সোনার বাংলায় উগ্র-জঙ্গি-জংলিদের ঠাঁই নাই

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০৯:০৪

মফিজুর রহমান পলাশ

ভাবতে পারেন মাত্র ৮১৫ বছর আগে বাংলাদেশে মুসলিম ধর্মের একজন সদস্যও ছিলেন না! মাত্র আট শতাব্দী আগেও এই ভূখণ্ডে ছিল না মুসলিম ধর্মের নামনিশানা! কি অবাক হলেন?

১২০৪ সালের আগে আমাদের দেশে মুসলমান বা মুসলিম ধর্মের অস্তিত্বই ছিল না! মানে একজন মুসলমানও ছিলেন না বাংলাদেশে।

তুরস্কের মুসলিম যোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি ১২০৪ সালে বাংলার রাজা লক্ষন সেনকে পরাজিত করে নদীয়া জয় করেন। এই নদীয়া বর্তমানের যশোর-কুষ্টিয়া জেলা ও সীমান্তের ওপারে পশ্চিম বাংলার কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল।

পঁচাত্তর বছরকে এক প্রজন্ম ধরলে আমার, আপনার দশ প্রজন্ম আগের পুরুষটি মুসলিম ছিলেন না। তিনি হয়তো হিন্দু ছিলেন। বা অন্য ধর্মের। কেউ কেউ উচ্চবর্ণের হিন্দু ছিলেন। আমরা অনেকেই নিম্নবর্ণের অস্পৃশ্য নমশূদ্র পরিবারের ‘গর্বিত উত্তরাধিকার’।

তবে এর বাইরে অতিথি পাখির মতো আমাদের পূর্বপূরুষদের কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাক, ইরান, আফগান, তুরস্ক, মধ্যে এশিয়ার দেশ কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ভাগ্যান্বেষণে বাংলায় পাড়ি জমিয়েছিলেন বটে। তবে এদের সংখ্যা নিতান্তই অল্প এবং এরা ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে আসেননি। তার অর্থ হলো রাজনৈতিকভাবে এর আগে এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

তাহলে তখন কারা ছিলেন এই বাংলায়?

আমরা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাম শুনেছি। আমরা যে চানক্যনীতির কথা শুনি এই চানক্য মশায় ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অর্থমন্ত্রী। আমাদের সোনার বাংলা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মৌর্য্য, গুপ্ত, পাল, সেন বংশের শাসকদের হাতে শাসিত হয়েছে। মুসলিম সুলতানেরা শাসন করেছেন বাংলা। একসময় মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলো, সুবেদারদের হাতে এলো বাংলার শাসন। নবাবেরা এলেন, গেলেন। নানান সময়ে নানান জনপদে বিভক্ত ছিল বাংলা।

ঐশ্বর্য ছিল বাংলায়। সুখ ছিল, আবার সুখ ছিল না। রাজার অত্যাচার ছিল,আবার জনদরদী শাসকও ছিলেন এই বাংলায়। এই বাংলা যুগে যুগে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলিম শাসকের হাতে লালিত, পালিত, শাসিত এবং শোষিত হয়েছে। ভিনদেশি শত্রু বারবার আক্রমণ করে তছনছ করে দিয়েছে সোনার বাংলাকে। হায়েনারা লুটেপুটে খেয়েছে আমাদের বাংলা মায়ের ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার। একদা মারাঠা বাহিনী তথা বর্গীর পৌণঃপুনিক আক্রমণে পর্যদুস্ত ছিল বাংলা। এই বাংলায় ধর্মপ্রচার করতে এসেছেন হযরত শাহজালাল, শাহপরান ও খানজাহান আলীর মতো মুসলিম মনীষীরা। পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ-কেউ তো ভালবেসে এদেশে আসেনি, এসেছিল স্বার্থের জন্য।

এরপর এক সময় ইতিহাসের দ্বিচক্র ঘুরতে ঘুরতে এলো একাত্তর। ১৯৭১ সাল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মহুতির বিনিময়ে আমরা একটা স্বাধীন, সার্বভৌম, মুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি। পরাজিত করেছি পাকিস্তানি নরকীটদের। এরপর আমরা নিজস্ব আইন পেয়েছি, সংসদ পেয়েছি। এখন আর ইংরেজ শাসন নেই। এখন আর সুলতানি শাসন নেই। নেই বর্গীদের রমরমা আক্রমণ বাণিজ্য। এখন আর বখতিয়ার খিলজি নেই। এখন এটা স্বাধীন বাংলাদেশ-গর্বিত, ভয়ডরহীন, দুর্দমনীয়, অজেয়, দুর্বার বাংলাদেশ। হাজার বছরের শৃঙ্খল দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে আমরা একটা দেশ পেয়েছি। নতুন বাংলাদেশ।

ভুলে গেলে চলবেনা মাত্র ৮১৫ বছর আগেও এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ধর্মপ্রচারক ওলি-আউলিয়াদের মিষ্টি ব্যবহার, উদারতানৈতিক আচরণ, ভিন্নধর্মের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা, আন্তরিকতা ও তাঁদের  নির্লোভ, নিরহংকার এবং সাদামাটা জীবনধারায় আকৃষ্ট হয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছেন। ইসলামের এই উদারনৈতিক ও পরধর্মসহিষ্ণু বৈশিষ্ট্যের জন্য মাত্র ৮০০ বছরে বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগণ মুসলিম ধর্মের অনুসারী হয়েছেন। অথচ আমাদের দশ প্রজন্ম আগে ইসলাম ধর্মের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি এই বাংলায়। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় মানুষ ভালোবাসার বড়োই কাঙ্গাল। এদেশে ভয়ে কেউ ভীত হয়না। ভালোবেসে এখানে সবকিছু জয় করা যায়, চাপ দিয়ে এখানে কিছুই পাওয়া যায় না।

এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশ হলো ধর্মের উর্বরভূমি। পৃথিবীর সিংহভাগ ধর্মের প্রবর্তন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন সবই হয়েছে এই এশিয়ার দেশগুলোতে। তাদের সাথে তাল রেখে চলেছে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি। এদেশে ধর্ম আগে আসেনি, আগে মানুষ এসেছে। এখানকার মানুষ ধর্মান্ধ নন, ধর্মকে আমরা ভালোবাসি, হৃদয়ে লালন করি। এদেশে যার যার ধর্ম সে সে পালন করবেন। কারও ধর্মকর্মে কেউ বাধা দিতে পারবেন না।

বাংলার হিন্দু-বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্ম থেকে মানুষেরা কেনো দলে দলে ইসলামের কাফেলায় যোগ দিয়েছিলেন সেটা ভুলে গেলে কিন্তু বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। ওলি-আউলিয়াদের মতো সেই উদারতা, সেই মহত্ত্ব, সেই নির্লোভ, নিরহংকার ব্যক্তিত্ব ছাড়া বাংলায় ধর্মের বিকাশ সম্ভব নয়। একমাত্র মুসলমান রেখে বাকিদের কচুকাটা করলে এদেশে ধর্মের ভিত্তি মজবুত হবে না। নানা শ্রেণি, মত ও পথের মানুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও মমত্বের নিরিখে সহাবস্থানই ধর্মের চরম উৎকর্ষ সাধন করবে, হিংসা বিদ্বেষ বা উগ্রবাদী মতবাদ কোনোদিন শান্তি স্থাপন করবে না।

উগ্র-জঙ্গি-জংলির ঠাঁই সোনার বাংলায় কোনদিন হয়নি আর ভবিষ্যতেও হবে না। আধুনিক যুগে সব ধরনের ধর্মীয় গোড়ামি ও ভণ্ডামি ত্যাগ করে ধর্মের আসল উদ্দেশ্য ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ সেটাই নিশ্চিত হোক। শহরের মোড়ে একটা ভাস্কর্য থাকলে ইসলাম শেষ হয়ে যাবে না, বরং নিজের মন-মানসিকতাকে পরিশুদ্ধ করে, সৎ-সরল জীবন যাপনের মাধ্যমে ও মানুষকে ভালোবেসে আল্লাহর করুণা লাভ করা সম্ভব।

ত্রিশ লাখ শহীদের বাংলায়, বঙ্গবন্ধুর রক্তভেজা মাটিতে, হযরত শাহ জালাল, শাহ পরান, খানজাহান আলী, তিতুমীর আর হাজী শরিয়তউল্লাহর বাংলাকে ধর্মীয় উগ্রবাদের চারণভূমি হতে দেওয়া হবে না। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ আর কাজী নজরুলের বাংলায় উগ্রবাদ নিপাত যাবেই।

লেখক: সিনিয়র এএসপি, রংপুর আরআরএফ