পাবনার রুহুল বিলে বাউত উৎসব

নিজস্ব প্রতিবেদক, পাবনা
 | প্রকাশিত : ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ২১:৫৭

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাউত উৎসবের কথা আমাদের সকলের জানা। বর্ষার শেষে বিল অঞ্চলে পানি কমার পরে স্থানীয় সৌখিন মাছ শিকারিরা দিন করে বিলে নামেন মাছ ধরার জন্য। দিনের প্রথম প্রহরে সূর্য উঠার আগে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন তারা। বিল পারের কয়েক হাজার মানুষ যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে মাছ শিকারের জন্য বিলে নেমে পড়েন। পাবনা ভাঙ্গুড়া উপজেলার চলন বিলের শেষ অংশে রুহুল বিলে মঙ্গলবার ছিল বাউথ উৎসব।

এই বাউত উৎসবকে ঘিরে চলে নানা আয়োজন। ভোর থেকে মাছ শিকার শুরু করে চলে দুপুর পর্যন্ত। উন্মুক্ত বিলে যার যেমন খুশি তাই দিয়ে শিকার করে দেশি বিভিন্ন প্রকারের মাছ।

জেলার দক্ষিণ পাশে অবস্থিত তিনটি উপজেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলা। এই উপজেলার বেশ কিছু অংশ চলন বিলের মধ্যে পড়েছে। তাই প্রতি বছর এই উপজেলাগুলোতে পর্যায় ক্রমে বিলের বিভিন্ন অংশে বাউত উৎসবের আয়োজন করে থাকে স্থানীয়রা।

শীতের হিমেল হাওয়া আর কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে বছরের এই সময়ে বিশেষ করে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিকে আর পৌষ মাসের প্রথমে বিলে এই বাউত উৎসব হয়ে থাকে। বাউত উৎসবকে ঘিড়ে বিল পারের মানুষদের মধ্যে চলে নানা আয়োজন। বছরের এই সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা স্থানীয়রা এই উৎসবকে ঘিরে নাড়ির টানে বাড়িতে ছুটে আসেন। অগ্রহায়ণের নতুন ধানের পিঠা আর বাউতে ধরা দেশি মাছ এ যেনো উৎসবের মাখামাখি। বছরের এই সময়ে মেয়ে জামাই দাওয়াত করা হয় গ্রাম অঞ্চলগুলোতে। দেশি মাছ, খেজুরের রস আর পিঠা পায়েসের সুগন্ধে মুখোরিত হয়ে উঠে পুরো গ্রাম। বিলে মাছ ধরার জন্য সব চাইতে বেশি ব্যবহার হয় পলো। কেউ ব্যবহার করে ঠেলা আর নানা প্রকারের নানা ধরনের জাল।

এই মাছ ধরার জন্য বয়সের কোন বাধ নেই। ছোট বড় আবাল বৃদ্ধা সকলেই অংশগ্রহণ করে বাউত এর মাছ শিকারে। উৎসবের আনন্দে মেতে উঠে সকলে। এই বিলে দেশী বিভিন্ন প্রজাতের মাছ পাওয়া যায়। রুই, কাতল, বোয়াল, চিতল, সোল, গজারসহ আরো অনেক প্রকারের ছোট বড় মাছ। এই রুহুল বিলের দুই পাশে বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। প্রতিটি গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে বিলের এক পাশ থেকে মাছ ধরতে ধরতে অন্য পাশে গিয়ে উঠে। দিন শেষে ভাগ্য প্রসন্ন হলে চিৎকার দিয়ে উঠে বিশাল এক মাছ ধরার মধ্যদিয়ে।

এই উৎসবে স্থানীয়রা ছাড়াও জেলার বাইরে থেকে সৌখিন মাছ শিকারিরা মাছ ধরার জন্য অংশ নেয়। সিরাজগঞ্জ, উল্লাপাড়া, নাটোর, পাবনার সদর, আটঘরিয়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুরসহ বিল পারের কয়েক হাজার মানুষ মেতে উঠে মাছ ধরা উৎসবে। ভোর থেকে বিভিন্ন স্থান থেকে যানবহন যোগে আসে মাছ শিকারিরা।

উৎসবে আসা শখের মাছ শিকারি হাসান মাহামুদ বলেন, মাছ শিকার আমার শখের একটি অংশ। প্রতি বছর জেলার যে সকল প্রান্তে বিলে বাউত উৎসব হয়- সেখানে মাছ ধরতে যাই। বেশ ভালো লাগে মাছ ধরতে। বাড়ি থেকে ফজরের আজান দেয়ার পরে বের হয়েছি। মাছ ধরে তার পরে বাড়ি যাব। ভাগ্য সহায় হলে বিলের সবচাইতে বড় মাছ আমি পেতে পারি।

নাটোর থেকে আসা মাছ শিকারি সুলতার আহম্মেদ টিুপু বলেন, এই গ্রামে আমার আত্মীয় রয়েছে। তার মাধ্যমে খবর পেয়ে গতকাল এখানে এসেছি। সকলের সাথে বিলে মাছ ধরব- খুব আনন্দ হবে। তবে বিলের পানিতে অনেক ক্ষণ থাকতে হয়। তাই প্রচুর তেল নিয়েছি গায়ে। উন্মুক্ত বিলে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা।

স্থানীয় মাছ শিকারি আশরাফুল রনি বলেন, বিলে আগের মত আর মাছ পাওয়া যায় না। ছোট বেলাতে বাবার সাথে বাউতে মাছ ধরতে আসতাম। অনেক মাছ পাওয়া যেত তখন। আর এখন এতো মানুষ মাছ পাওয়া যায় খুবই কম। তবে এবার বর্ষার সময় পানি হয়েছে অনেক বাজারে মাছ ও পাওয়া গেছে বেশ ভালই। আশা করা যায়, সব ধরনের মাছ ধরা পড়বে। এই আনন্দ আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়।

বাউত উৎসব নিয়ে ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের অংশ এই বাউত উৎসব। আমার উপজেলাসহ পাশের আরো দুটি উপজেলার বেশ কিছু অংশ চলন বিল এলাকা। এই বিলে প্রচুর পরিমাণে দেশি মাছ পাওয়া যায়। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এই রুহুল বিলে মাছ ধরার উৎসব হয়। সৌখিন মাছ শিকারিরা প্রতি বছর এই উৎসব পালন করে থাকে। আমরা উৎসবের আনন্দকে সুন্দরভাবে পালন করা জন্য গ্রাম্য প্রধানদের অনুরোধ করি। এই উৎসবকে ঘিরে বিল পারের গ্রামগুলোতে চলে উৎসবের আমেজ। শীতের পিঠা আর বিলের মাছ বেশ মজা হয় উৎসবকে ঘিরে।

তিনি বলেন, বিলে দেশি মাছ সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিলের জলাশয় অবমুক্ত করার জন্য মৎস্য অভয় অরণ্যসহ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর বিলে প্রতিবছর সরকারিভাবে মাছের পোনা অবমুক্ত করছে। বিলে যদি মাছ না থাকে, তা হলে এই উৎসব হারিয়ে যাবে। তাই দেশি মাছ আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। কারেন্ট জাল ব্যবহার করা যাবে না। তবেই আমরা এই উৎসব প্রতিবছর করতে পারব। বাংলা ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

(ঢাকাটাইমস/২ডিসেম্বর/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :