আমি পাখি হতে চাই না

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:২২

আমার ঘরের পাশে একটি চেরি প্লাম গাছ। সেখানে ধরেছে অনেক ফল। পাতার আড়ালে আড়ালে গোল গোল চেরি যেন। পাকতে শুরু করেছে কয়েকদিন হলো। তবে আজ অন্যরকম। সেখানে হানা দিয়েছে টিয়া। অস্ট্রেলিয়ান টিয়া- দেখতে আলাদা। লাল ঠোঁট, জাম রঙের কেশর, সবুজ বরণ , আর বুকে সোনালী আভা। এই টিয়া পাখি আজ ওই চেরি প্লাম গাছে এসে ফল খাচ্ছে। যেভাবে বাবুইপাখি ঝুলে থাকে সেভাবে ঝুলে ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে ফলের রস ও মাংস খাচ্ছে!

টিয়ার ফল খাওয়া দেখে আমার খুব রাগ হলো। ও এতদিন কোথায় ছিল? আমি তাড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হলাম। দুই একবার শব্দ করলাম। ক্যাচ ক্যাচ করতে চলে গেলো। আমিতো আবার কালো! ও তো আবার গালি দিলোনাতো? Racist টিয়া! পাখিরাও কি Racist হয়? হতেও পারে!

দেখতে সুন্দর হলেও টিয়ার কণ্ঠস্বর সুরেলা নয়। কিন্তু পরে মায়া হলো। আল্লাহই তো ওদেরকে পাঠিয়েছেন। আমি কে? আমার কি অধিকার আছে ওদের বাধা দেয়ার? ওদের বাঁচার অধিকার আছে। ক্যাচ ক্যাচ করে হয়তো তার রাইট তো লাইফ (Right to life) জানিয়ে গেলো। অস্ট্রেলিয়ান টিয়া - তারতো Right বোঝবার কথা। সে হয়তো Justice বোঝে! আর ওদের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করে। সেটাই ওদের অবদান। কেন তবে তাড়িয়ে দেয়া!?

কিছুদিন আগে একটি মই এনে আচারের জন্য কিছু কাঁচা প্লাম পেড়েছিলাম। এখন মই আনতে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। প্রতিদিন যেসব ঘুঘু, শালিক দেখি তারা নেই এই ফল খাওয়ার আনন্দে। অবাক হবার মতো বিষয়! যাহোক কোনোভাবে একটি কুটা বানিয়ে কিছু ফল পাড়লাম। তবে অনেকগুলো ফেটে চৌচির - যেন সেই বাংলার ধান খেত- চৈত্র মাসে যেমন হয়। ছোট্ট বেলার সেই স্মৃতি গুলো মনে ভেসে উঠলো। পাখিরা সব পারে। উড়তে পারে - রোদ -বৃষ্টি -ঝড়ে বাঁচতে পারে! তাই মনে হলো কেন পাখি হলাম না!

বিজয়ের মাস আসলে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যায়। পাখির বাসায় ডিমের অনুসন্ধান, পাখির বাচ্চার ঝড়ে নিচেয় পড়ে যাওয়া এবং তাকে আদর করে কিছু খাওয়া দেয়া- আমার চির সবুজ বাংলা। নদীর পাড়ে শালিক পাখির বাসায় গিয়ে পাখির বাচ্চা নিয়ে খেলা করা। সেটা দেখে মা শালিকের চিৎকার ! মাথার উপর উড়ে উড়ে চক্কর দেয়া। এসব আনন্দ করে প্রকৃতির মাঝে বড়ো হয়ে উঠা। এরপর বাবা সঙ্গে খেত -খামারে কাজ শেষ করে একদিন শহরে এলাম।মার্চ মাস। অগ্নিঝরা ৭১ এর মার্চ। লঞ্চ থেকে নামতেই হরতাল! পায়ে হেঁটে আমরা গন্তব্যে এলাম।

প্রথম শহর দেখা। কি রকম অনুভূতি তা এখন মনে নেই।তবে মনে আছে পতাকা বানানো, সেটা উত্তলোন করা এবং জয় বাংলা শ্লোগান আর সোনারবাংলা গানে পথচলা। শহরের কথা যতনা মনে পড়ে তার চেয়ে মনে পড়ে গ্রামের কথা। সেখানকার মানুষের কষ্টের কথা।

