অণুকাব্য: পঞ্চপর্ণ: উদ্ধৃতি (পর্ব আট)

প্রকাশ | ২৫ নভেম্বর ২০২০, ১০:৪৮

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

২০১.

কালের চক্রব্যূহে পৃথিবীর মনুষেরা

আজ অব্দি যতো শ্বাস নিয়েছে,

বোধকরি তারো বেশি প্রেম নিয়ে কথোকতা হয়েছে।

বচনে লিখনে কতো প্রিতম-প্রিতমা

কতো এলো মিতা-মিতু,

তবু হলো না যে প্রেম হৃদয় চাতাল জুড়ে

নিজ ভূমে থির-থিতু।

বলাবলিতেই বুঝি প্রেম শুধু করে যাবে

তার সব মাহাত্ম জমা !

জীবনের চিৎ স্রোতে মিলবে না কোন যতি

মিলবে না কোন দাড়ি কমা !

 

২০২.

সুখের যে ছক এঁকে হাওয়ায় উড়াও তুমি

ফুরফুরে রঙিন ঘুড়ি,

সে মতে সুখ না এলে; ভাববে এ ছকে নেই

বিধাতার শুভ মঞ্জুরি।

তবুও ভরসা রেখো আল্লাহর উপর,

সুখ দু:খ সবই তাঁর ছকের ভিতর।

 

২০২.

এই ব্যাডা ট্রাম্পে কি প্যাঁচাল পাড়ে!

মওকা পাইলে কেবল বক্তৃতা ঝাড়ে।

ব্যাডার প্যাঁচাল হুইন্যা পিত্ত জ্বইল্যা যায়,

ভ্যাকসিনের কতা কিচ্ছু কয় না হালায়।

আরে ব্যাডা বাদ দে উহান আর চীন,

সাফ কইরা বল কবে দিবি ভ্যাকসিন?

আজাইরা প্যাঁচাল পাইড়া হইস না পাগল,

ভ্যাকসিনের শেষ খবর জানা থাকলে বল।

তোর জেবে ভরি রাক কোভিড আর চীন,

সাফ সাফ বল কবে পামু ভ্যাকসিন।

 

২০৩.

ফেলে আসা দিন কি ফিরে পাওয়া যায়!

এ কালে কি সে কালের সুরে গাওয়া যায়!

নিত্যের ঘেরাটোপে অনিত্য সুদূরে হারায়,

আগামীর আবাহনে বর্তমান দুবাহু বাড়ায়।

পাণ্ডর হাসি হেসে স্মৃতির ভেলায় ভেসে

অনাগত দিন এসে

সময়ের বাঁকে বাঁকে মর্মে লুকায়,

সুখস্মৃতি চৈত্রের চাতালে শুকায়।

 

২০৪.

সকলে যদিও জানে এ প্রবাদ,

“বিনাশ কালে বুদ্ধি নাশ,”

তবু অকারণে লোকে কেনো করে

কূটবুদ্ধির আগাছা চাষ ?

 

২০৫.

সুখকে হঠাৎ দেখি আমাদের চৌকাঠে,

বল্লাম,”কিরে ভাই! কেনো এই তল্লাটে?

পথ ভুলে এলে নাকি অভাগার আঙ্গিনায়?

তোমাকে দেখলে ভারি উদ্বেগ বেড়ে যায়।

কতোক্ষণ রবে তুমি সে আশংকায়!

পলে পলে থাকি অতি উৎকণ্ঠায়।

খানিক ঝলক দিয়ে ফিরো নিজ নীড়ে,

আমার বসতি আবার  দু:খেরই কুটিরে।

 এসেই পড়েছো যখন থাকোনা খানিক,

কষ্টের আগুনে পোড়াও দু:খের মাণিক।

 

২০৬.

নষ্টের দখলে যদি সবই চলে যায়,

সুশীলের বাঁচবার তবে কী উপায়?

নষ্টের ধারাপাতে কষ্টে সুজন,

মুক্তিও দূরে তাই যোজন যোজন।

 

২০৭.

এটা চাই, ওটা চাই; চাওয়ার আর নাই যেনো শেষ,

এক চাওয়া পূর্ণ হলে, আরেক চাওয়ার ঘটে নব উন্মেষ।

চাওয়া আর পাওয়া নিয়ে হিসাবের খুলি যতো খাতা,

যোগেরা  বিয়োগ হয়ে ভরে থাকে ক্ষতিটার পাতা।

কোন চাওয়া প্রয়োজনে, কোন চাওয়া প্রলোভনে

সে প্রভেদ বোঝে না অধম,

চাওয়া তবু নাই কমে; যেই ক্ষণে টানে যমে

মানুষের শেষ ক্ষীণ দম।

 

২০৮.

জীবনটা যদি হতো আলেখ্য, চিত্রকর্ম  আঁকাআঁকি,

জীবনচিত্রে কল্পনা রঙের আল্পনা হতো মাখামাখি।

সেই আল্পনা নানা সংলাপে ফুটিয়ে মনের কথকতা,

তুলির মমতা রঙের ভাষায় ভরে দিতো সব শূণ্যতা।

 

২০৯.

খেটে খেটে যতো মরি, সুখ নেই বরাতে,

জন্মই হ’লো বুঝি শুধু ঘাম ঝরাতে!

সুখ বামে নাকি ডানে; সব লোকে সাফ জানে

আমি আছি নিদারুন কী শাঁখের করাতে!

 

২১০.

কোভিডের পর যদি এলোমেলো বিশ্বের

স্বভাবিক গতিধারা কাঙ্খিত একতানে

ফিরে আসে ছান্দিক দ্যোতনায়,

পাখিডাকা কোনো ভোরে স্মৃতিকাতরতা ডোরে

সুহৃদ আর স্বজনকে বেঁধে নেবো পুলকের

কবোষ্ণ যোজনায়,

মিলনের প্রমত্ত মোহনায়।

 

২১১.

কিছু মানুষ আছে এমন বিবেক বর্জিত,

পশুও তাদের দেখে হয় লজ্জিত।

পশুরও অধম যদি হয় মানুষেরা;

কী করে মানুষ রবে সৃষ্টির সেরা?

 

২১২.

কালো কালি দেখো সাদা কাগজে লিখে চলছে এতো লেখা,

সাদা-কালোর এই মধুর মিলনে তবু কি হলো না পাঠ শেখা?

বর্ণ বিভেদ জিইয়ে রাখাটা সভ্যতার এতো কোন ঠেঁকা?

 

২১৩.

তোমার মুখে তালা  লাগায়, সে সাধ্য কার বাপ দাদার!

মুক্তবাকের এমন তালা, ঘোর বিরোধী সভ্যতার।

স্বাধীন মানুষ পরবে কেন শৃঙ্খলের এই অলংকার?

নিজের ঠোঁটে ঝুলায় তালা কোন ফ্যাশনের গুলবাহার?

 

২১৪.

জীবটা ভর কাটলাম আমি পরের ঘোড়ার ঘাস,

পরের সুখের পোদ্দারিতেই জীবটা হলো নাশ ।

আমার গড়া স্বর্ণশিখরে তাদের স্বর্গবাস ,

তাদের গড়া পর্ণকুটিরে আমার দীর্ঘশ্বাস ।

ফ্যাশনে বাহারে কলকোলাহলে তাদের ভোগ-উল্লাস,

বৃদ্ধাশ্রমের আঁধারে আমার নির্জন কারাবাস।

 

২১৫.

প্রশ্ন: লেখক কে?

উত্তর: যিনি লেখেন।

: তাই লেখক হতে চাইলে,

 আপনিও লিখুন,

কারণ, যিনি লিখেন; তিনিই লেখক।

 

 ২১৬.

আল্লাহ্ আল্লাহ্ জপলি মন,

পাইলি না তাঁর দরশন,

নবীর নূরের পিদিম জ্বেলে,

খুঁজে নে সেই গুপ্তধন।

 

২১৭.

তুমি মাঝি থাকলে রাজি ভাঙ্গা তরী ভিড়ে তীরে,

(তোমার) গররাজির ওই কারসাজিতে

নাও ডোবে অথৈ সাগরে-

তুমি মাঝি থাকলে রাজি ভাঙ্গা তরী ভিড়ে তীরে।।

উথাল পাথাল ঢেউয়ের ঘায়ে,জল ভরে যায় ভাঙ্গা নায়ে,

আছি যে কী বিষম দায়ে নাও লয়ে এ তুফান ঝড়ে-

তুমি মাঝি থাকলে রাজি ভাঙ্গা তরী ভিড়ে তীরে।।

মাল্লারা সব ডুবলো জলে সর্বনাশা জলের ঢলে,

ভাঙ্গা হালে ছেঁড়া পালে কূল পাবে নাও কেমন করে-

তুমি মাঝি থাকলে রাজি ভাঙ্গা তরী ভিড়ে তীরে।।

সোনার ফসল ভরে নায়ে, পাড়ি জমাই অচিন গাঁয়ে

নাই রে সাথি ডাইনে বাঁয়ে; ধন লুটে নেয় জল-হাঙ্গরে-

তুমি মাঝি থাকলে রাজি ভাঙ্গা তরী ভিড়ে তীরে।।

বুঝলে আমি তোমার চাওয়া ছেঁড়া পালে লাগতো হাওয়া

চলতো আমার তরী বাওয়াশভাঙ্গা হাল আর বৈঠা ধরেই-

তুমি মাঝি থাকলে রাজি ভাঙ্গা তরী ভিড়ে তীরে।।

 

২১৮.

আকাশ থেকে জ্যোৎস্না ঝরে, বাতাস থেকে সাড়া,

জোনাক থেকে আলোর সোনা, ঝর্ণা থেকে ধারা।                   

আঁচল থেকে আদর ঝরে , মায়ের সোহাগ উপচে পড়ে-         

তাদের ঝরে অশ্রু; যারা মায়ের বাঁধনহারা।

 

২১৯.

নব বর্ষেও হর্ষ জাগে না মনে,

মৃতের মিছিলে হাহাকার হুতাশনে।

বুকের উপর ঝুলছে তীক্ষ্ণ ত্রিশুল,

আনন্দধারা বিরহ বিলাপে ব্যাকুল।

 

২২০.

অভাগার ধন কেড়ে গড়লে প্রাসাদ,

শুনবে না নি:স্বের কোনো ফরিয়াদ।

পূর্ণ যতোই করো জীবনের সাধ,

তার মাঝে বঞ্চিতের আর্ত-নিনাদ।

কার ধন কতটুকু কেড়েছো কখন,

একান্তে সে হিসাব চায় যদি মন-

স্বস্তিতে কাটে না-যে আরামের রাত,

মর্মপীড়নে চোখ করে বারিপাত।

ঝলমল মখমল সুকোমল শয্যায়,

নির্ঘুম রাত কাটে বিবেকের লজ্জায়।

 

 

২২১.

মানুষকে বিশ্বাস করে কতো যে ঠকেছো,

তাই কতোবার নিজে নিজেকে বকেছো।

তবু সেই একই ভুল করো বার বার;

চৈতন্য  হয় না কভু আজন্ম বোকার।

 

২২২.

চিনির সাথে নুনের মিশেল দুধের সাথে পানি,

চালের সাথে কাঁকর মিশাও টাকার সাথে আনি।

আলতা-দুধে মিশলে যে হয় রঙ যে মনের মতো,

ঘিয়ের সাথে তেল মিশালে লাভটা অবিরত।

মাইনেটাকে মেশায় যারা উপরি-পাওয়ার সাথে,

বংশ পরম্পরায় তারা  থাকে দুধে ভাতে।

নিয়ম-নীতির সঙে যারা মিশায় স্বজনপ্রীতি,

শুনতে পাবে চতুর্দিকে তাদের ভজন-গীতি।

নগ্নতাকে মিশাও যদি কাব্যরসের সাথে,

প্রকাশকের হাত বেয়ে লাভ পড়বে তোমার পাতে।

সত্যি সাথে মিথ্যেটাকে মিশাও নিপুন হাতে,

সাধু-সাধু ভাব মিশাবে চাটুকারির সাথে।

উত্তম ও মধ্যমে মিশে ঘুষির সাথে কিল,

তেলের সাথে জল মিশানো তালের সাথে তিল।

মিশামিশির পাঁচ মিশালির চললে এমন ধারা,

আসল-নকল ফারাক করার বিবেক যাবে মারা।—