অণুকাব্য: পঞ্চপর্ণ: উদ্ধৃতি (পর্ব নয়)
প্রকাশ | ২৫ নভেম্বর ২০২০, ১৮:১৪
২২৩.
চারদিকে দেখে বিরুদ্ধ স্রোত;ছেড়ে দিয়ে সব হাল,
বিবির আঁচলে মুখ লুকালে কি, দূর হবে জঞ্জাল?
তোমার মুক্তি তোমারই তো দায়,নেবে না সে দায় কেউ,
তোমার বুকের পাঁজরে ভাংবে প্রতিকূলতার ঢেউ।
২২৪. জোনাকির আলো জ্বলে ঝোঁপ-জঙ্গলে, তারাদের আলো জ্বলে বুধ-মঙ্গলে। আকাশেতে যায় ভেসে মেঘেদের ভেলা, জলধির বুকে ঢেউ খেলে দোল খেলা। আকাশের মাঝে উড়ে ঝাঁক-বাঁধা পাখি, ঝরাপাতা উড়ানি যে কালবৈশাখি। সুনীলের বুক জুড়ে নীল রং আঁকা সাগরের বুক থাকে নীল জলে ঢাকা। চাঁদে করে বসবাস জোছনার পরি, মায়াময়ী মা-ও আলা করে সব ঘরই। যেই রূপে হাসে চাঁদ আকাশের কোলে, সেই রূপে শিশু হাসে মা’র আঁচলে। শূন্যেই ব’য়ে যায় যেই সুবাতাস, সে বাতাসই মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস। মেঘ কেঁদে কেঁদে যেই বৃষ্টি ঝরায়, চোখ থেকে সে রূপেই অশ্রু গড়ায়। অরুণের বুকে জ্বলে লালিমা-আগুন শহীদের বুক থেকে ঝড়ে তাজা খুন। মাটি আর আকাশের যতো লেনাদেনা দূর থেকে কাছে আনে দূরের সীমানা। সুদূর আর নিকটের সব আয়োজন অসীম আর সসীমের সেতু বন্ধন।
২২৫.
বরফ গ’লে বরফ গ’লে বরফগলা নদি,
বইতো যদি আমার দেশে নিত্য-নিরবধি!
মনের জমাট বরফ গ’লে ডাকলে নদে বান,
বানের জলে ডুবতো তবে রুদ্ধ অভিমান।
বুকের সঙ্গে বুক জড়িয়ে উষ্ণ করে মন,
সেই নদীতে ক্ষোভ-প্রতিমার দিতেম বিসর্জন।
অবিশ্বাসের গললে বরফ বিবেকবোধের তাপে,
ডুবতো না আর আমার স্বদেশ সন্দিহানের পাপে।
অহমবোধের বরফ গলে উদার আলিঙ্গনে,
আস্থা জাগায় স্বস্তি আনে আস্থাহীনের মনে।
উষ্ণ স্বদেশপ্রেমে যদি দ্বিধার বরফ গলে,
সে উষ্ণতা আঘাত হানে হিমের হিমাচলে।
উচ্চ-তুচ্ছ ভেদাভেদের প্রাচীর যেতো ঘুচে,
আমজনতা অভাগাদের কষ্ট যেতো মুছে।
এমন হলে বইতো দেশে সুখের ফল্গুধারা,
এগিয়ে যেতো অগ্রগতির অশ্ব বাঁধনহারা।
ঐক্যবোধের ঐকতানে উদ্দীপনার তালে,
নতুন দিনের লাগতো হাওয়া লাল-সবুজের পালে।
২২৬. ভাঙ্গা-গড়া, ভাঙ্গা-গড়া, ভাঙ্গা গড়ার খেলা, ভাঙ্গাই কেবল নিত্য চলে গড়ার বেলায় হেলা। ভাঙ্গা হলে বেপরোয়া গড়াটাকে গড়ার চাবি যাবেই খোয়া গড়াটাকে ভেবোনা ছেলের হাতের মোয়া, গড়তে হলে খাটতে হবে, চাইযে প্রাণের ছোঁয়া। নিত্য যদি ভাঙ্গাই চলে নির্বিচারে খড়গ এসে পড়বে গড়ার নাজুক ঘাড়ে গড়ার ছাঁচের সকল সাজই পড়বে লুটে বুঝবে তখন ভাঙ্গা-গড়া কী বিদঘুটে! ভাঙ্গার আগে অনুভবে গড়ার নেশা জাগতে হবে তা না হলে ধ্বংস স্তুপে থাকবে চাপা শবের রূপে গড়ার মতো সাধ, ভাঙ্গা হবে ভবিষ্যতের সব হারানোর ফাঁদ। ডোবার আগের জানতে হবে কোথায় ভাসার ভেলা নইলে হবে সর্বনাশা-ভাসা-ডুবার খেলা। তাইতো বলি ভাঙ্গা-গড়ার খেলা তেমন মন্দনা, বাস্তবে রূপ পায় যদি সব গড়ার পরিকল্পনা। ২২৭. পেতাম যদি গুলাল; পংখীরাজে চড়তাম আমি হতেম রাজার দুলাল। পেতাম যদি ঘোড়া; সেই ঘোড়াতে চড়িয়ে দিতাম, দু’পা-ই যার খোড়া। পেতাম যদি গাড়ি; সেই গাড়িতে চড়েই যেতাম চাঁদ মামাটার বাড়ি। পেতাম যদি টাকা; হাওয়ার মাঝে ঘুরতো আমার এ্যারোপ্লেনের চাকা। পেতাম যদি সোনা; সব জমিতে চলতো আমার সোনার ফসল বোনা। পেতাম যদি খনি; সকল ঘরে বিলিয়ে দিতামএকটা করে মণি। পেতাম যদি ছুরি; সেই ছুরিতে কাটতাম আমি সব পেটুকের ভূঁড়ি। পেতাম যদি চাবি; তুলতাম আমি ধনভাঁড়ারের তালা খোলার দাবী। পেতাম যদি কালি; সেই কালিতে লেপ্টে দিতাম আশার চোরাবালি। পেতাম যদি কলম; দুঃখ নামের দুষ্ট ক্ষতের লিখেই দিতাম মলম। পেতাম যদি তুলি; আঁকাতাম আমি ভা’য়ে ভা’য়ে প্রাণের কোলাকুলি। পেতাম যদি বাঁশি; সেই বাঁশিতে ছড়িয়ে দিতাম ঐক্য সুরের রাশি। পেতাম যদি গদি; সুখের বাঁধে রুদ্ধ হতো অশ্রু ধারার নদী। পেতাম যদি ছাতা; এক ছাতাতে গুঁজতে দিতাম ঊনিশ কোটি মাথা।
২২৮.
বই মেলা থেকে বাবা কিনে দিলো একটা নতুন বই,
সেই বইখানা যতো দেখি আমি ততোই অবাক হই।
উল্টে-পাল্টে সেই বই দেখি
কতো আঁকাআঁকি, কতো লেখালেখি
আপু সেই বই টেনে নিলে আমি জুড়ে দেই হৈ চৈ।
কতো যে আপন কতো প্রিয়জন ঝকমকে এই বই!
এখানে ওখানে কি লিখা, জানতে ব্যাকুল হয়ে-যে রই।
বইয়ে নেই রাজা-রাজপুত্তর, রাজকুমারী বা রাণী
সারা বই জুড়ে কাজলা দিদি বা মিনা-রাজু, আসমানী।
বইয়ে নেই কোন যুদ্ধ কাহিনী
উজির-নাজির সৈন্যবাহিনী
বইয়ে আছে তারা শিশুকাল থেকে যাদের চিনি ও জানি।
আমার সে-সব খেলার সাথীরা কষ্ট-ক্লিষ্টে বাঁচে,
সে কাহিনী পড়ে মন ছুটে যায় সেই সাথীদের কাছে।
একে-ওকে ডেকে বলি-সে গল্প মুখে যেনো ফোটে খৈ,
এর চেয়ে বড়ো সত্য কাহিনী আর আমি পাবো কই?
