ড. নেয়ামত উল্যা ভুঁইয়া’র মরমী গানের বাণী

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০২০, ১১:৫৭ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২০, ১২:০০

ড. নেয়ামত উল্যা ভুঁইয়া

•গীতিকা-১ : আজব কারিগর

 

আজব কারিগর গো সে-যে আজব কারিগর,

হাওয়া-দমের ঘর বানাইছে দুই খুঁটিতে ভর;

সে-যে  হাওয়া খেলার ঘর বানাইছেশদুই খুঁটির উপর;

সে-যে আজব কারিগর।।

মাটির উপর খুঁটির গোড়া; তাতেই ঘরের নড়া-চড়া,

ঘর যেনো এক মাটির ঘড়া; মাটির কলেবর গো,

সে-যে আজব কারিগর;

হাওয়া-দমের ঘর বানাইছে দুই খুঁটিতে ভর।।

ঘরের যতো খিড়কি-দুয়ার; খোলা-বন্ধ,তার এখতিয়ার;

খোঁপে-খোঁপে তার ইশারার লীলা নিরন্তর গো,

সে-যে আজব কারিগর;

হাওয়া-দমের ঘর বানাইছে দুই খুঁটিতে ভর।।

ঘরের ভিতর আগুন-পানি

করছে খেলা; নাই জিরানই,

হাওয়া যখন দেয় না হাওয়া লুটায় খেলাঘর গো;

সে-যে আজব কারিগর;

হাওয়া-দমের ঘর বানাইছে দুই খুঁটিতে ভর।।

-

 

•গীতিকা-২ :লোকান্তের পারাপার

 

যাইতেই যদি হইব রে দয়াল আসতে কেন দিলা?

আসা-যাওয়ার পথে আমার সময় ফুরাইলা;

আমার দিন যে ফুরাইলা, আমার দম যে ফুরাইলা।।

যতোই উড়ি ঘোরের কোঠায়, তোমার নাটাই সূতা গুটায়,

ঘুড়ি আমার ধূলায় লুটায়, সাঙ্গ যে হয় খেলা;

আসা-যাওয়ার পথে আমার সময় ফুরাইলা-

আমার দিন যে ফুরাইলা; আমার দম যে ফুরাইলা।।

তোমার সাথে মিলন ছিল,মাঝে নিমিষ ছেদ পড়িল;

ক্ষণিকের বিরহ হইল তিন ভুবনের জ্বালা;

আসা-যাওয়ার পথে আমার সময় ফুরাইলা-

আমর দিন যে ফুরাইলা; আমার দম যে ফুরাইলা।।

-

 

•গীতিকা-৩: নিরাকারের চাল

 

আমি জাল ফেলেছি জাল, সাগর-জোড়া জাল,

কেমন করে জাল গুটাবো;ভাংলো নায়ের হাল!

আমি জাল ফেলেছি জাল।।

ধরব কী মাছ কাতলা-বোয়াল, ঘাড়ের উপর ঝড়ের জোয়াল,

ভাংলো বৈঠা ছিঁড়লো যে পাল; নাও যে বেসামাল-

আমি  জাল ফেলেছি জাল।।

মাছে-মাছে ভরব ঘড়া, জাল ফেলেছি লম্বা-চড়া।

ভাটার দিকে কার ইশারা; পালায় মাছের পাল-

আমি  জাল ফেলেছি জাল।।

কষ্ট করে অষ্ট প্রহর,ঝরাই যতো ঘামের নহর।

জাল গুটাতে বিশাল বহর; কাটলো জীবনকাল-

আমি  জাল ফেলেছি জাল।।

এমন বপু জালের আকার, সাধ্য যে নাই জাল গুটাবার।

জলের মাঝেই জাল বেকারার; নিরাকারের চাল-

আমি  জাল ফেলেছি জাল।।

-

 

•গীতিকা-৪: বুকের খাঁচায় দমের মাচায়

 

বুকের খাঁচায়, দমের মাচায়, পুচ্ছ নাচায়, পুঁচকে পাখি,

সে পাখি পোষ মানে না, ঘর  খোঁজে না, মন বোঝে না,

সোহাগি ডাক যতোই ডাকি-

বুকের খাঁচায়  দমের মাচায় পুচ্ছ নাচায় পুঁচকে পাখি।।

সে পাখির উড়াউড়ি ঘুরাঘুরি হাওয়া হাওয়া,

ওপার হতে এপারে তে আসা-যাওয়া।

সময়-ঘড়ির কাঁটার সাথে সেই পাখিটার মাখামাখি-

বুকের খাঁচায়, দমের মাচায়, পুচ্ছ নাচায়, পুঁচকে পাখি।।

সে-পাখি যখন লুকায় হিসাব চুকায় গন্ডা-কড়ায়,

কায়ার মায়া ছাড়ে খাঁচার ক্ষয়ের জরায়।

লেনা দেনা রয়না বাকী,

দেয়না কানাকড়ি ফাঁকি-

বুকের খাঁচায়, দমের মাচায়, পুচ্ছ নাচায়, পুঁচকে পাখি।।

সে পাখি ঘর খোঁজে না, পোষ মানে না, মন বোঝে না,

সোহাগি ডাক যতোই ডাকি-

বুকের খাঁচায়, দমের মাচায়, পুচ্ছ নাচায়, পুঁচকে পাখি।।

 

 

•গীতিকা-৫: উতল সায়রে দেহডিঙ্গি

 

আমার দেহ ডিঙ্গি ভাসাই দিলাম উতল সায়রে,

তল খুঁজিয়া পায় না লগি জলের বহরে।।

অঙ্গারের গনগনে আগুন ঢেউয়ের দোলায় জ্বলে,

সেই জ্বলা নিভেনা মড়ার শরীর গলা জলে।

মরমের পক্ষীরে খাইলো কামের হাঙ্গরে -

আমার দেহ ডিঙ্গি ভাসাই দিলাম উতল সায়রে,

তল খুঁজিয়া পায় না লগি জলের বহরে।।

মগজের-ময়দানে লহুর জোয়ারের তুফানে,

টলোমলো ডিঙ্গি আমার এক-লহমার বাণে।

বিরাম নাই তার ভবের ঘাটের খেয়া পারাপারে-

আমার দেহ ডিঙ্গি ভাসাই দিলাম উতল সায়রে,

তল খুঁজিয়া পায় না লগি জলের বহরে।।

-

 

গীতিকা-৬: মাথার উপর সাত আসমানের ভর

 

আমার মাথার উপর সাত আসমানের ভর,

আমার অন্তরে বয় কাল বৈশাখি ঝড়

আমার কি আর সাধ্য আছে বাঁধবো নিজের ঘর!!

বাতাসে খাই হাবুডুবু, শ্বাস নিতে হয় কষ্ট তবু

শকুনেরা খামছে ধরে, জালালি কইতর-

আমার মাথার উপর সাত আসমানের ভর॥

পূর্বে জ্বলে সূর্য প্রখর, দক্ষিণে বয় অথৈ সাগর

উত্তরে হিমালয় গড়ে বাধা নিরন্তর-

আমার মাথার উপর সাত আসমানের ভর॥

চারিধারে লোহার খাঁচা, খাঁচার মাঝেই মরা বাঁচা

রঙ বে-রঙের পুতুল নাচা;আজব খেলাঘর-

আমার মাথার উপর সাত আসমানের ভর॥

-

গীতিকা-৭: করুণার খেয়া

 

আমায় কেবল দোষী করো, তোমার দোষ কি ছিল কম?

নাকি দোষের ভাগি সে-ই হয়, তোমার চেয়ে যে অধম!

ছিলাম দু’জন নন্দবনে,বললে আমায়, ‘যাও ভুবনে’।

তোমার আদেশ কে-না মানে; শক্তি তোমার নিরূপম-

আমায় কেবল দোষী করো, তোমার দোষ কি ছিল কম?

জানতে তুমি কর্মদোষে,পড়বো তোমার ঘৃণার রোষে।

ফিরলে অপরাধির বেশে, বলবে জানি ‘স্বাগতম’-

আমায় কেবল দোষী করো, তোমার দোষ কি ছিল কম?

নিজে থেকে নিরজনে, দেখ তুমি জনে জনে ।

তোমার অরূপ দরশনে, কার যে কখন ফুরায় দম-

আমায় কেবল দোষী করো, তোমার দোষ কি ছিল কম?

আমার এই-যে আসা-যাওয়া;তোমার প্রেমের খেয়া বাওয়া।

এরই মাঝে তোমায় পাওয়া, নিমিত্ত দূত মহাযম-

আমায় কেবল দোষী করো, তোমার দোষ কি ছিল কম?

খোশের সাথে দোষ মিশিয়ে, মন যতই দাও বিষিয়ে।

প্রীতির স্রোতে দোষ ভাসিয়ে বুক জড়াবে প্রিয়তম-

আমায় কেবল দোষী কর তোমার দোষ কি ছিল কম?