অসাম্প্রদায়িক চেতনার মহাবিশ্বে রবীন্দ্রনাথ

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, পিপিএম
 | প্রকাশিত : ৩০ নভেম্বর ২০২০, ১৮:২২

“হে দেব, হে পিতা, তুমি বিশ্বপাপ মার্জনা করো মানুষ মরছে তাকে বাঁচাও। কে বাঁচাবে পিতা নোহসি। তুমি যে আমাদের সকলের পিতা, তুমি বাঁচাও। তোমার বোধের দ্বারা বাঁচাও। তোমাকে সকল মানুষ মিলে যেদিন নমস্কার করবো সেই দিন নমস্কার সত্য হবে। নইলে ভূলুণ্ঠিত হয়ে মৃত্যুর মধ্যে যে নমস্কার করতে হয় সেই মৃত্যু থেকে বাঁচাও। দেশ দেশান্তরে তোমার যত যত সন্তান আছে, হে পিতা, তুমি প্রেম ভক্তিতে কল্যাণে সকলকে একত্র কর তোমার চরণতলে। নমস্কার সর্বত্র ব্যাপ্ত হোক” (মা মা হিংসী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

রবীন্দ্রসাহিত্যর বিশাল অংশ জুড়েই ছিল বিশ্বের সকল মানুষের পরিচয় হবে তারা কেবলই মানুষ, তাহলেই কেবল মানবের জন্য শান্তির বিশ্ব হবে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বনেতারা পৃথিবীটাকে সর্বজনীন চিন্তাবৃত্তের বাইরে এনে স্বার্থ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক খণ্ডিত চিন্তার পরীক্ষামূলক ব্যবহার করার প্রতি বেশি পরিমাণ ঝুঁকে পড়ায় বিশ্বব্যাপীই এক অস্থিরতার অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হচ্ছে। যার স্থায়ী রূপ বিশ্বকে পুনরায় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি করতে পারে। কারণ হিসেবে যা কিছুই থাকুক না কেন, সেখানে ক্ষমতার পরিচালনায় কবিমনস্ক বা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের অনুপস্থিতি একটা কারণ হতে পারে।

ভারতবর্ষের নন্দিত বেশির ভাগ নেতাই যেমন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র, বঙ্গবন্ধু, গান্ধীজি, বাঘাযতীন- তাদের প্রত্যেকের চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রসাহিত্য অনেক বেশি সমাদৃত ছিল বলেই সাম্প্রদায়িক বৃত্তের বাইরে এসে এই মানুষগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার শুভ দিক নিয়ে গবেষণা করতেন নিবিড়ভাবে এবং তাঁদের চিন্তা-দর্শনে সেগুলো প্রতিফলিত করেছেন। সাহিত্যাঙ্গনে রবীন্দ্রনাথ সারা বিশ্বের কাছেই সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট কবিপ্রধান হিসেবে সমাদৃত। তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্ম, চিন্তা-চেতনা ও দর্শন দিয়ে জীবনোত্তর মহাকালকে জয় করে অমরত্ব লাভ করেছেন। এমনটা কজন অর্জন করতে পেরেছেন তা নিয়েও হয়তো শেষ অব্দি তর্ক-বিতর্কের সুযোগ থাকবে, সংখ্যা যে খুব বেশি সংখ্যক নেই, তা গবেষণা ছাড়াই বলা যায়।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত কী হতে পারে এমনটি উত্থাপিত হতেই সেদিন বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তা হলো “কেন, তোমরা কি রবি ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি’ পড় নাই?” বঙ্গবন্ধুর এতটা কঠিনতম রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যেও কতটা প্রাজ্ঞতার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন তার এই নির্বাচনী থেকে খুব সহজেই অনুমেয়। তাঁর দূরদর্শিতা এতটাই মার্গীয় ছিল, শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে সমান সমাদৃত এবং শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত বিশ্বকবি কবিগুরুর সংগীতিয় সুর দ্বারা প্রভাবিত।

এমন উচ্চতার কবি বলেই সাম্প্রদায়িক চিন্তার মতো অশুভ রূপ কবিগুরুর চেতনাকে ছুঁতে পারেনি কোনোভাবেই। তাই দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন ‘আপনি আজ আমাকে সেই দেবতার মন্ত্রে দীক্ষা দিন যিনি হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, ব্রাহ্ম সকলেরই। যার মন্দিরের দ্বার কোন জাতির কাছে, কোন ব্যক্তির কাছে কোন দিন অবরুদ্ধ হয় না, যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নয়, গোটা ভারতবর্ষের দেবতা’ (গোরা; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