আজ আবার মনে পড়লো সেই চৈত্র মাসের ক্ষেতের কথা। বড়ো বড়ো ঢেলা। আর রোদের গরম।সঙ্গে সঙ্গে হুজুর স্যার এর কথাও মনে পড়লো। আরবের এরকম তপ্ত বালু পথে নবীরা কি রকম সংগ্রাম করতেন সে সব কথা। একটি খেজুর খেয়ে দিন পার করে দিতেন। মনে পড়লো খলিফাদের কথা। রাতে দরিদ্রদের অবস্থা দেখতে লুকিয়ে ঘোরাফেরা করতেন। এখনকার খলিফারা রাতে হয়তো- নাহ লিখতেও চাই না।

গ্রামের কথা মনে পড়তে স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো খালি পায়ে সেই মাঠ অতিক্রম করে নিজেদের খেতে কৃষকদের কাছে এক জগ পানি পৌঁছানোর সংগ্রামের কথা। সেখানে এক জগ পানি অনেক শান্তির। কৃষকরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার আব্বার উদ্দ্যেশে বলতো -দেখেন কিরকম লাল হয়ে গেছে কাকজান। ওকে আর আসতে বলিয়েন না। আমরা যেয়ে পানি ও খাবার খেয়ে আসবো। এভাবেই বাংলার ৯০ ভাগ মানুষ জীবন যাপন করে বেঁচে আছেন বাংলার বুকে। সেই কষ্টের গ্রাম শহর হবে কবে সেই স্বপ্ন দেখতাম। আজ সরকারই সেই স্বপ্ন দেখে।

একসময় চাষীকে ইংরেজরা নীল চাষ করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আন্দোলন থামেনি। মুক্তির আশায় তারা ঠিকই একদিন ইংরেজদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওই ইংরেজদের তাড়াতে নাকি মুসলমানরা -আলেমরা ছিলেন অগ্রণী। সেই আলেম সমাজ আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তবে ভারতে এখনও কৃষক আছে। সেই কৃষকরা দিল্লির পথে যাত্রা শুরু করে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। তারা একটি আইনের বাতিল চায়। কর্পোরেট সিস্টেমের মধ্য দিয়ে আবার যেন ফিরে আসছে - ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো শোষকের দল। তাদের রুখে দিতে এই আন্দোলন। বাংলাদেশেও শোষকের দল অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তারা পাখিদের মতো কাজ না করে খেতে চায়।

ইংরেজ থেকে মুক্ত হয়ে আমরা আরেক হানাদারদের কবলে পড়েছিলাম। আমরা মুসলিম। তারাও মুসলিম। আমরা এক জাতি!? কিন্তু! আমি ১৯৭০ সালের কথা বলছিলাম। আমাকে ওই মাঠে যেতে হতো কৃষকের জন্য এক জগ পানি নিয়ে তপ্ত মাঠ পেরিয়ে! আর বাংলার কৃষকের ওই কষ্টের ফসল খেত পাকিস্তানিরা। মানুষ তাই আরেকবার মুক্তির কথা ভাবলো। ১৯৭১ সাল এলো আমাদের জীবনে। সব কিছু তছনছ করে দিয়ে পাকহানাদাররা এই ডিসেম্বর মাসে চলে গেলো- আমরা বাঙালি এই ছিল সেদিনের উপলব্ধি।

১৬ ডিসেম্বর আমরা মুক্ত হলাম। মুক্তির সংগ্ৰামে আমরা অনেকেই অনেককে হারিয়েও কাঁদিনি! আনন্দে হেসেছি! কারণ আমরা মুক্ত! সেদিন ছিলো কেবল একটি বিভক্তি রাজাকার - মুক্তিযোদ্ধা। কথা সাহিত্যিক হুমায়ন আহমেদ সেই টিয়া পাখিকে শিখিয়ে ছিলেন - তুই রাজাকার। সকলে তাই পাখিকে ভাল মনে করতো। সকলেই ভুলে গিয়েছিলো কিভাবে টিয়া পাখি কৃষকের ক্ষেত্ উজাড় করে তার সর্বনাশ করে। এখন যেমন অনেকেই মৌলবাদ বিরোধী সেজে লুটপাট করে বেগমগঞ্জে পাচার করছে।

১৯৭১ সালে যে মুক্তির জন্য আমরা লড়াই করেছি-সেই মুক্তির স্বাদ কি আমরা পেয়েছি? পাইনি বলেই কি আমি পাখি হতে চাই? এখনো দেখি বিজয় দিবসে কবুতর উড়িয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা স্বাধীনতাকে উপভোগ করে । কিন্তু আমার মতো আজকের শিশুরা ওই তপ্ত মাঠ পেরিয়ে এক জগ পানি নিয়ে কৃষকের কাছে যাওয়ার সংগ্রাম শেষ হয়েছে কি? গ্রাম বাংলার শিশুরা এখন কেমন আছে? তারা কি একদিন পাখি হতে চাইবে?

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বিজয়ের ৫০ বছর হতে চলেছে - কিন্তু সেই কাংখিত বিজয় কি আমরা পেয়েছি? বিজয় মানে আসলে কিসের স্বাধীনতা? এখন আমাদের শিশুরা জাতীয় সংগীত গেয়ে ক্লাসে যায়। তারা গায় -আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু সেই সোনার বাংলা কোথায়?

আজ প্রায় ১০ মাস তারা আর স্কুলে যেতে পারে না, গাইতে পারেনা আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। করোনা ভাইরাস কি এতো শক্তিশালী? তারা কি ইংরেজ -পাকিস্তানিদের থেকে শক্তিশালী? ১০ মাসেও আমরা পরাজিত করতে পারি না!

তাহলে অস্ট্রেলিয়া কিভাবে করলো? যদিও তারা এখন মাস্ক পরে স্কুলে যায়। কিন্তু তারা এখন বুক ভোরে নিঃস্বাস নিতে পারে। আমরা কেন পারি না? এক বেলা খেয়ে যদি ৭ কোটি থেকে ১৭ কোটি হতে পারি- তবে কেন পারিনা করোনা ভাইরাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে?

আমি আমার দেশে বুক ভরে নিঃস্বাস নিতে চাই। আমার দেশে পতাকা উড়িয়ে গাইতে চাই আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। আমি চিৎকার করে বলতে চাই - করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত করা হলো আসল রাজনীতি-ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক নয়।

আমি চিৎকার করে বলতে চাই - আমি স্বাধীনতা চাই কথা বলবার। আমি সরকারের পলিসি ভালো -মন্দ দিক নিয়ে বিরোধী দলের কথা শুনতে চাই, আমি আমার কাজে যেতে চাই নিরাপদ সড়কে। যেন তুর্কি -মুন্নার মতো শাহাদৎ বরণ না করতে হয় রাজপথের সকালে ছিনতাইকারীর চুরিতে।

আমাকে যেন রোগী নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটতে না হয়-আমি ঘুমোতে চাই আমার কুঁড়ে ঘরে দুয়ার খুলে দিয়ে। আমি আমার কাজের জায়গায় ফিরে যেতে চাই। আমি বলতে চাই খুলে দাও বিশ্ববিদ্যালয় -স্কুল -কলেজ।

পাখিরা কাজ করে না। পাখিরা শিশুদের হাত থেকে খাবার কেড়ে নেয়। কোনো কোনো পাখি যেমন কোকিল সুরেলা গান শোনালেও সে কাকের বাসায় ডিম্ পাড়ে। কাকের উমে বাচ্চা ফোঁটায়। পাখিরা করোনা ছড়ায়, কৃষকের খেতে ছড়ানো বীজ ধান খেয়ে যায়, কৃষকের লাঙ্গল কেঁচোকে খায়। আমি ওই পাখিদের তাড়িয়ে দিতে চাই যারা ওই কৃষকের খেতে হানা দেয়। তপ্ত মরুর পথে হেঁটে জীবিকার জন্য যারা জীবন দেয় তাদের রেমিট্যান্স চুরি করে ভদ্রলোক বেশে বিদেশে পাঠায় যারা -আমি সেই পাখিদের তাড়িয়ে দিতে চাই। সেজন্য আমি পাখি হতে চাই না ! সেজন্য জীবনানন্দ দাশের মতো আমি বলতে চাইনা - আবার “আসিব ফিরে এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।”

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :