আইন কঠোর, তবুও থেমে নেই টাকা পাচার

ঢাকাটাইমস ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ২৭ নভেম্বর ২০২০, ২২:৩৪
ফাইল ছবি

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচারের বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য পেয়েছে সরকার। তার এই বক্তব্যের পর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে। বৈধ পথে বিদেশে টাকা পাঠানো অনেক কঠিন হলেও অবৈধ পথে থামানো যাচ্ছে না টাকা পাচার।

প্রতিবছর কত টাকা বিদেশে পাচার হয় সেসংক্রান্ত তথ্য কোথাও নেই। তবে চলতি বছরের শুরুর দিকে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বিদেশে পাচার হয়েছে।

পাচারের তথ্য কতটা পাওয়া যায়?

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট এক সময় যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। দলীয় পদ হারিয়ে এবং বেশ কয়েকটি মামলায় গত এক বছর যাবত তিনি কারাগারে। এর মধ্যে একটি মামলা হচ্ছে , বিদেশে টাকা পাচারের। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির দায়ের করা সে মামলায় বলা হয়েছে যুবলীগের সাবেক এই নেতা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন।

তিনি ছাড়াও বাংলাদেশে বর্তমানে ডজন-খানেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা চলছে, যেখানে দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পৃক্ত আছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম বলছিলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তিনি বলেন, ‘মিউচুয়াল লিগাল অ্যাসিসট্যান্স-এর মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে সহায়তা চাইতে পারি। আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অন্য আরেকটি দেশের কাছে এ সংক্রান্ত সহায়তা চাওয়া হয়। তখন সংশ্লিষ্ট দেশ আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তথ্য দেয়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে সে তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে আসে। তারপর সেই তথ্য আমরা আদালতে দাখিল করি।’

বাণিজ্য কারসাজি

অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের যেসব ঘটনা আদালতে আসছে সেগুলো সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। অর্থাৎ বেশিরভাগ ঘটনা কেউ জানেই না। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার কয়েকভাবে হয়ে থাকে। এর একটি বড় উপায় হচ্ছে বাণিজ্য কারসাজি। আরেকটি উপায় হচ্ছে হুন্ডি।

বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোনো পণ্য আমদানি করা হয়,তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়, ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে থেকে যায়। একইভাবে রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশি দামের পণ্যকে কম দাম দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ দেশে আনা হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, এগুলো ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং হিসেবে পরিচিত।

‘টাকা পাচারের পুরো বিষয়টা যেহেতু অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে সেজন্য এর সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া মুশকিল। খুব প্রচলিত হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। আমদানির ক্ষেত্রে যেটা করা হয়, কোনো একটি পণ্যের দাম যত হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে টাকা পাচার করে দেয়া হয়’ বলেন অধ্যাপক বিদিশা।

অর্থ পাচারের বিষয়গুলোর ওপর নজরদারির জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি ইউনিট গঠন করেছে অনেক আগেই। এর নাম ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। এই ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী বিদেশে টাকা পাঠানো এতো সহজ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রীতিমতো অসম্ভব।

ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান বলেন: ‘বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণের সময় একজন ব্যক্তি প্রতিবছর ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া এডুকেশন এবং ট্রিটমেন্টের জন্য শর্তসাপেক্ষে অর্থ নেয়া যায়। তবে বিদেশে সম্পদ কেনার জন্য অর্থ নেয়া নিষিদ্ধ।’

অর্থ পাচার থেমে নেই

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের আইন যতই কঠোর হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে অর্থ পাচার থেমে নেই। পাচারকারীরা নিত্যনতুন কৌশলও খুঁজে বের করছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, পাচার করা টাকা দিয়ে বিদেশ হয়তো বাড়ি ও সম্পদ ক্রয় করা হচ্ছে নতুবা ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

কানাডায় রিয়েল এস্টেট আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করছেন বাংলাদেশি চয়নিকা দত্ত। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কানাডায় যেকোনো ব্যক্তি বাড়ি কিনতে পারেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কানাডার নাগরিক না হলেও কোনো সমস্যা নেই।

তিনি বলেন, যারা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন না তাদের বাড়ির ক্রয়মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত ট্যাক্স দিতে হয়। যারা পুরোপুরি নগদ টাকা দিয়ে বাড়ি কিনেন তাদের অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না বলে উল্লেখ করেন মিস দত্ত।

কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের ভেতরে দুর্নীতির মাধ্যমে যে অর্থ উপার্জন করা হয় সেটি মূলত হুন্ডির মাধ্যমেই পাচার হয়। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী যে রপ্তানি করেন সেখান থেকে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশের ব্যাংকে রাখছেন। সে টাকা বাংলাদেশে আসছে না।

বাংলাদেশে গত তিন দশকের বেশি সময় যাবত ব্যাংকে কাজ করেছেন নূরুল আমিন। বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি। তিনি বলছেন, একটি দেশ থেকে টাকা তখনই পাচার হয় যখন সেখানে ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়ে মানুষের আস্থা কম থাকে।

‘এখানে বিষয়টি হলো আস্থার। ঠিক আছে, আমি যেকোনোভাবে টাকা কামাই করলাম, এখন এটাকে সেইফ রাখতে হবে। এটা হচ্ছে একটা বিষয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এখানে ইনভেস্টমেন্টের সুযোগ নেই। বাইরে পাঠিয়ে দিলে নিরাপদ। সর্বসাকুল্যে বুঝতে হবে এখানকার সিস্টেমের ওপর তার কোনো আস্থা নাই,’ বলছেন আমিন।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বছরের মাঝামাঝি যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে সেখানে ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা।

সেসব ব্যাংকে কারা টাকা রেখেছেন সে সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই। শুধু সুইজারল্যান্ডেই নয় - সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়েছে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।

বিদেশে অর্থ পাচার হলে দেশের অর্থনীতির ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘দেশের বাইরে যখন টাকা পাচার হয় তখন কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং দেশের মুদ্রা অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। যে টাকাটা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটা দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। যদি দেশে বিনিয়োগ হতো তাহলে কর্মসংস্থান বাড়তো। ’

ব্যাংক কর্মকর্তা এবং আইনজীবীরা বলছেন, টাকা পাচার হয়ে গেলে সেটি আবার দেশের ভেতরে ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন কাজ। সে নজিরও খুব একটা নেই। ২০১২ সালে সিঙ্গাপুর থেকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের ২১ কোটি টাকা ফেরত আনা হয়েছিল।

অনেক সময় পাচার করা অর্থের তথ্য পাওয়াও কঠিন হয়ে যায়।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে কোন্ বাংলাদেশির টাকা আছে সে সংক্রান্ত তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা করেও এক বছরেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। -বিবিসি বাংলা

(ঢাকাটাইমস/২৭নভেম্বর/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

অর্থনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অর্থনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :