অণুকাব্য: পঞ্চপর্ণ: উদ্ধৃতি (পর্ব এগারো)
২৫৪.
নারীদের নেই ঘর, ঠিকানা বা বাড়ি,
হেঁসেলের চুলো-হাঁড়ি, ভাত-তরকারি-
এই ছকে বাঁধা তার
জীবনের অধিকার
যদিও মানব জাতির জননী এ নারী।
২৫৫.
পিরনি ফায়েশ সেমাই শিরনি পোলাও বিরানী কতো;
বানায় কোর্মা কোপ্তা কালিয়া,
প্রাণের মমতা দরদ ঢালিয়া,
অতিথির পাতে দেয় যে তুলিয়া বেহিসাবিদের মতো।
ঈদের দিনেও রয় ভেদাভেদ ঈদের খুশির দৃশ্যের;
কুলি মজুর আর গৃহহীন যারা,
অনাহারে থাকে রোজ রোজ তারা,
‘সব পেয়েছির দেশে’ সবহারা, ঈদ নেই সেই সি:স্বের।
২৫৬.
নিত্য খুঁজে 'কর্মখালি', জুতোয় দিলাম হাজার তালি,
বেকার জীবন দুর্বিষহ; চাকরি আশার চোরাবালি।
'বিজ্ঞাপনের' অলীক কথা, চাকরিতে চাই অভিজ্ঞতা,
চাকরি যেথা সোনার হরিণ! অভিজ্ঞতা মিলবে কোথা?
পার হয়েছি হাজার গলি,ক্ষয় করেছি জুতোর তলি;
নিঃস্ব হলাম পূর্ণ করে বস-দালালের পকেট থলি।
নাই দুলাভাই-মামু-খালু, নাই কোনো জ্যাক তেমন চালু,
লাভ কি হবে সূর্যতাপে গরম করে ব্রহ্মতালু?
২৫৭.
বড় বড় সব মাছ ছোট মাছ গিলে খায়,
জীব-প্রকৃতি চলে জীবিকার এ ধারায়।
মজুরেরা মরে খেটে, লাভ খায় তারা চেটে;
যারা পুঁজিবাদী ফাঁদ রাখে নিজ কবজায়।
দুর্বল মানুষের দু:খে দিন কেটে যায়,
সব সাধ স্বপ্ন সবলের পেটে যায়।
নিয়তির এই ফের সাধ্য কে খণ্ডায়,
দিন এলে বুঝে নিও পাই কড়া গণ্ডায়।
২৫৮.
চর্ম-চক্ষু মুদে অন্তর্দৃষ্টি করে উন্মিলন,
দেখতে পাচ্ছো তো বন্ধ্যা সভ্যতা:
বিশাল শূন্য তোমার তথাগত সকল অর্জন।
কতোটা পলকা তোমার নিরাপত্তা চৌকি!
জীবাণুর সংক্রমণ ভীতেতে কতোটা নিরূপায় তোমার দম, আবাদ,আশ্রয়।
ক্ষেপনাস্ত্রের শতভাগ সফল উৎক্ষেপন
তবুও ঝুঁকিতে তোমার যাপিত জীবন।
কতোটা নিষ্ফল তোমার মোতায়েনকৃত
দূর-পাল্লার নিউক্লিয়ার ওয়েপন!
দৃশ্যমান মারণাস্ত্রের অতন্ত্র প্রহরি
অদৃশ্যমান মারণাস্ত্রের হাই-হ্যালোতেই তোমার অস্তিত্ব কুপোকাত।
বিশ্বকর্মা গড়বে আর কোন নি:শ্ছিদ্র লোহার গারদ
তোমার দমের সুরক্ষায়,
আর কোন ব্রহ্মাস্ত্র কাঁধে নেবে তোমার আত্মরক্ষার দায়?
-
২৫৯.
সময়ের সিঁড়ি এতো পিচ্ছিল,পাও টেকানোই বড়ো দায়,
সিঁড়ি ভাঙা কাজে যারা দক্ষ তাদেরওতো পাও ফসকায়।
২৬০.
সভ্যতা বলো কাকে?
যে ভব্যতা যুদ্ধ উস্কে দিয়ে
রেড ক্রসের সেবার আড়ালে মুখটা লুকিয়ে রাখে-
সভ্যতা বলো তাকে?
নিরস্ত্র নর, অবলা নারী ,
অবোধ শিশুর প্রাণ নিধনে মেতে
‘সেল্ফ ডিফেন্স’-এর নীতি যে হাঁকে;
সভ্যতা বলো তাকে?
কালো বুটের পায়ে,
কালো মানুষের দম দাবিয়ে দানবের মতো যে মারে-
সভ্যতা বলো তারে?
এর নামই যদি হয় মানব সভ্যতা,
মানবের সব অর্জন শতভাগ বৃথা।
২৬১.
তাদেরই জন্যে তুমি সূর্য হতে চাও;
তোমার আলোকে যারা আমলই করে না?
বিশ্বজুড়ে এর চেয়ে বড়ো
নেই আর কোনো বিড়ম্বনা।
২৬২.
কানু যখন ধেনু চড়ায় বেণু বাজায় গোঠে,
অনুরাগের কাঁপন রাইয়ের অধর-চাপা ঠোঁটে।
বৃন্দাবনের বাঁশি যদি সুন্দরবনে বাজে,
সে সুর কি আর বাঘ-ভালুকের আসবে কোন কাজে!
তাই তো দেখি রসিকজনে মন বুঝে সুর তোলে,
মনের মানুষ কাছে পেলেই সুরের দুয়ার খোলে।
তনুর ভাঁজে ভাঁজে যদি বেণুর আগুন জ্বলে,
তনুর অণু অণু পোড়ে কামের রোষানলে।
সুর কেবলই মনের মণি, দেহের খোরাক নয়,
প্রেমের মাঝেই দেহাতীতের প্রণয়-পরিণয়।
শ্যাম তো কেবল লীলা বোঝে মন বোঝে না জানি,
তবু কেনো রাই হয়েছে শ্যামের বিনোদিনী?
যে তল্লাটে বাঁশই প্রিয় বাঁশিও সেথায় বাঁশ,
বাঁশের গদার ঘায়ে বেণুর সুরের সর্বনাশ।
শ্যামের বাঁশি নয় রে বাঁশি; লীলার মাদকতা,
সেই সুরেতে যতোই বাড়ুক রাধার ব্যকুলতা।
শ্যামের তাতে কী আসে যায় লীলাই যার সার,
কলঙ্কের এই অলংকারই রাইয়ের অহংকার।
সুরে যদি মন না মজে সেই আসুরিক সুর,
রসিকজনের কাছেও হবে রসের আস্তাকুঁড়।
মন বুঝে তাই সুর লহরীর আমেজ ছড়াও প্রাণে,
পাথুরে মন সুর বোঝে না; দেহের জোরে টানে।
২৬৩.
যদি হও সত্যের সন্ধানি-
মন থেকে মুছে ফেলো ভয়,
মুছে ফেলো হৃদয়ের গ্লানি।
২৬৪.
এক এক করে যদি জীবনের সূচনা থেকে সব অধ্যায়
হয়ে আসে শেষ,
উপসংহারে এসে খোশ-খেয়ালের বশে
নতুন ভূমিকার আর ঘটাবে না কোনো উন্মেষ।
সময়ের সাইরেনে যে কর্মের শুভ সূত্রপাত,
সময়ের সিঙ্গায় কর্তা ও কর্মের নিয়তির নির্দিষ্ট নিপাত।
-
২৬৫.
আমরা নগন্য প্রেমিক; নগন্য চাওয়া,
মন পেলে সে পাওয়াই বড়ো ধন পাওয়া।
দুজনের সাফ সাফ হলো এই কথা,
কোনো দিনও করবো না এর অন্যথা:
আমি তোরে মন দিবো; তুই আমারে দিবি,
আমরা চাই না এই সারাটা পৃথিবী।
মন দেয়া নেয়ার এই পবিত্র পাকে,
আমাদের প্রেম যেনো প্রাণে বাঁধা থাকে।
-
২৬৬.
ফুলের কাঁটায় এত্তো যদি ভয়,
কাঁটাবিহীন ফুল নিলেইতো হয়।
নাকি তোমার প্রেমের জন্য
লাল গোলাপই লাগবে,
তাহলেতো বোঁটায় বোঁটায়
কিছু কাঁটা জাগবেই।
২৬৭.
পূব দিক থেকে উঠে প্রতিদিন নতুন দিনের মহানায়ক,
তবুও পূবের কাটেনা দীনতা; তা বড়ো বেদনাদায়ক।
অস্তাচলের করুণার শ্বাসে পূর্বাচলের জীবন-প্রাণ,
হায়রে নিয়তি উদয়াচলের কী যে নিদারুণ অসম্মান!
২৬৮.
না ফেরার দেশে চলে যেতে হবে; সে আতংক বা আক্ষেপে,
জীবন চালানো যায় না কখনো ইঞ্চি ফুট বা গজ মেপে।
এমন এখনো অনেকেই আছে নেয়নি যারা চির বিদায়,
হয়তো আবার মিলবে না দেখা চলার পথের আলো-ছায়ায়।
ছোট ছোট সব বিদায়েরা যেন শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি,
না ফেরার দেশের অভিযাত্রায় স্বাগত জানাবে বিস্মৃতি।
২৬৯.
আমরা যখন পায়ে পা কাঁধে কাঁধ কন্ঠে কন্ঠ হৃদয়ে হৃদয় রেখে
উত্তাল রাজপথে তুলবো মুষ্টিবদ্ধ প্রতিরোধি হাত,
তখনি করাত গুঁড়োর মাঝে মুখ থুবড়ে পড়বে
নির্বিচারে জীবন নিধনকারী স্বেচ্ছাচারী শাঁখের করাত।
-
২৭০.
তোমাকে যতোই আড়াল করুক মন খারাপের কুয়াশা,
আমার অনুরাগ-রোদ্দুরে জেনো কেটে যাবে ঘোর ধোঁয়াশা।
ভালোবাসা তার উষ্ণতা দিয়ে তোমাকে আবারো ভরাবে,
তোমার প্রেমের নির্ঝর ধারা অশ্রু প্রবাহে গড়াবে।
২৭১.
দু:খের কথা শোনার যদি
মানুষ পাওয়া যেতো,
বলার কাজে সব প্রেমিকই
সোনার মেডেল পেতো।
২৭২.
শুকনো গাঙে নৌকা বাওয়ার দুর্দিন এলো,
আমায় ফেলে মাল্লা মাঝি সব পালালো ।
চতুর্দিকে সর্বনাশা ঝড় তুফান,
আমার জীবন-নদে বিষম ভাটার টান।
বিরান মাঠে আমি একা সঙ্গিহীন,
কালের স্রোতে বিলীন হবার গুনছি দিন।
২৭৩.
খাতা কলম নিয়ে বসে, গন্ডা কড়ায় অংক কষে,
পাওনা দেনার কলম ঘষে, হিসাব কষে লাভ ক্ষতি,
একতরফা প্রেম নিবেদন, করবে তুমি মনের মতন;
প্রেম মুলুকে সে প্রেম যদি চাও;
লাভের লোভের হিসাব নিকাশ ছেড়ে,
প্রেমের অনুরাগে প্রিয়ের মনটাকে নাও কেড়ে।
মনের গোপন আদালতে এমন কষ্ট থাকে জমা,
যে কষ্টটার সব অপরাধ হাকিম সেজে করছি ক্ষমা।
২৭৩
যেই জনপদে মত প্রকাশের থাকে পূর্ণ স্বাধীনতা,
সৃজনশীলতার উন্মেষে ঘটে মানসিকতার প্রসারতা।
বর্ণ গোত্র দেশ ধর্মের সব ভেদাভেদ যায় ঘুচে,
সভ্যতা দেয় শুচির পরশে প্রভেদের সব রেশ মুছে।
এই আদর্শ শতভাগ মানে বিশ্বে এমন দেশ তো নাই,
খোদ মার্কিন মুলুকেই দেখুন বর্ণভেদের শেষ তো নাই।
২৭৪
আর যদি কোনদিন কোনখানে
দেখা না-ই হয় দুজনের,
জানবো তুমি আছো সেখানেই
যেখানে সুখ আছে বাঁধনের।
-