বিশ্বসাহিত্যের এমন অবিনাশী বাণী অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে চিরকালই সহায়ক হয়ে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। যা হোক, সারা বিশ্বে যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভঙ্গের সম্ভাবনা দেখি, তখন রবীন্দ্রনাথের অবিনাশী বাণী সভ্য সমাজ গড়নে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। যখন কবি জসীম উদদীনের আলোচনা পড়ি, তিনি বলেছেন, “আমি তখন এমএ পড়তে কলিকাতা এমসিএ হোস্টেলে ছিলাম। সেই সময়ে আমি প্রায়ই কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম; আমাকে দেখলেই কবি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনি বলতেন ‘কেন যে মানুষ একের অপরাধের জন্য অপরকে মারে! ও দেশের মুসলমানেরা হিন্দুদের মারল, তাই এ দেশের হিন্দুরা মুসলমানদের মেরে তার প্রতিবাদ করবে, এই বর্বর মনোবৃত্তির হাত থেকে দেশ কিভাবে উদ্ধার পাবে বলতে পার? দেখ, কি সামান্য ব্যাপার নিয়ে কলহ হয়। গরু কোরবানী নিয়ে, মসজিদের সামনে বাজনা নিয়ে। একটা পশুকে রক্ষা করতে কত মানুষকে মানুষ হত্যা করছে।” (রবীন্দ্রস্মৃতি, জসীম উদদীন)।

আজ বিশ্বে প্রতিনিয়তই যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের খবর প্রকাশ পাচ্ছে, তখন মনে হয় এই সংকটময় মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বাণী আরও বেশি প্রাসঙ্গিক- 'আমি আজ মুক্ত, পরেশবাবু! আমি যে পতিত হব, ব্রাত্য হব, সে ভয় আর আমার নেই– আমাকে আর পদে পদে মাটির দিকে চেয়ে শুচিতা বাঁচিয়ে চলতে হবে না।... দেখুন পরেশবাবু, কাল রাত্রে আমি বিধাতার কাছে প্রার্থনা করেছিলুম যে আজ প্রাতঃকালে আমি যেন নূতন জীবন লাভ করি। এতদিন শিশুকাল থেকে আমাকে যে-কিছু মিথ্যা যে-কিছু অশুচিতা আবৃত করে ছিল আজ যেন তা নিঃশেষে ক্ষয় হয়ে গিয়ে আমি নবজন্ম লাভ করি। আমি ঠিক যে কল্পনার সামগ্রীটি প্রার্থনা করেছিলুম ঈশ্বর সে প্রার্থনায় কর্ণপাত করেন নি– তিনি তাঁর নিজের সত্য হঠাৎ একেবারে আমার হাতে এনে দিয়ে আমাকে চমকিয়ে দিয়েছেন। তিনি যে এমন করে আমার অশুচিতাকে একেবারে সমূলে ঘুচিয়ে দেবেন তা আমি স্বপ্নেও জানতুম না। আজ আমি এমন শুচি হয়ে উঠেছি যে চণ্ডালের ঘরেও আমার আর অপবিত্রতার ভয় রইল না। পরেশবাবু, আজ প্রাতঃকালে সম্পূর্ণ অনাবৃত চিত্তখানি নিয়ে একেবারে আমি ভারতবর্ষের কোলের উপরে ভূমিষ্ঠ হয়েছি– মাতৃক্রোড় যে কাকে বলে এতদিন পরে তা আমি পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি।’ (গোরা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

সারা বিশ্ব হোক আমাদের জন্য মাতৃক্রোড় এবং নির্দ্বিধায় আমরা যেন বলতে পারি ‘এ আশ্রম- এখানে কোন দল নেই, সম্প্রদায় নেই। মানবসরোবরে যেমন পদ্ম বিকশিত হয় তেমনি এই প্রান্তরের আকাশে এই আশ্রমটি জেগে উঠেছে; একে কোন সম্প্রদায়ের বলতে পারবে না।’ (মুক্তির দীক্ষা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সবখানে সব সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক মানবতা। সংকীর্ণতার গণ্ডি পেরিয়ে আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারি, যার প্রতিষ্ঠাভূমি হচ্ছে শুধু উদার মনুষ্যত্ব। উদার চিত্তে সব মানুষের জন্য আমরাও যেন বলতে পারি, "তোমরা কেউবা পূর্বাচলের যাত্রী সূর্যোদয়ের দিকেই তোমাদের মুখ, সেই দিকে যিনি তোমাদের অভ্যুদয়ের পথে আহ্বান করছেন তাকে তোমরা পূর্বমুখ করেই প্রণাম করো। আমরা পশ্চিম অস্তাচলের দিকে জোড়হাত করে উপাসনা করি, সেই দিক থেকে আমাদের আহ্বান আসছে, সেই আহ্বানও সুন্দর গুরুগম্ভীর এবং শান্তিময় আনন্দরসে পরিপূর্ণ" (বর্ষশেষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

হিন্দু, মুসলিম, ব্রাহ্ম, খ্রিষ্টান- এসব পরিচয়ের বাইরে আমাদের আরও একটি পরিচয় তা 'মানুষ' বিধায় আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের যুদ্ধের মাঝেই সান্ত্বনার বাণী খুঁজে নিতে হবে, বিচ্ছেদের মাঝেই মিলনের সুর, মন্দের মাঝেই মহাকল্যাণের বাণী খুঁজে নেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা একে অপরকে নিয়ে গলাগলি জড়াজড়ি ঠেলাঠেলি মারামারি যে কী অদ্ভুত এবং কী প্রচণ্ড তা দেখে বিস্মিত হই! কিন্তু আমরা ভুলে গেছি সব সত্য বাণী কেবলই মানুষের জন্য।

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :