ে অস্থিরতাই বাড়ছে ততোধিক।

মূল্যবোধের অবক্ষয়ে

সমাজ ঘোরে পাপ বলয়ে;

এমন আজব সভ্যতাকে ধিক রে শতধিক।

 

৩৬।

দোয়েল নাচে পুঁইয়ের মাচায়, তুমি নাচো ডিস্কোতে,

নাই যে রুচি শরবতে আজ হুইস্কি ঢালো বিস্কুটে।

সূরার নহর সাকী’র বহর

গেলায় তোরে নেশার জহর

আমার দেশের কৃষ্টি আচার ডিস্কোরে তুই নিস্ লুটে।

 

৩৭।

চরকাতে তেল মাখছে চতুর,তাইতো তেলের দাম বাড়ে,

চরকাটা কার সেই ভাবনার সে কী কভু ধার ধারে?

হোক তা পরের হোক অচেনা

কিচ্ছু তাতে যায় আসেনা;

তেল মারা যার স্বভাব; সেতো চরকা পে’লেই তেল মারে।

 

৩৪।

জীবন যেন যন্ত্র না-হয় যন্ত্রণাতে পড়ে,

উচ্ছ্বলতার উৎসারণে জীবন থাকুক ভরে।

ফুরফুরে ভাব জাগিয়ে মনে হোকনা তেমন সুখি,

টুকটুকে লাল জামায় যেমন ফুটফুটে এক খুকি।

 

৩৫।

ডরালে দুর্বিপাকে তখন তোকে আর তরাবে কোন কাণ্ডারি?

সকলে ছাড়বে তোরে নিজের ঘোরে করবি নিজের সমন জারি।

নিজের মনে ভরসা রেখে নিজেই দিবি সাগরপাড়ি,

দেখবি তখন তোর মুলুকে তুই নিজে তোর মনবিহারী।

 

৩৬।

মাটির ভরসা সব শেষ হলে,শেষ ভরসা আসমানে,

ওই ভরসাই আসল ভরসা, ওরই আছে শুধু খাস্ মানে;

তাঁর ভরসার কৃপা সে-ই পায় নিজকে যে খোদার দাস্ মানে।

 

৩৭।

জীবনের ঘাটে ঘাটে যতো গাঁটে বাঁধা আছে সংযোগ ডোর,

সব গাঁটছড়া যেনো নিজের নিযুক্তি রসে নিত্য বিভোর।

কখন বাঁধন ছিঁড়ে কোন সংলাগ কোথা উবে যায়!

নিয়তির ঘেরাটোপে সকলের অজানিতে অতলান্তিকে ডুবে যায়।

তবুও মানুষ কেবল বাঁধনে বাঁধনে জড়ায় নিজের জগত,

যদিও সে ছুটতে দেখে নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে মিত্রতার রথ।

 

৩৮।

কালো বিড়াল যতোই রাখো থলের ভেতর বন্দি করে,

থলের বিড়াল থলের মাঝেই কালোর সঙ্গে সন্ধি করে।

পাপের ঘড়া পূর্ণ হলেইথলের বিড়াল বেরিয়ে আসে,

তোমার সকল ফন্দি তখন হয় যে নিপাত সর্বনাশে।

 

৩৯।

সিঁড়ি ভাঙছি,হাঁটু ভাঙছে; এখনো হাজার সিঁড়ি বাকি,

ভাঙা হাঁটু নিয়ে,পাও টেনে তবু সিঁড়ি-ভাঙাতেই লেগে থাকি।

হাঁটু ভেঙে আমি পঙ্গু হয়েছি শেষ সিঁড়ি আজো যোজন দূর,

সেই সিঁড়িখানা ওই ঠিকানায় যেখানে দমের অন্তপুর।

 

৪০।

আকাশের পূর্ণিমা চাঁদ হয়ে নয়,

সুদূরের ঝিকিমিকি তারা হয়ে নয়,

মাটির মায়াবী হয়ে প্রেমালিঙ্গনে

বাঁধা থেকো হৃদয়ের উষ্ণ বাঁধনে।

 

