দখলে অস্তিত্ব সংকটের মুখে রামচন্দ্রপুর খাল

প্রকাশ | ২২ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২৫

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

পয়োনিষ্কাশন খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার কথা থাকলেও দখলদারদের কারণে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালটির এখন বেহাল দশা। খালের বিভিন্ন অংশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে পাকা, আধাপাকা স্থাপনা। গড়ে তোলা হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া খালের বিভিন্ন জায়গায় অনবরত ফেলা হচ্ছে ময়লা। খালের তলদেশে প্লাস্টিক জমে পানির প্রবাহ এখন নেই বললেই চলে।

এভাবে চলতে থাকলে খালটি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় অধিবাসী আর সিংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজন।

এই খালের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা। সম্প্রতি ওয়াসার নিয়ন্ত্রণাধীন ২৬টি খাল সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের কথা ছিল। সে প্রক্রিয়া এখনো ঝুলে আছে। ফলে এখনো খালের দায়িত্ব ওয়াসার কাঁধেই। খালের কাজ না করে হস্তান্তর প্রক্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

ওয়াসার তথ্যানুযায়ী, রামচন্দ্রপুর খালের দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৯৪০ মিটার। কিন্তু বর্তমানে আছে দুই হাজার ১৩১ মিটার।

মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদী হাউজিং থেকে শুরু হয়ে মোহাম্মদপুর আদাবর ১৬ নম্বর রোড পার হয়ে কল্যাণপুর খালে গিয়ে শেষ হয়েছে রামচন্দ্রপুর খাল। খালের মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড ৬ ও ৭ নম্বর সড়কে খালের ওপর গড়ে উঠেছে পাকা স্থাপনা। একই অবস্থা ৫ নম্বর সড়কে। খালের এ অংশে খালের প্রস্থ ২০ ফিটের চেয়েও কম।

মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ৩ নম্বর সড়কে খাল সংলগ্ন কালভার্টের পাশে মাটি ভরাট করে বসানো হয়েছে চায়ের দোকান। পাশে খালের উপর গড়ে তোলা হয়েছে মসজিদ। স্থানীয়দের ভাষ্য, মসজিদ সংলগ্ন একাধিক বাড়ি খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে।

লিমিটেড ১ নম্বর কালভার্টের পাশে একইভাবে বসানো হয়েছে ক্যারাম বোর্ড। মোহাম্মদীয়া হাউজিং এর মূল সড়কে ধরে নবোদয় হাউজিং এলাকার দিকে গেলে খালের উত্তর অংশে জায়গায় জায়গায় দখলের চিত্র চোখে পড়ে। নবোদয় হাউজিং লোহার গেটের বিপরীতে খালের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি পাকা দোকান। দখলদার খালের এ অংশটি ভরাট করে সেখানে দোকান করে ভাড়া দিয়েছেন।

দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৪০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে তারা দোকান ভাড়া নিয়েছেন। আর প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ গুনতে হয় চার হাজার টাকা।

আবার দোকানের পেছনের অংশে নির্মাণসামগ্রী ফেলে খালের প্রায় ২০ ফিট জায়গা দখল করে রাখা হয়েছে। সোহরাব ব্যাপারী নামে এক ব্যক্তি খালের এ জায়গাটি দখল করে গড়ে তুলেছেন রিকশার গ্যারেজ। প্রতিদিন বিকেলে এবং সন্ধ্যার পর তার এ গ্যারেজে চলে ইয়াবা ও গাঁজা সেবন- এমন অভিযোগ রয়েছে।

নবোদয় বাজার এলাকায় খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বস্তি। শ্যামলি হাউজিং, শেখেরটেক, আদাবর পর্যন্ত এলাকায় খালের দুই পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে টং দোকান। খালের পাশে জমি কেনা ব্যক্তিরা বাড়ি তোলার সময় দখল করেছেন খালের পাঁচ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত জায়গা। কোথাও কোথাও দখলের পরিমাণ আরও বেশি।

কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালের মুখে জাকের ডেইরি ফার্ম নামে একটি দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা গড়ে তুলেছেন।

এছাড়া পুরো খালের দুই পাশে থাকা দোকানগুলোর ময়লা ফেলা হচ্ছে খালে। এমনকি খালসংলগ্ন বাড়ির জানালা দিয়ে খালে ময়লা ছুড়ে ফেলার চিত্র দেখা যায় প্রতিনিয়ত।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে মোহাম্মদীয়া হাউজিং এলাকার একজন বাড়ি মালিক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘খাল যেমন দেখতেছেন, খাল এমন ছিল না। খাল ঠিকভাবে মাপা হলে খালের পাড়ের অনেক বাড়ি ভাড়া পড়বে। একজন আইনজীবী, একজন নেতা, একজন বড় ব্যবসায়ী। তারা নিজেদের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ওয়াসাকে টাকা দিয়ে খাল ছোট করছে। নিজেদের জায়গা বড় করে নিছে।‘

খালের এ অংশটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ওয়ার্ডটির কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ ঢাকা টাইমসকে জানান, খাল দখলে চিত্র এরই মধ্যে তার দৃষ্টিটি এসেছে। দখলের একটি খসড়াও করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

আসিফ আহমেদ বলেন, ‘খালকে দখলমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি খালে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে আমরা কাজ করছি। স্থায়ী সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আমি আবেদন করব। এরই মধ্যে আবেদনপত্রও তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে সবার বিশেষ করে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন।‘

খাতা কলমে রামচন্দ্রপুর খালসহ ঢাকার ২৬টি খালের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার হাতে। সম্প্রতি এসব খাল সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করতে একটি সভার ডেকেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। অজ্ঞাত কারণে সে সভা বা খাল হস্তান্তর এখনো হয়নি। ফলে বর্তমানে এ খাল ওয়াসার দায়িত্বেই রয়েছে।

ওয়াসার প্রকৌশল বিভাগের পরিচালক শহীদুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে জানান, সিটি করপোরেশন খালের দায়িত্ব গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু এখনো তারা খাল বুঝে নেয়নি।

শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘খালের বিভিন্ন স্থানে দখল রয়েছে, খালের ময়লা জমে আছে। খাল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা, দোকানদাররা খালে ময়লা ফেলছে। অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। পাশাপাশি খালও পরিষ্কার করা হবে।‘

এদিকে ঢাকার এই ২৬টি খালের বিষয়ে রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টার (আরডিআরসি) বলছে, খালগুলো অপরিকল্পিত। আরডিআরসির সভাপতি মোহাম্মদ এজাজ ঢাকা টাইমসকে জানান, রামচন্দ্রপুর খালের মূল আয়তনের অনেকটাই বিলিন হয়ে গেছে। খালের বিভিন্ন অংশে দখলের পাশাপাশি খাল বনে গেছে ময়লা ফেলার জায়গা।

এজাজ বলেন, ‘খালটির সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি। খালের সীমানা নির্ধারণ করা হলে সবার কাছে স্পষ্ট হবে যে আসলে খালটা কতটুকু। আমরা এ বিষয়ে যৌথ জরিপের আহ্বান করেছিলাম।‘

খালকে ময়লা ফেলার জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘খালের বিভিন্ন স্থানে ময়লা ফেলা হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গা ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গার মতো হয়ে গেছে। এসব জায়গায় উঁচু প্রচীর করে দিতে হবে। যেন কেউ ময়লা ফেলতে না পারে।‘

খালটি বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে খালটি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন এই নদী গবেষক।

(ঢাকাটাইমস/২২নভেম্বর/মোআ)