অণুকাব্য: পঞ্চপর্ণ: উদ্ধৃতি (পর্ব বারো)
২৭৫.
কেনো এই আসা যাওয়া, কেনো এই খেয়া বাওয়া
ঘাটে ঘাটে কেনো এতো দায়!
কেনো এতো লুকোচুরি; হিসাবের কানা কড়ি
বুঝবার না আছে উপায়।
শুধু জানি; আসি যাই, কোনো খানে নাই ঠাঁই
অকারণ সব মানে খোঁজা,
মহাজনি কারবারে প্রজাদেরই ঘাড়ে ঘাড়ে
খাজনার পড়ে ভারি বোঁঝা।
২৭৬.
কাগজের ফুলে বসে, মৌমাছি হেসে হেসে
যখন তার হুল চটকায়,
আমি পড়ি ভারি খটকায়।
২৭৭.
জীবন গোলাপের বিছানা নয়,কাঁটার ঝোপঝাড়ও নয়;
জীবন হ'ল:
আন্দাজ-অনুমানের এমন তোড়া
যেটাকে সজ্জিত করেছে আশা ও হতাশার খেয়ালিপনা।
২৭৮.
যদি হতে পারো নন্দদুলালের নান্দীকার,
নন্দকাননে হতে পারে তোমার নান্দনিক বিহার।
২৭৯.
ভাবে ভাবে পাখিদের কতো গলাগলি,
মানুষের ভাবে আছে হয় দলাদলি;
নইলে নিত্য আছে কান মলামলি,
অথবা গোপনে আছে ঘুঁটি চালাচালি,
মুখ কালাকালি কিবা নানা গালাগালি।
ওদের আছে কতো ভাব প্রাণের প্রীতিতে,
মানুষের সব ভাব গেছে তলানিতে।
২৮০.
তালে তালে গান গাওয়টা আনাড়িরও থাকে জানা,
তালের আড়ে গাইলে তবেই ফুটবে তোমার মুন্সিয়ানা।
কন্ঠস্বরে সুর থাকেনা, সুরের নিবাস অন্যখানে,
সুর সাধনার রথে চড়েই পৌঁছুতে হয় সুরবিতানে।
২৮১.
জীবনের যদি অর্থ না খুঁজে পাও,
অর্থকে বলো, জীবনকে খুঁজে নাও।
২৮২.
যতো মতবাদ সব পাতা ফাঁদ
মানুষ শিকার করবে বলে,
ডান ও বামের টানা হেঁছড়াতে
আমার মাথা করাতকলে।
২৮৩.
জীবন নিয়ে খেলছে যারা জুয়া,
মাঝে মাঝে তাদের কাছে জীবন ‘কাকতাড়ু্য়া ‘
২৮৪.
জীবনকে যদি জীবনের সাথে যুক্ত করা না যায়,
জীবন তখন দুর্বহ হয় দু:সহ যাতনায়।
২৮৫.
হাতে যদি টাকা হয়, বুদ্ধিতে পাকা হয়,
অনেকেই কাছে এসে মামু-খালু-কাকা হয়।
হাতে যদি টাকা হয়, উড়বার পাখা হয়;
কুকাজের ইতিহাস টাকা দিয়ে ঢাকা হয়।
২৮৬.
বর্তমানকে ডেকে বলে অতীত মহাশয় ,
‘আমার উদর থেকেই-যে তোর জন্ম নিতে হয়;
আমায় যদি ভুলিস তবে
ভবিষ্যতও ধ্বংস হবে
বর্তমান আর অতীত মিলেই ভবিষ্যতের জয়’।
২৮৭.
বর্তমান আর অতীত নিয়ে তর্ক হলে নিত্য,
কেউ জেতেনা ; কেবল তাদের বিষাক্ত হয় চিত্ত।
বর্তমান আর অতীত যদি
বিবাদ বাঁধায় নিরবধি;
ভবিষ্যতই ধ্বংস হবে খুইয়ে বেসাত-বিত্ত।
২৮৮.
আমরা এখন নীতিবানের নাম দিয়েছি‘বোকা’,
অভিজ্ঞদের নাম দিয়েছি ‘নব্য যুগের খোকা’।
নগদ-নগদ নারায়ণে
সবাই খুশি সঙ্গোপনে
‘স্বার্থ নামের পাগলা ঘোড়ার যায়না গতি রোখা।
২৮৯.
সমাজ আছে আলট্রা মডার্ণ, সমাজ আছে জীর্ণ,
পথও আছে হাজার রকম, মতও আছে ভিন্ন ।
জীর্ণতাকে রুখতে হ’লে
পথ ও মতের যুক্তবলে;
রাখতে হবে প্রতিশ্রুত সার্থকতার চিহ্ন।
২৯০.
পুণ্যের এখন আকাল ভীষণ পাপের বাজার রমরমা,
পুণ্য থাকে ব্যয়ের খাতায় পাপই কেবল হয় জমা ।
বইবে চোখে অশ্রু-নদী
সীমার মাঝে না রও যদি
পাপ করা চাই তত্তোটুকু যত্তোটুকুর হয় ক্ষমা।
২৯১.
হাতুড়ে হাতুড়ি ভাঙে সে পাথরই
হাতুড়ির চেয়ে যে অক্ষম,
যে পাথরে নেই পাথুরে শক্তি
নেই সে পাথরে বাঁচার দম।
২৯২.
কথার ঝাঁপি যখনই খুলেছি
তখনই কথার গোখরো সাপ,
আমার ঠোঁটে ছোবল মেরে
বসিয়ে দিয়েছে বিষের দাঁত।
আমার কথারা দু’দলে ভাগ হয়ে
খুনোখুনি করে পরস্পর,
আমাকে দিয়েছে লাল দালানের
চোদ্দ শিকের গারদ-ঘর।
২৯৩.
সব কিন্তু ও যদি’র সীমানা যেখানে হয়েছে শেষ,
সেই সীমান্ত ধূসরে তোমার আত্মমগ্ন দেশ।
সে দেশে তোমার নেই ডেরা কোঠা,নেই কোনো ঘর বাড়ি,
অথচ সকল ঘরে ঘরে হয় তোমার সমন জারি।
২৯৪.
দেশটা জুড়ে কেবল ঘুরে আজব আঁধার,
সুখের পথে আকাশ ছোঁয়া প্রাচীর বাধার।
বিত্ত আশায় রক্ত নেশায় চিত্ত মাতে,
নিস্ফলতায় জ্বলছে চিতায় আত্মঘাতে।
দম্ভ দানব দ্বন্দদ্বিধার গহীন গুহায়,
প্রীতির প্রসূণ উন্মাদনায় দলছে দু’পায়।
পুঁথির বোঝা হচ্ছে গোঁজা গাধার পিঠে,
বিত্ত-বেসাত বিষের ব্যুহে শক্ত গিঁটে।
হিংসারোষের অগ্নিগিরির লোভের লাভা,
বাড়ায় বাহু ধ্বংস-রাহু; নগ্ন থাবা।
বিভেদ-বিবাদ নিন্দা-নিনাদ নিত্য হানে,
খিলের তালা বিবেক বোধের বধির কানে।
স্বার্থশূলে মূল্যবোধের মুন্ডু পাতা,
ক্ষিপ্ত খলের খড়্গ ঘায়ে খন্ড মাথা।
-
২৯৫.
যার পরশে যার আশিসে স্বর্গ-সুধা মাখা,
তার তুলনা তার উপমা শব্দে কি যায় আকাঁ!
আকাশ যেমন আকাশ জুড়ে আঁচল পাতে নীল,
নরোম রোদের স্রোতে যেমন ডানা মেলে চিল।
সাগর যেমন সুনীল জলের বিশাল চাদর পাতে,
পূর্ণিমা চাঁদ জ্যোৎস্না আদর ঝরায় যেমন রাতে।
কোকিল যেমন কুহুর আবেশ ছড়ায় বনে বনে,
ফাগুন যেমন আগুন ঝরায় রঙের আলিঙ্গনে।
মনে যেমন পুলক জাগে সোহাগ দিলে কেউ,
সর্ষে ক্ষেতে হলদে রঙের যেমন খেলে ঢেউ।
রাঙা মাটির মাঠটা যেমন সবুজ ঘাসে ঢাকে,
মেঘের লুকোচুরি যেমন তারার ফাঁকে ফাঁকে।
ফোকলা দাঁতে হাসলে শিশু যেমন লাগে সুখ,
সকল ভালো লাগার সেরা মায়ের সোনা মুখ।
আমার কাছে প্রিয় মায়ের স্নেহের আঁচল খানি,
যার মমতার আঁচল মোছে আমার চোখের পানি