সে বই আমাকে সত্য শেখায়
ঝলমলে সব স্বপ্ন দেখায়
নিত্য-নতুন আলোর ছটায় আমি আলোকিত হই।
-
২২৯.
সঞ্চিত ধনে আছে বঞ্চিত মানুষের অধিকার, সম্পদ বন্টনে তাই তারা চায় সমহার। দুর্গত অভাজন ভুলে ব্যথা ক্রন্দন ঢালো ক্রোধ ভাঁড়ারের পাঁচিলে, যক্ষের যতো ধন করে দাও বিতরণ বিপন্ন মানুষের মিছিলে। শোষণের অবসানে হও সবে সমতার অবতার- সঞ্চিত ধনে আছে বঞ্চিত মানুষের অধিকার। কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত, কন্ঠেতে কন্ঠ
হৃদয়ে হৃদয় মিলাও, সাম্যের মতবাদে জাগ্রত জনতা
প্রাণে প্রাণে স্বপ্ন বিলাও। এই সারা বিশ্ব সবহারা নিঃস্ব-
নিপীড়িত মানুষের জন্য, কণা কণা যতো ধন করা হলে বন্টন
তারাইতো আগে হবে গণ্য। বঞ্চনার অবসানে ভাঙ্গো সব দুর্গম কোষাগার ; সঞ্চিত ধনে আছে বঞ্চিত মানুষের অধিকার- সম্পদ বন্টনে তাই তারা চায় সমহার।। -
২৩০.
মেঘ গুড় গুড় আকাশ থেকে বৃষ্টি যখন ঝরে,
মায়ের ছোঁয়া প্রাণে জাগে; মা-কে মনে পড়ে।
ও ঘর হতে মা’র আদুরে ডাক যেনো যায় শোনা,
টাপুর টুপুর বৃষ্টিতো নয়; মায়ের আনাগোনা।
মনে পড়ে বালক বেলার বাদলা দিনের কথা,
ঝড় তুফানে আমায় ঘিরে মায়ের ব্যকুলতা।
বজ্রপাতের শব্দে যখন হঠাৎ পেতাম ভয়,
মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ভয় করেছি জয়।
হঠাৎ পাওয়া ধনের মতো ধরতো চেপে বুকে,
মায়ের বাহুর বাঁধন আমায় ঘুম পাড়াতো সুখে।
বলতো ’আমি কাছেই আছি এই ছুঁয়ে দেখ গা,
শয়তানেরে গুর্জ মারে খোদার ফেরেশতা।’
আজ যে আমার মা নেই কাছে ঝড় বাদলের রাতে,
কার আঁচলে মুখ লুকাবো ভয়াল বজ্রপাতে।
আজকে যদি বাজ পড়ে মা তোর সে বুকের ধন,
কোথায় পাবে উষ্ণ বুকের আদর-আলিঙ্গন!
বৃষ্টি ধারায়, বজ্রপাতে,কালবোশেখির ঝড়ে,
নির্জনতার নির্যাতনে মাকেই মনে পড়ে।
২৩১.
আপোষের সাথে শুধু পাপোশের মিল আছে ঠাটে; পাদুকার ধূলো-মাটি উভয়ের সেরা উপহার, লিপ্সার পিশাচেরা মাথা কুটে মরে চৌকাঠে বাহারের গোলা ভরে মর্যাদা বিকিয়ে দেদার।
২৩২. বিপ্লবী হতে এসে কত লোকই হয়ে গেছে কবি নগরের কাকরাই রাখে সেই খোলা খতিয়ান , সূর্য সেন, প্রীতিলতা হয়ে গেছে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী বিউটি বোর্ডিং যেন গবাদির দিনান্ত বাথান। জীবনের কোলাহল এভাবেই যদি থেমে যায় আয়ু যদি টেনে দেয় জীবনের ঘোর যবনিকা, জীবনের সব ভার ঘাড় থেকে যদি নেমে যায় সময় লিখবে আর জীবনের কোন পাদটীকা?
২৩৩. প্রাপ্তির লোভে উন্নত শির যদি হয় পদানত, কালের ভাগাড়ে সে মানুষ হয় বর্জ্যেই পরিণত।