৪১।

আমার চোখের সাগরে—

নোনা জলের ঢেউ খেলে যায় ঢেউ,

সেই বাঁধ-ভাঙা জল ঝর্ণা ঝরায়

সোহাগের ছোঁয়া দিলে কেউ।

 

৪২।

অশ্রু ফোঁটার মাঝে গড়েছে ঠিকানা,

শিশির বিন্দু আর মুক্তোর কণা।

 

৪৩।

জীবনের তারতম্যের কতো-যে নকশা

আঁকে মহাকাল,

দরিদ্রের জন্য জীবন মরিচের ঝাঁঝালো চাতাল।

 

৪৪।

কেবল অশ্রু ছাড়া  যাদের গহন মর্মে নাই আর কোন সঞ্চয়,

তারাই প্রচার করে; কান্নার মানে হলো অশ্রুর মহা-অপচয়।

 

৪৫।

কথার কোনো সিলেবাস নেই, নেই কোনো ইশকুল,

তাই কথাদের নেই সীমারেখা, নেই কোনো দিশকূল।

কথায় কথায় কথার দেয়াল তুলে,

তোমাকে কেবলি আড়াল করি কথার গণ্ডগোলে।

প্রেমের চিত্রে কথাদের রঙ বড়োই অলুক্ষনে,

ব্যথার রঙেই তোমাকে পেয়েছি বিমূর্ত চিত্রণে।

 

৪৬।

কিছু বন্ধনে থাকে আর্ত নিনাদ,

কিছু বন্ধনে থাকে মুক্তির স্বাদ।

ফুল যদি বাঁধা পড়ে প্রেমেরই ডোরে,

ফুল সেই বাঁধনকে বাঁধে আরো জোরে।

 

৪৭।

অভিজ্ঞতার গুলতির ঘায়ে তছনছ

সোনা-তন্তুর স্নেহ নীড়ের নীরিহ শৈশব,

সময়ের গর্ভ থেকে ক্যাকটাস বনে

শেয়াল-শাবক করে কেবলি প্রসব।

 

৪৮।

প্রেমের আকুতিতে মন যদি বাঁধা না-ই পড়ে

নিস্ফল তবে প্রেমের সকল আরতি?

অন্ধ চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু যদি ঝরে

সে কান্না ফেরায় না চোখের বিলুপ্ত জ্যোতি?

প্রেমহীন পাথুরে প্রাণ আর দৃষ্টিহীন নিশ্চল চোখ,

একটা নিষ্প্রাণ পুত্তলি; অন্যটা নিরর্থ গোলক।

 

৪৯।

মনের কথা বলতে যে চাও, শোনার মতন মানুষ কই?

দুধ খেয়ে আগে মুখ পোড়া গ্যাছে,এখন ফুঁ দিয়ে খাচ্ছ দই।

তোমার দু:খ কেউ শুনবে না; সকলেরই মুখে কথার খৈ,

‘মনের মানুষ’ বলে কেউ নেই; সকল মানুষই চলনসই।

 

৫০।

ইতিহাসের পাতায় পাতায় নব্য ইতিহাস,

ভাতা পাওয়া ঐতিহাসিক কাটে ঘোড়ার ঘাস।

ইতিহাসের আসল পাতা

কাটছে পোকায় করছে যা-তা

সত্য ইতিহাসটা এখন দারুন পরিহাস।

 

৫১।

ইট বালুতে এমন ভীষণ শক্ত করে,

কোন্ উপাদান বিশাল বিশাল প্রাসাদ গড়ে?

আরসিসি’র ঐ ঢালাই ক’রে

মজুর ঝরায় ঘাম অঝোরে;

এই ঘামই কি সেই উপাদান ভিত-অনড়ে-

কওতো দেখি সেই কথাটা সত্যি করে!

 

৫৫।

ইনি এসে নীতি বানান,তিনি এসে বদলান,

ইনি এবং তিনি কেবল নব্য নীতি কচলান।

নীতির আবাদ চলছে নিতি

পায়না নীতি শক্ত ভিতই

এমন হলে কোন্ সে-নীতি আনবে দেশের কল্যাণ?

 

৫৬।

কালের কলস থেকে জল ঢালে সময়ের ধারা,

সে ধারায় তৃষ্ণা মেটায় ভাগ্যবান পিপাসিত যারা।

এ ধারার মতি গতি চলাচল ভারি একরোখা,

নিয়তি আমার দিকে সে ধারার ঘুরায় না চাকা।

তিয়াস মেটাবো কী; ঠোঁট ভেজানোই বড়ো দায়,

মুখের কাছেই এসে সে ধারার প্রবাহ ফুরায়।

সে ধারা বাষ্প হয়ে কাক-কালো মেঘেতে লুকায়,

জলের আকুতি আমার কাঠফাটা কন্ঠে শুকায়।

 

৫৭।

দু্য়ারে দুয়ারে তালা,কপাটে কপাটে খিল,

আমাকে ঘিরেছে এখন বৃত্তাকার বাধার পাঁচিল।

হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে আছি নিষেধাজ্ঞার যম ঘেরাটোপে,

খানিক নড়তে গেলে পড়ে যাই ফনিমনসার ঝোঁপে।

‘মুক্তি চাই, মুক্তি চাই’ বলে যতো করি আহাজারি,

ঘাড়ের উপরে পড়ে আচমকা কিরিচ-কাটারি।

এ সব তো কিছু নয়; সময়েরই সুতীক্ষ্ণ ধার,

সময়ের ধার মানে ঘাতকের নাঙ্গা তলোয়ার।

সময়ের সুখ-সঙ্গ একদিন যায় ফুরিয়ে,

সময় স্বভাব বশে তীরের নিশানা দেয় ঘুরিয়ে।

 

৫৮।

তোমার বাবা তোমার নাম রেখেছিলেন হেমাঙ্গি;

সে সূত্রে আমিও তোমার আদুরে নাম দিয়েছি ‘হেম’,

আর আমার বাবা আমার নাম রেখেছিল্ন শ্যামল,

কিন্তু সে সূত্রে তুমি আমার আদুরে নাম দিলে না ‘শ্যাম’।

‘হেম’ আর ‘শ্যাম’ মিলে আমাদের দেহাতীত প্রেম,

তুমি তাতে জড়ালে না মন; আমি তাতে সবি হারালেম।

 

৫৯।

এক্কাদোক্কা খেলে ভাগ্য কপালের ভাঁজে,

কারো কারো বরাত পড়ে করাতের খাঁজে।

পা থেকে সরে যায় নিয়তির সিঁড়ি-মই,

চেষ্টা-চরিত ভাজে অকাজের যতো খৈ।

মানুষ কর্ম করে ঘর্মপাতে,

ফলাফল সব থাকে বিধাতার হাতে।

 

৬০।

তুই ছুঁয়ে দিলে ফুল হয়ে যায় আগুনের কণা ফুলকি,

তুই ছুঁয়ে দিলে নিথর অঙ্গে চাল জেগে ওঠে দুলকি।

তুই হাত ধরে তুলে নিলে তবে মিলবে না তবু কূল কি?

তোর আলিঙ্গনে শুধরে যাবে না জীবনের সব ভুল কি?

 

৬১।

পাথরে পাথর ভেঙ্গে যারা শোধ করে জীবনের দায়,

ঘামের নোন্তা নহর পাথরের শুকনো অঙ্গে শুকায়।

জীবনের স্বপ্ন সাধ পাথরের অন্তস্থ মর্মে লুকায়,

পাথুরে জীবন জীর্ণ জীবিকারও গ্রাস না জোটায়।